বইঃ অন্দরমহল
লেখকঃ সাদাত হোসাইন
প্রকাশনীঃ ভাষাচিত্র
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৪৩৮
মুদ্রিতমূল্যঃ ৬৫০৳
কাহিনী সংক্ষেপঃ
বিশাল গঙ্গাবতী নদীর তীর ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে বিষ্ণুপুর জমিদারির প্রাসাদ গঙ্গামহল। জমিদার বিষ্ণুনারায়নের তিন পুত্র। হিসাবমতে বড়পুত্র অবনীন্দ্রনারায়নের জমিদার হওয়ার কথা থাকলেও তিনি হলেন ভাবের জগতের মানুষ। নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর গান-বাজনা নিয়েই তার আপন জগৎ। তাছাড়া জমিদারি সামলানোর জন্য অত শক্ত-সামর্থ্য আর বিচক্ষণও নন তিনি। তাই এতদিনে সবাই বুঝে গিয়েছে অবনীন্দ্রনারায়নকে দিয়ে আর যাই হোক জমিদারি হবে না।
উপরন্তু মেজোপুত্র দেবেন্দ্রনারায়ন প্রচন্ড ব্যক্তিত্ত্ববান, সুপুরুষ। নিজের সামর্থ এবং সিদ্ধান্তের প্রতি তার অগাধ আস্হা। কৈশোর থেকেই সে কাউকে তোয়াক্কা করে না। তাই একরকমভাবে এ ঠিক হয়েই ছিলো দেবেন্দ্রনারায়নই হবে বিষ্ণুপুরের পরবর্তী জমিদার। এব্যাপারে সকলের মতৈক্য থাকলেও বাধ সাজে অবনীন্দ্রনারায়নের স্ত্রী বীনাবালা। দেবেন্দ্রনারায়নকে ধাতস্থ করার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্রের সতরঞ্জের দান সাজায় সে। তার সেই দানের প্রধান গুটি হিসেবে ব্যবহার করে হেমাঙ্গিনী দেবীকে। রাইপুরের বিখ্যাত বাঈজী হেমাঙ্গিনী দেবী, তবে ছোট থেকে বিষ্ণুপুরেই বেড়ে উঠা তার। একাধিক নারীর শয্যাসঙ্গী দেবেন্দ্রনারায়ন এই হেমাঙ্গিনী দেবীকেই খানিকটা ( হয়তো নিজের স্ত্রীর চেয়েও বেশি) সমীহ করেন । দুজনার মধ্যে একটা অদৃশ্য ভালোবাসার সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও খামখেয়ালি দেবেন্দ্রনারায়ন হেমাঙ্গিনীকে বিয়ে করেন নি।
আরও পড়ুনঃ যে দশটি বই জীবনে একবার হলেও পড়া উচিত
সেই ছোট থেকে বিষ্ণুপুর জমিদারির উপর হেমাঙ্গিনী দেবীর পুষে রাখা রাগ-ক্ষোভ আর ঘৃণাকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে বীনাবালা। হঠাৎ করে বিষ্ণুপুরে গুটি বসন্তের প্রকপ পড়ায় দেবেন্দ্রনারায়নও সেই কালব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যান। সেই সুযোগকেই কাজে লাগায় বীনাবালা।
বিষ্ণুনারায়নের মৃত্যুর পর অবীন্দ্রনারায়নকে নামমাত্র জমিদার ঘোষণা করে অন্দরমহল থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকে সে। মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখির মতো অবনীন্দ্রনারায়ন একরকম বন্দী হয়ে যায়। তাই সুযোগ বুঝে প্রাসাদের বন্দী জীবন ছেড়ে সে গৃহত্যাগী হয়।
এরপর শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। বীনাবালা চায় তার পুত্র দ্বিজেন্দ্র হবে পরবর্তী জমিদার। কিন্তু এই জমিদারির যে আরও একজন অংশীদার রয়েছে, বিষ্ণুনারায়নের ছোটপুত্র দীপেন্দ্রনারায়ন।
দীপেন্দ্র কি এত সহযে তার অধিকার ছেড়ে দেবে?
তাহলে, কে হবে বিষ্ণুপুরের পরবর্তী জমিদার?
দ্বিজেন্দ্র, দীপেন্দ্র নাকি অন্যকেউ?
বিষ্ণুপুর জমিদারির ভবিষ্যৎ আসলে কি?
আরও পড়ুনঃ শরৎচন্দ্র রচনা সমগ্র PDF
গঙ্গামহল ছাড়া উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো বারোহাটির বাগানবাড়ি।
দেবেন্দ্রনারায়ন বারোহাটির জঙ্গলের মধ্যে এই বাগানবাড়ি তৈরি করেন। উপন্যাসের শুরুটা এই বাগানবাড়িতেই। সার্বক্ষণিক আমোদপ্রমোদে মত্ত এই বাড়ীও একসময় শ্মশানে পরিণত হয়।
কথায় আছে পাপ নিজের বাপকেও ছাড়েনা। এর প্রকৃত উদাহরণ হলো কমলাদাসী, দ্বিজেন্দ্রও অবশ্য তার পাপের শাস্তি কম পায়নি। কিন্তু সকলের পাপের মূলে আছে যে, সেই বীনাবালা কি তার পাপের শাস্তি পাবে না? তাছাড়া একটু একটু করে পাপ জমতে জমতে যে গঙ্গামহল তৈরি হয়েছে সেই গঙ্গামহলকেও কি শাস্তি গুনতে হবে?
বন বাদারে ঘুরে ফেরা হরিহরণ বণিক, গানের শিক্ষক রতনকান্তি, আর গুটি বসন্তে অন্ধ বিভুই হলো অন্দরমহলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র যাদের কথা না বললেই নয়। এছাড়া আরও কিছু চরিত্র রয়েছে যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে কাহিনীর প্রবাহে সহায়তা করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলো বিভুতিনাথ সাহা, ভুজঙ্গ দেব, দিবাকর চাটুজ্জে , রেনুকা, সর্বজয়া, সুদক্ষিণা, অপলা মাসি আরও অনেকেই।
আরও পড়ুনঃ দ্য আলকেমিস্ট রিভিউ PDF
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ
অন্দরমহল মূলত এক হিন্দু জমিদার পরিবারের আখ্যান। তবে উপন্যাসের সময়কাল নিয়ে লেখক স্পষ্ট কোনো ধারণা ধারণা দেননি। এ নিয়ে অবশ্য প্রথমেই তিনি বিস্তর আলোচনা করেছেন। রাত তিন প্রহরে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে উপন্যাসের শুরু। সেই ঘটনার জট ছাড়াতে ছাড়াতে উঠে এসেছে জমিদার বাড়ীর অন্দরমহলের নানা রকম রহস্য, ষড়যন্ত্রের কথা।
ক্ষমতার লোভ ভীষণ ভয়ানক জিনিস। যেখানে চিরকাল আড়ালে থাকা কোনো ছায়ামূর্তিও যে ক্ষমতার লোভে ধুরন্ধর হয়ে উঠে, সেখানে ক্ষমতা হাতে পেয়েও সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে কেউ কেউ সেচ্ছায় বেছে নেয় সন্ন্যাস জীবন, আবার ক্ষমতা হাতে নিয়ে একটু একটু করে বেড়ে উঠা কেউ হঠাৎ করেই হয়ে যায় নিঃস্ব, সেই ক্ষমতা হাতে পেয়ে কেউ হয়ে যায় বেপরোয়া। এসব কিছুরই সুক্ষ্ম বর্ণনা আছে এই উপন্যাসে।
আরও পড়ুনঃ সেই সময়, প্রথম আলো ও পূর্ব পশ্চিম | সুনীলের টাইম ট্রিলজি
কিন্তু প্রকৃত অর্থে তো আমরা সবাই নিঃস্ব, পৃথিবীতে যা কিছু আমরা নিজের করে দেখি, নিজের ভাবি তার সবই কিন্তু আপেক্ষিক। আর এই আপেক্ষিকতা নিয়ে বাচতে গিয়ে আমরা বেচে থাকার প্রকৃত অর্থই ভুলে যাই। এই নিয়ে লেখক অবনীন্দ্রনারায়নের মাধ্যমে চমৎকার একটি উক্তি বলেছেন,
“আমাদের কিছুই নেই, অথচ সবটা সময় জুড়ে ভাবি, এই বুঝি নিঃস্ব হলাম”
১২ শব্দের একটা লাইনে যে কতটা বাস্তবতা মেশানো আছে কেউ একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে৷
সাদাত হোসাইনের লেখা আমার কাছে বরাবরই ভালো লাগে। উনার লেখার ধরন সম্পর্কে অনেকের অনেক মতামত থাকলেও, আমার মনে হয় তিনি নিজস্ব স্টাইলেই লেখেন। তাই কয়েক পাতা পড়লেই বোঝা যায় যে এটা সাদাত হোসাইনের লেখা। সহজ সাবলিল ভাবে কাহিনীর বর্ণনা পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে বাধ্য ।
উনার সবগুলো উপন্যাসই আমার মোটামুটি পড়া। প্রত্যেকটা উপন্যাসের প্লট ভিন্ন ভিন্ন হলেও অন্দরমহল এর প্লটটা একটু বেশী অন্যরকম। আসলে ঐতিহাসিক কোনো কাহিনী নিয়ে পড়তে সবসময় রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়। যদিও লেখক স্পষ্ট করেই বলেছেন অন্দরমহল কোনো ঐতিহাসিক কাহিনী নয়, তবুও আমি ঐতিহাসিক ভেবেই পড়েছি।
অন্দরমহল মূলত ফিকশন হলেও মাঝে মাঝে থ্রিলার থ্রিলার গন্ধও পাওয়া যায় । কারন লেখক পাতায় পাতায় রহস্য তৈরি করে গেছেন। এরপর কি হবে? এই নিয়ে সবসময় একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করেছে। এতে অবশ্য সুবিধাই হয়েছে। বইটা তাড়াতাড়ি পড়ে শেষ করার তাড়না কাজ করেছে।
আরও পড়ুনঃ বাংলা সাহিত্যে যত ত্রয়ী বা ট্রিলজি
তবে একটা বিষয়, গল্পে কোনো একটা ঘটনা অসমাপ্ত রেখেই লেখক অতীত বর্ণনায় চলে গেছেন, এই বিষয় টা বারবার চোখে পড়েছে। যদি বর্তমানের কাহিনী একটু গুছিয়ে নিয়ে অতীতের ঘটনা বর্ণনা করা হতো অথবা কাহিনী যদি ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যেতো তবে হয়তো পড়তে আরেকটু সহজ হতো। তবে লেখকের কলমের দক্ষতায় বিষয়টি খুব একটা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনি। যদিও এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত, দয়া করে কেউ নেতিবাচক ভাবে নেবেন না।
সর্বোপরি অন্দরমহল ফিকশন হোক অথবা ঐতিহাসিক কোনো কাহিনী যাই হোক আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। যারা সাদাত হোসাইনের কোনো বই পড়েন নি বা পড়তে চাইছেন তারা অন্দরমহল দিয়ে পড়া শুরু করে দিতে পারেন। আশা করি ভালোই লাগবে।
লিখেছেনঃ Habiba Kamrun Shia
বইঃ অন্দরমহল [ Download PDF ]
লেখকঃ সাদাত হোসাইন
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
বিশ্বের সেরা অনুবাদ বই গুলো ডাউনলোড করুন