দার্শনিক ভাষণ | বিষয়: শিক্ষা | প্রথম পর্ব | মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
আপনাকে শিক্ষিত করার জন্য নয়, শিক্ষার উদ্ভব ঘটেছিলো রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। শিক্ষা একটি রাজনীতিক আবিষ্কার। রাজনীতিকদের আবিষ্কারের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও, এই একটি আবিষ্কারের মাধ্যমেই তারা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন পৃথিবীর সকল আবিষ্কারের। রাজনীতিকেরা দেখলেন যে, শিক্ষা মানুষকে প্রশিক্ষিত ও শৃঙ্খলিত করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুশৃঙ্খল মানুষকে শাসন, ও শোষণ করা সহজ হয়। রাজার যেকোনো আদেশ, নিষেধ, ও ঘোষণাকে তারা সহজে আমলে নেয়। রাজা কী কী চান, ও কী কী চান না, তা শিক্ষিত মানুষেরা, অশিক্ষিত মানুষদের চেয়ে দ্রুত অনুধাবন করতে পারে।
শিক্ষার প্রথম কাজ, কোনো রাষ্ট্রে, শিশুদেরকে তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা। বাবা-মা বা সমাজ নয়, রাষ্ট্রই শিশুটির প্রকৃত অভিভাবক, এ মিথ্যেটিকে সত্যরূপে, শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। দেশের তরে জীবন দিতে হবে, এ রাজনীতিক ধারণাটি একটি শিশু শিক্ষা থেকেই প্রথম পায়। রাজনীতিকেরা এটিকে ডাকেন দেশপ্রেম। দেশপ্রেমের রাজনীতিক সংজ্ঞা, আমি মনে করি— দেশের জন্য সর্বদা জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকা।
কেউ দেশপ্রেমিক, কিন্তু তিনি দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত নন, এটি রাজনীতিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রাজনীতিকেরা দেশপ্রেমের কাল্পনিক গুরুত্ব, তাদের নিজেদের স্বার্থে, শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে দেন। সমাজে কোনো ধারণা দীর্ঘদিন প্রচলিত থাকলে, তা অনেকটা ধর্মের রূপ ধারণ করে। এক্ষেত্রে ধারণাটি, মানুষের জন্য উপকারি না কি অপকারি, উদ্ভট না কি সুন্দর, যৌক্তিক না কি অযৌক্তিক, তা বিচার্য বিষয় নয়। বিচার্য বিষয় হলো, ধারণাটিতে কতোজন মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এক্ষেত্রে বিশ্বাসী মানুষদের গুণগত মান প্রাসঙ্গিক নয়, তাদের সংখ্যাটিই গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যাটি বেশি হলে, ধারণাটি সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
কোনো ধারণা একবার সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, তার একটি সামাজিক মূল্য তৈরি হয়। ঐ মূল্য পরিশোধ না করে, ধারণাটি নিয়ে কোনো সন্দেহ পোষণ করা যায় না, এবং যাচাই করা যায় না এর সত্যতা। বহুক্ষেত্রে, এ মূল্য পরিশোধ করতে আপনাকে জীবনও দিতে হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ জিপিএ ফাইভ পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছিলো জুতোর ফ্যাক্টোরিতে
এরিস্টোটলের সময়ে, সমাজে একটি ধারণা ছিলো যে— নারীদের মুখে দাঁতের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে কম। এরিস্টোটল এটিকে বিশ্বাস করতেন। কারণ সমাজে, এটিই ছিলো প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু এ সত্য আসলেই সত্য কি না, তা এরিস্টোটল যাচাই করে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন নি। যদিও তাঁর স্ত্রী ছিলো, এবং মিসেস এরিস্টোটলকে সহজেই হা করিয়ে তিনি এর সত্যতা নিরূপণ করতে পারতেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, শিক্ষা কী কী উপায়ে একটি শিশুকে, দেশপ্রেম ধারণাটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়?
এর অনেকগুলো উপায় আছে। জাতীয় সঙ্গীতের কথাই ধরা যাক। শিক্ষা একটি শিশুকে, দেশপ্রেমের সাথে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে। জাতীয় সঙ্গীত ধারণাটি বিকাশ লাভ করেছে জাতীয়তাবাদ থেকে। আমি ও আমার জাতি শ্রেষ্ঠ— এটি মনে মনে পোষণ ও বিশ্বাস করাই জাতীয়তাবাদ। জাতীয় সঙ্গীত এ বিশ্বাসের একটি আবৃত্তিযোগ্য কাব্যরূপ মাত্র, এটি মোটেও সঙ্গীত নয়। কিন্তু সমাজে এটিকে সঙ্গীত হিশেবে প্রচার করা হয়েছে, এবং মানুষ তা বিশ্বাস করেছে। রাজনীতিকেরা এটাই চান। রাজনীতিক প্রোপাগান্ডা যারা সহজে বিশ্বাস করে, তারা চিরকাল রাজনীতিকদের আপনজন। তাদের নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। ভয় তাদের নিয়ে, যারা রাজনীতিক প্রোপাগান্ডাকে সন্দেহের চোখে দেখে। কোনো ফুলের মালার পেছনের উদ্দেশ্যটি খতিয়ে দেখতে চাইলে, রাজনীতিকেরা খুব রুষ্ট হন।
জাতীয় সঙ্গীত, শিক্ষিত সব মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। কোনো কোনো দেশে, সঙ্গীতটিকে এতোই মহান করে তোলা হয়েছে যে, সিনেমা হলে সিনেমা দেখার সময়ও এটিকে পরিবেশন করা হয়, এবং দর্শকেরা দাঁড়িয়ে এটিকে উপযুক্ত সম্মান জানান। আমি একবার না দাঁড়ানোয়, সবাই খুব সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিলো।
শিশুরা ইশকুলে ঢুকেই গানটি গায়। গানটি যে তারা নিজে থেকে গায়, এমন নয়। গানটি তাদের দিয়ে গাওয়ানো হয়। ফলে এটি স্বতঃস্ফূর্ত নয়। এটি আরোপিত সঙ্গীত, এবং এর সারমর্ম মিথ্যা। আমি শিশুদের সাথে মিথ্যে বলার বিরোধী।
আরও পড়ুনঃ ছাগল ও তার পিএইচডি ডিগ্রি
রাষ্ট্র তার জাতীয় সঙ্গীতে এমন সব জিনিস বর্ণনা করে, যা কাল্পনিক ও বানোয়াট। কিন্তু কল্পনাকে শিশুদের সামনে উপস্থাপন করা হয় বাস্তবরূপে। এই মুহুর্তে বিশ্বে যতোগুলি জাতীয় সঙ্গীত আছে, তাদের সবগুলিতেই সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি, যুদ্ধ, ও বীরত্বগাঁথা— এ চারটি বিষয়ের অবাস্তব উপস্থাপনা রয়েছে। সেনেগালের কথাই ধরি। তাদের জাতীয় সঙ্গীতে ‘দি রেড লাইয়োন হ্যাজ রোরড’, বা ‘লাল সিংহ হুঙ্কার দিয়েছে’, এরকম একটি লাইন রয়েছে। ক্লাশ থ্রি বা ফোরের কোনো শিশুর পক্ষে কবিতা বুঝা সম্ভব নয়। মিথ্যাকে মিথ্যা হিশেবে ব্যাখ্যা না করলে একটি শিশু মিথ্যাকেই সত্য হিশেবে ধরে নিতে পারে। কল্পনা যে কল্পনা, তা বুঝিয়ে না বললে সে ওই কল্পনাকেই বাস্তব হিশেবে মেনে নিতে পারে। আমি একসময় আলিফ লায়লার জ্বীনকে বাস্তব ভেবে রাতে হাঁটতে ভয় পেতাম।
কবিতার লাল সিংহ যে একটি অতিরঞ্জিত রূপক, তা কি সেনেগালে শিশুদের কাছে পরিষ্কার করা হয়? হয় না। শিশুরা ধরে নেয় যে পৃথিবীতে লাল রঙের সিংহ আছে, এবং সিংহদের মধ্যে লাল রঙের সিংহই শ্রেষ্ঠ। শিশুদের মাথায় এটি ঢুকিয়ে দেয়া হয়— সেনেগালিজরাই বনের ওই লাল সিংহ। জাতি হিশেবে সেনেগালিজরাই শ্রেষ্ঠ। আর যারা আছেন, ইংরেজ, মার্কিনি, ফরাসি, আরবী, বাঙালি, স্প্যানিশ, চাইনিজ, জাপানি, সবাই নিকৃষ্ট। তারা সিংহের রাজ্যে মেষ, খরগোশ, ও বনবিড়াল। বিশ্ব সভ্যতায় সেনেগালের অবদান যাই হোক না কেন, সেনেগালের লাল সিংহরাই শ্রেষ্ঠ, এ বিশ্বাস নিয়েই শিশুরা বড় হয়।
এ আত্মতুষ্টি শিশুটির ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। সে যখন বড় হয়, তখন সেনেগালের সবকিছুকেই তার ভালো মনে হয়। সেনেগালের রাজার সকল কর্ম ও সিদ্ধান্তকে সে ভালো ও স্বাভাবিক হিশেবে গণ্য করতে শুরু করে। কারণ লাল সিংহ শ্রেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ সিংহ কখনো ভুল করতে পারে না। লাল সিংহের রাজা যা করেন, তা সিংহদের ভালোর জন্যই করেন।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : লিও তলস্তয় | প্রথম পর্ব
এভাবে জাতীয় সঙ্গীত, ধীরে ধীরে শিশুটির চিন্তা ও প্রতিবাদ করার শক্তি কেড়ে নেয়। ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে, ভালো ও খারাপের মধ্যে, সত্য ও মিথ্যের মধ্যে, সঠিক ও ভুলের মধ্যে, সে আর তখন কোনো পার্থক্য করতে পারে না। ফলে নাগরিক হিশেবে, সে তার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও চিন্তার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে, এবং পরিণত হয় অনুগত মেষে।
সে যেহেতু ইতোমধ্যে শ্রেষ্ঠ, তাই সে নতুন করে আর কোনো জ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করে না। সে উপভোগ করতে থাকে আত্মপ্রসাদগ্রস্থ বুড়ো মানুষের জীবন, যার স্বপ্ন কবরে ঢুকে জৈবসার হওয়া। তবে কেউ কেউ নিয়ম ভাঙে, কিন্তু তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। পৃথিবীতে কোনো দেশেই একটি ভালো লেখা ও ভালো আবিষ্কারের সাথে জাতীয় সঙ্গীতের কোনো সম্পর্ক পাওয়া যাবে না। জাতীয় সঙ্গীতের সাথে সম্পর্ক আছে বোমা, যুদ্ধ, অহংকার, ও ধ্বংসের। এটি শিশুদের প্রতিশোধ পরায়ণ হতে শেখায়।
ব্রিটিশ নৌবাহিনী যখন আমেরিকার ম্যাক-হ্যানরি দূর্গ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলো, তখন ফ্রান্সিস স্কট নামে একজন আইনজীবী ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। স্কট কবিতাও লিখতেন। তিনি লিখলেন একটি কবিতা— দ্য স্টার স্প্যাঙ্গোলড ব্যানার। কবিতাটি একসময় মার্কিন নৌবাহিনীর দাপ্তরিক সঙ্গীতে পরিণত হয়, এবং প্রেসিডেন্ট উইলসন, পরে এটিকে আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত হিশেবে ঘোষণা করেন।
স্কট কবিতাটি লিখেছিলেন আবেগতাড়িত হয়ে। তিনি বোমাক্রান্ত দূর্গে উড়তে থাকা মার্কিন পতাকাটি দেখে আবেগাক্রান্ত হন। সব ধ্বংস হবে, কিন্তু আমেরিকার পতাকা ধ্বংস হবে না, এটিই ছিলো কবিতাটির মূলভাব। কবিতাটির একটি লাইন এরকম—
“উই উইল কিপ হার ব্রাইট ব্লেইজান ফরেভার আনস্টেইন্ড”
এ লাইনটি আমেরিকা রাষ্ট্রটির ঔদ্ধত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের দিকে ইঙ্গিত করে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু তারা তাদের পতাকার মান রাখবে, এটিই আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত। পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতই এরকম ঔদ্ধত্যের শ্লোগান। এ সঙ্গীত শিশুদের কেবল অহংকার আর অসারতাই শেখায়। আমি শিশুদের অহংকার ও অসারতা শেখানোর পক্ষে নই।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : ফিওদর দস্তয়েভস্কি | প্রথম পর্ব
জাতীয় সঙ্গীতের যে-চেতনা, তা মূলত নিজেকে ফেরেশতা আর অন্যকে শয়তান ভাবার চেতনা। এতে যুদ্ধবিগ্রহ বাড়ে। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো এ চেতনায় ঝাপিয়ে পড়তে পারে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর উপর। শত্রু সম্পত্তি হিশেবে দখলে নিতে পারে দুর্বল রাষ্ট্রের তেল, গ্যাস, ও ভূভাগ। প্রাণ যেতে পারে বহু নিরীহ মানুষের। এ চেতনা একটি শিশুর মনে কৃত্রিম পক্ষপাতিত্বও সৃষ্টি করে। সে তার নিজের দেশের মানুষ ছাড়া, অন্য যাকেই দেখে, তাকেই প্রতিপক্ষ ভাবে। তার ধারণা, ভীনদেশীরা তার দেশের পতাকা, আকাশ থেকে যেকোনো সময় মাটিতে নামিয়ে ফেলতে পারে। অনেক দূরের কোনো রাষ্ট্র, তার নিজের রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে, এটিও তাকে বিচলিত করে। আমার ধারণা, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার মতো জাতীয়াতাবাদী উপাদানগুলো, শিক্ষা থেকে বিলুপ্ত করা গেলে, শিশুরা আরও বড় হৃদয় নিয়ে বেড়ে উঠতে পারবে। কারণ জাতীয়তাবাদ, শিশুদের হৃদয়ের চারপাশে একটি বেড়া নির্মাণ করে দেয়। এ বেড়া, শিশুটি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখনও থাকে, যদি না সে পর্যাপ্ত পড়াশোনো ও উপলব্দি দ্বারা, বেড়াটিকে উৎপাটন করতে পারে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা পৃথিবী, আর প্রকৃত পৃথিবী এক নয়। আমি শিশুদের বেড়ার ভেতরে রাখার বিরোধী।
তবে দেশপ্রেম শেখাতে, জাতীয় সঙ্গীত সবদেশে সমান সফলতা অর্জন করে না। অনেক দেশেই এটি জন্ম দেয় ছদ্মদেশপ্রেমের। এ প্রসঙ্গে আমি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের কথা বলতে চাই। গানটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরে বাউল গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানের সুর ধার করে এটিকে পরিণত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে। যদিও রবীন্দ্রনাথ যা সৃষ্টি করেছিলেন তার পুরোটা নেয়া হয় নি, নেয়া হয়েছে শুধু প্রথম দশ লাইন। গানটির শুরু এভাবে—
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”
একটি শিশু যখন এ লাইনটি গায়, তখন সে এমন একটি দেশ কল্পনা করে, যেটি সোনা দিয়ে তৈরি অথবা দেখতে সোনার মতো। এখানে মনে রাখা ভালো যে, সোনা একটি মূল্যবান ধাতব পদার্থ। সহজলভ্য ধাতুগুলোর মধ্যে সোনাই শ্রেষ্ঠ, এ খবর কিন্তু শিশুরা, তাদের মায়ের গহনাগুলো দেখে শিখে যায়। তারা জানে, তাদের মা লোহার কোনো জিনিস তালা মেরে রাখেন না, শুধু সোনার তৈরি জিনিসগুলোই খুব সাবধানে রাখেন। নানা পরিবারে, বিয়েতে সোনা নিয়ে ঝগড়াঝাটিও সে প্রত্যক্ষ করেছে। ফলে ‘আমার সোনার বাংলা’ বাক্যটিকে, সে হেঁয়ালির মতো অনুবাদ না করে, অনুবাদ করে তার নিজস্ব বোধশক্তি দ্বারা। বুড়োদের বোধশক্তির সাথে এ বোধশক্তি মিলবে না।
শিশুটি কল্পনা করে, যে-দেশটি সোনার মতো মূল্যবান ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি, বা যে-দেশটির সম্মান বিশ্ব দরবারে সোনার মতো গুরুত্বপূর্ণ, সে-দেশের মানুষের চরিত্র নিশ্চয়ই সোনার মতো নিখাদ। তারা নিশ্চয়ই যাপন করে সোনার মতো নিষ্কলুষ জীবন। তাদের রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিশ্চয়ই সোনাতুল্য। তাদের সরকারি অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা নিশ্চয়ই গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড।
আরও পড়ুনঃ প্রশ্নের শক্তিতে শক্তিমান একজন আরজ আলী মাতুব্বর
তবে শিশুটি রবীন্দ্রনাথের গানের রূপকল্প বুঝতে পারে না। সে প্রেমে পড়ে যায় ওই সোনার দেশটির, আর ভালোও বাসতে শুরু করে গানের ওই কাল্পনিক সোনার দেশটিকেই। কিন্তু দ্রুতই শিশুটির ভুল ভাঙে। সে তার কল্পনার সোনার বাংলার সাথে বাস্তব বাংলার কোনো মিল খুঁজে পায় না। ফলে তার পক্ষে আর বাস্তব দেশটিকে ভালোবাসাও সম্ভব হয় না। সে হয়ে উঠে ছদ্মদেশপ্রেমী, তার সমস্ত প্রেম জমা থাকে জাতীয় সঙ্গীতের ওই সোনার বাংলাটির জন্যে, যার দেখা সে কখনো পায় না। সম্প্রতি কিছু ব্যক্তি, তাদের কাল্পনিক সোনার বাংলাগুলোতে, যেমন কানাডায়, সম্পদ পাচার করে ঘরবাড়ি করেছেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আক্ষেপ করেছেন।
যদি ইশকুলে, সৎভাবে শিশুটির কাছে ব্যাখ্যা করা হতো যে রবীন্দ্রনাথের গানটি শুধুই গান, বাস্তবতার সাথে এর কোনো মিল নেই, তাহলে সে অঙ্কুর থেকেই একটি প্রস্তুতি নিয়ে বড় হতো। তার মধ্যে ছদ্ম নয়, আসল দেশপ্রেমই জন্ম নিতো। শৈশবেই সে জানতে পারতো, কী কী বাধা ও ক্ষুধা তার জন্য সামনে অপেক্ষা করছে। বাঁচার জন্য তাকে কতোটা পরিশ্রম করতে হবে, কী কী কলাকৌশল ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে, তা শিশুকালেই সে জানতে পারতো। এতে উৎপাদন বাড়তো, অলস ও অকর্মণ্য জনসংখ্যা কমতো, এবং হ্রাস পেতো অপরাধ ও দুর্নীতি।
আরও পড়ুনঃ সরদার ফজলুল করিম : আমাদের কালের বাতিঘর
জাতীয় সঙ্গীত এক প্রকার কাল্পনিক আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তাও সৃষ্টি করে। যার ফলে, উস্কে উঠে অস্ত্র প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার মর্মে থাকে, কে কতো ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র বানাতে পারবে। এ প্রক্রিয়ায় মানুষ খুনের বিস্তৃতি ও স্বাভাবিকীকরণ ঘটে, এবং কার কতো অস্ত্র আছে, এটি দিয়ে নির্ধারিত হতে শুরু করে রাষ্ট্রগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব। উদ্ভাবিত হতে থাকে অপ্রয়োজনীয় বহু প্রযুক্তি। বিশ্বে বহু রাষ্ট্র আছে যাদের অন্য রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হবার কোনো সম্ভাবনা নেই, অথবা আক্রান্ত হলেও পরমাণু অস্ত্রের মুখে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে দশ মিনিটে; কিন্তু তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয়, কৃষি, শিক্ষা, কল্যাণকর গবেষণা, ও স্বাস্থ্য খাত থেকে বেশি।
আমার প্রস্তাব হলো, ইশকুলে যদি শিশুদের কোনো গান বা সঙ্গীত গাইতেই হয়, তাহলে সেটিকে স্বতঃস্ফূর্ত হতে হবে। গানটি গাইতে তাদের বাধ্য করা যাবে না। জাতীয়তাবাদী চেতনার বদলে, তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে, গানটিতে কী কী সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। কোনো গানে যদি সৌন্দর্যের বর্ণনা থাকে, তাহলে সে-বর্ণনাটিকে সৎ হতে হবে। সৌন্দর্যের অসৎ বর্ণনা শিশুদের সামনে উপস্থাপন করা ঠিক হবে না। গানটি যদি রূপকথা হয়, তাহলে সেটি যে রূপকথা, এ ব্যাপারটি শিশুদের ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হবে, যেন কোনো শিশু, রূপকথাকে বাস্তব হিশেবে বিবেচনা না করে। কোনো নির্দিষ্ট দেশকে নয়, শিশুরা যেন তার চারপাশের প্রকৃতিকে ভালোবাসতে পারে, এ ব্যাপারে জোর দিতে হবে। যার ভেতরে প্রকৃতিপ্রেম আছে, দেশপ্রেম তার ভেতর এমনিতেই থাকে, যদিও ওই দেশপ্রেমের স্বরূপ থাকে আলাদা। এটি ধ্বংসাত্মক না হয়ে, হয়ে উঠে সৃষ্টিশীল।
তারপর পড়ুনঃ দার্শনিক ভাষণ | বিষয়: শিক্ষা | দ্বিতীয় পর্ব
লিখেছেনঃ মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার