Skip to content
Home » অন্ধকার ও মানুষের প্রশংসা | দ্বিতীয় পর্ব | মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

অন্ধকার ও মানুষের প্রশংসা | দ্বিতীয় পর্ব | মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

    পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ human
    Redirect Ads

    আগে পড়ুনঃ অন্ধকার ও মানুষের প্রশংসা | প্রথম পর্ব

    মানুষ উন্মাদও বটে, এবং মানুষের উন্মত্ততার একটি চমৎকার গোষ্ঠিবদ্ধতা আছে। বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন যখন বজ্রনিরোধক দন্ড তৈরি করলেন, তখন খ্রিস্টান হুজুরেরা ঘোষণা দিলো:
    এটি ঈশ্বর-বিরোধী কাজ।

    Download

    তাদের দাবি, ঈশ্বর ঠাডা বা বজ্রপাত পাঠান শয়তান ও পাপীদের শায়েস্তা করার জন্যে। বেঞ্জামিন ফ্রাংলিন ঈশ্বরের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন। বজ্রপাত কখনো ভালো মানুষকে আঘাত করে না।

    ২০২০ সালে এ বক্তব্য হাস্যকর মনে হলেও তখন তা মোটেও হাস্যকর ছিলো না। রাজা তৃতীয় জর্জ এ বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন।

    একটি লোহার দন্ডও ঈশ্বরের কাজে বিঘ্ন ঘটানোর ক্ষমতা রাখে, এর চেয়ে বড় ঈশ্বর-বিরোধী কথা আর হয় না। বেঞ্জামিনের দন্ডের তো সর্বশক্তিমান হবার কথা নয়। তবে উন্মাদেরা এটি বুঝতে নারাজ। তাদের ধারণা, এই লোহার দন্ড ঈশ্বরের চেয়েও অধিক শক্তিশালী।

    খ্রিস্টান হুজুরেরা এখন নেই, কিন্তু তাদের উত্তরসূরীরা আছেন। কিছুদিন আগে, একটি দেশের রাজধানীতে আমরা তাদের দেখা পেয়েছিলাম। একটি প্রেসক্লাবের সামনে তারা জড়ো হয়েছিলো, এবং আমাদের আশ্বস্থ করেছিলো যে-
    ইসলামে ছোঁয়াচে কোনো রোগ নেই।

    Download

    একজন ইমামের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো, যার দাবি— করোনা এসেছে অমুসলিমদের জন্য, যদিও আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন বিশ্বে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে।
    বজ্রপাত ধার্মিকদের জন্য নয়, খ্রিস্টান চার্চের এ বক্তব্যের সাথে উপরের ওই ইমামের বক্তব্যের মিল আছে।

    ব্যাপারটি শুধু আধুনিকতা বা শিক্ষা-দীক্ষার নয়। আধুনিক শিক্ষা পেয়েও কেউ কেউ এমন আচরণ করতে পারেন। ভারতে একবার কয়েকটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিলো, এবং একজন বিখ্যাত ব্যারিস্টার তাঁর সতীর্থদের সতর্ক করেছিলেন যে—
    এই ভূমিকম্প তোমাদের পাপের শাস্তি হিশেবে পাঠানো হয়েছে।
    মিডলটেম্পলের ওই ব্যারিস্টারকে আপনারা চেনেন, নাম মহাত্মা গান্ধী।

    অনেক দেশে ‘পাপের শাস্তি’ কুসংস্কারটি বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে কারও বড় অসুখ হলে, প্রতিবেশীরা এটিকে ধরে নেন ‘আল্লাহর বিচার’। বড় দুর্ঘটনা ও বিপদাপদের ক্ষেত্রেও এমনটি ধরে নেয়া হয়, যদিও সদ্য জন্ম নেয়া অনেক শিশুকে আমি বড় অসুখ, ও দুর্ঘটনায় মারা যেতে দেখেছি।

    একবার এক লোক খুন হলো। খুনীর কোনো হদিস পাওয়া গেলো না। পরিবারের লোকজন থানায় মামলা করলো, মামলায় আসামী করা হলো গ্রামের সমস্ত পুরুষকে। কিছুদিন পর এক আসামীর মেয়ে, শ্বশুর বাড়ি থেকে ফেরার সময় বাসের চাপায় নিহত হয়। সবাই ধরে নিলো যে ওই আসামীই খুনী, না হলে তার মেয়ে মারা যাবে কেন? বাদী পক্ষ পুলিশকেও এ বক্তব্য বিশ্বাস করেয়েছিলো, এবং লোকটিকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছিলো (পুলিশ অবশ্য লোকটির কোনো সম্পৃক্ততা পায় নি)।

    Download

    আরেকজনকে চিনি, যার এক মেয়ে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলো। লোকটি ধানের ব্যবসা করতো। যে-মানুষেরা মেয়েটির লাশ দেখে হায়-আফসোস করলো, তারাই গ্রামে রটিয়ে দিলো, ফজলু মিয়ার ধানের পাল্লায় ভেজাল আছে, তার ব্যবসা হালাল না, এজন্যই তার মেয়ে পানিতে ডুবে মরছে। আল্লাহ কাকে কোন দিক দিয়ে ঘুরিয়ে মারে, তা বলা যায় না।

    ধরে নিলাম ফজলু মিয়া (ছদ্মনাম ব্যবহার করছি, তার আসল নাম অন্য) সত্যি সত্যি ধান মাপার সময় পাঁচ কেজির বদলে সোয়া পাঁচ কেজি নেন, কিন্তু কোনো বোধসম্পন্ন ঈশ্বরের পক্ষে কি তার পাপের শাস্তি তার মেয়েকে দিতে পারেন? পারেন না। কিন্তু পাগলপার্টি বুঝাতে চায়, ঈশ্বরও বুঝি তাদের মতোই কম আক্কেলসম্পন্ন। থিওলোজিক্যাল ফিলোসোপিতে একটি প্রপোজিশন আছে এরকম:
    কোনো গাধাকে যদি তার ঈশ্বর সম্পর্কে বলতে বলা হয়, তাহলে সে একটি গাধার বর্ণনাই করবে। তার ধারণা, তার ঈশ্বরও নিশ্চয়ই গাধা।

    পাগলামোকে একসময় বলা হতো জ্বিনে ধরা। কেউ অসংলগ্ন আচরণ করলে ধরে নেয়া হতো তাকে জ্বিন আছর করেছে। মানুষ এর একটি চিকিৎসাও আবিষ্কার করেছিলো, এবং এ আবিষ্কারের ভিত্তি ছিলো বিশ্বাস। এলাকাভেদে চিকিৎসাটি নানা রকম হলেও মোটামুটি এরকম—
    যাকে জ্বিনে ধরেছে তাকে পেটাতে হবে। এই আঘাত রোগীর শরীরে লাগবে না, লাগবে জ্বিনের শরীরে, এবং মার খেয়ে জ্বিন পালিয়ে যাবে।

    তবে আমি দেখেছি উল্টো। মারের আঘাত রোগীর শরীরেই লাগে, এবং প্রাণ যাওয়ার সময় রোগীর প্রাণই যায়। মার খেয়ে রোগীর বদলে জ্বিনের মৃত্যু হয়েছে, এরকমটি কখনও শুনি নি।
    পাগল চিকিৎসার এ পদ্ধতি এখনো চালু আছে। কিছুদিন আগে, ফেনীর ফুলগাজীতে এক জ্বিন হুজুর, নাম শহিদুল্লা, এ চিকিৎসা দিয়ে একজনকে বেহেশতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
    রাজা তৃতীয় জর্জ যখন পাগল হয়েছিলেন তখন তাঁর উপরও এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিলো, এবং ফলাফল ছিলো ফুলগাজীর মতোই। তবে রোগীটি একজন রাজা হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁর গায়ে, আমার ধারণা, খুব সাবধানে হাত উঠানো হয়েছিলো।

    Download

    জ্বিন ধর্ষণও করে। আমি একটি মেয়েকে চিনি, যে একরাতে উঠোনে প্রস্রাব করতে গিয়ে আর ফেরত আসে নি। তার বদনাটি ঘরের কাছে পাওয়া গেলেও, শরীর পাওয়া গিয়েছিলো অনেক দূরে, এক ধান ক্ষেতের আইলে। বিবস্ত্র; সারা গায়ে থুথু, লালা, ও ঘাসের ভাঙা ডগা।
    মেয়েটির বাবা-মার দাবি ছিলো—
    জ্বিন মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গেছে। সুন্দর মেয়েদের উপর জ্বিনের নজর থাকে, এবং একা পেলেই তুলে নিয়ে যায়।

    মেয়েটির মা যখন মেয়েটিকে নিয়ে কবিরাজের কাছে গেলো, তখন কবিরাজের বক্তব্য ছিলো—
    মেয়েটি অপবিত্র হয়ে গেছে। তাকে পবিত্র করতে হবে। এজন্য সাত দিন সাত রাত সে এখানে থাকবে। আপনি বাড়ি চলে যান, সাতদিন পর এসে মেয়েকে নিয়ে যাবেন।
    আমি জানি না, এ সাত দিন সাত রাতে মেয়েটি আরও জ্বিনের দেখা পেয়েছিলো কি না।
    সম্প্রতি সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজে, জ্বিনেরা একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। তবে দিনের বেলা হওয়ায় জ্বিনদের আমরা দেখে ফেলি, এবং ধরিয়ে দিই পুলিশে। পুলিশ আমাদের জানিয়েছে যে, এরা মোটেও জ্বিন নয়, মানুষ।

    এ কুসংস্কারগুলোর জন্ম, অন্য সকল কুসংস্কারের মতোই, ভয় থেকে। মানুষ যখন ভয় পায় তখন সে তার সুবিধাজনক কিছু বিশ্বাস তৈরি করে। এ ভয় প্রাণ হারানোর হতে পারে, ক্ষমতা হারানোর হতে পারে, ফসল হারানোর হতে পারে, সম্মান হারানোর হতে পারে; এবং হারানোর বদলে প্রাপ্তিরও হতে পারে, যেমন খ্রিস্টান নানরা ঐশ্বরিক শাস্তির ভয়ে, শাস্তি এক প্রকার প্রাপ্তি, গোসলের সময়ও সম্পূর্ণ বোরকা পরে থাকেন। তাদের দাবি—
    বাথরুমে আমাদের আর কেউ না দেখলেও ঈশ্বর দেখেন।
    তারা বুঝাতে চান যে, ঈশ্বর বাথরুমের দেয়াল ভেদ করতে পারলেও বোরকার কাপড়ের দেয়াল ভেদ করতে পারেন না।

    মানুষের বিবেচনাবোধও উন্নত নয়, এবং প্রাণী হিশেবে, পৃথিবীতে সে-ই সবচেয়ে হিংস্র। অন্য সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে ‘পাশবিক’ শব্দটি ব্যবহার করা হলেও মানুষ তার হিংস্রতাকে আলাদা করতে ব্যবহার করে ‘মানবিক’ শব্দটি। মানুষ যে মানবিক তার প্রমাণ আমরা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পেয়েছি, এবং হিটলার ইহুদিদের প্রতি যে-মানবিকতা দেখিয়েছিলেন তা তুলনাহীন হলেও, লেলিন, স্তালিন, ও মা সে তুং, আমার ধারণা হিটলারের মানবিকতার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।

    মানুষের যা ইতিহাস তা মোটামুটি হিংস্রতারই ইতিহাস, এবং তার হিংস্র প্রবৃত্তি বিলুপ্ত হবার নয়। মানুষের সবচেয়ে জরুরী বিজ্ঞানটিও, যাকে আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞান বলি, দাঁড়িয়ে আছে ব্যাঙ, ইঁদুর, গিনিপিগ, ও বানরের লাশের উপর। মানুষের বয়স, বলা যায় মোটামুটি পঁচিশ লাখ বছর, কিন্তু সে কৃষিকাজ শুরু করেছে মাত্র দশ হাজার বছর আগে। তার আগে সে বনের অন্য প্রাণীদের মতোই বুনো ছিলো, এবং বনে হেঁটে যা বুঝেছি তা হলো— সারাক্ষণ ওখানে খুন-খারাবি লেগেই থাকে। ঈগল ছো মেরে যখন বানরকে নিয়ে যায়, আর হরিণ যখন বাঘের মুখে ত্যানার মতো ঝুলে থাকে, তখন বনের সৌন্দর্য কদাকার হয়ে ওঠে।

    প্রকৃতিতে কোনো প্রাণী টিকে থাকবে কি না, তা নির্ধারিত হয় প্রাণীটির হিংস্রতা দ্বারা। প্রশ্ন উঠতে পারে, টিকে থাকার জন্য কতোখানি হিংস্রতা জরুরী? একটি উদাহরণ থেকে এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে—
    প্যারাগুয়ের জঙ্গলে আশেই নামে একটি আদিবাসী গোষ্ঠী ছিলো (এখনও আছে)। আশেইরা ছিলো ফরেইজার। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে, এরা প্রকৃতি থেকে সরাসরি খাবার সংগ্রহ করতো, এবং এভাবেই বাঁচতো।

    Download

    আর্মাডিলো, হরিণ, বানর, লিজার্ড, ও তাপির ছিলো এদের প্রিয় শিকার। তবে শিকারের পাশাপাশি এরা পাম গাছের বুকুইল, পোকামাকড়ের লার্ভা, এবং মধুও সংগ্রহ করতো।
    আশেইদের একটি নিয়ম ছিলো এরকম:
    কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসতে হবে, অথবা হত্যা করতে হবে। বৃদ্ধ নারীদের ক্ষেত্রে, যারা বোঝা হয়ে উঠতো পরিবারের, তাদের জন্য নিয়মটি ছিলো একটু আলাদা। দলের একজন তরুণ সদস্য, একটি নির্ধারিত দিনে, ধারালো কুঠার নিয়ে ওই বৃদ্ধাকে পেছন থেকে অনুসরণ করবেন, এবং মাথায় হঠাৎ এক কোপ দিয়ে শেষ করে দেবেন।
    নৃবিজ্ঞানীরা এমন একজন আশেইর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, যার কাজ ছিলো শুধু তার বৃদ্ধা চাচী ও খালাদের হত্যা করা।

    এর কারণ কী? এর কারণ ছিলো আশেইদের কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিলো না। তাদের কোনো প্রাসাদ ছিলো না। গাড়ি ছিলো না। তারা প্রকৃতির সাথে প্রতিযোগিতা করে বাঁচতো। নিজের খাবার নিজে সংগ্রহ করতো। এক জায়গায় অনেকদিন থাকতো না। খাবারের খোঁজে তারা জঙ্গলে জঙ্গলে তাঁবু ফেলতো। কেউ বয়স অথবা অসুখের কারণে বোঝা হয়ে উঠলে, তাকে পরিত্যাগ ও হত্যা করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প থাকতো না।

    বাংলাদেশে যখন প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়, তখন আশেইদের মতোই একটি ঘটনা দেশটির টাঙ্গাইল জেলায় ঘটেছিলো। দরিদ্র এক বৃদ্ধাকে তার দরিদ্র স্বজন ও সন্তানেরা জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসেছিলো। তাদের আশংকা ছিলো—
    বৃদ্ধাটির করোনা হয়েছে, এবং সে বাঁচবে না। উল্টো তাকে ঘরে রাখলে, আমাদেরও করোনা হবে, আর করোনা হলে, আমরাও বাঁচবো না। করোনা হলে কেউ বাঁচবে না, এটি তারা শুনেছিলো নানা সেনসেশোনাল মিডিয়া কন্টেন্ট থেকে। এজন্য আমি সবসময়, মিডিয়ার কথা মানুষকে খুব সাবধানে আমলে নিতে বলি।

    জঙ্গলে শিকার করে, ‘শিকার’ খুব ভদ্র শোনায়, খুন করে, মানুষ যে-আনন্দ পেতো তা কৃষিকাজ ও ব্যবসা করে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে খুনের যে-আনন্দ ও বাসনা, তা মানুষের জিনে এখনো লুকিয়ে আছে। সুযোগ পেলেই মানুষ ওই বাসনা চরিতার্থ করতে চায়। কিন্তু সরাসরি খুনের সুযোগ সীমিত হওয়ায়, তারা খুনের আনন্দ অন্যভাবে নিচ্ছে।
    খুন করার লাইসেন্স যাদের আছে তাদের দিয়েই খুন করিয়ে মানুষ ওই আনন্দ উপভোগ করছে। চারদিকে যে ফাঁসির দাবি, পাথর ছুঁড়ে হত্যার দাবি, ক্রসফায়ারের দাবি, হাত কেটে ফেলার দাবি, ফায়ারিং স্কোয়াডের দাবি, চোখ তুলে ফেলার দাবি, খোজা করে দেয়ার দাবি, এবং আরও অনেক নিষ্ঠুর দাবির কথা শোনা যায়— তা মানুষের জিনে লুকিয়ে থাকা ওই খুনি-প্রবৃত্তিকেই প্রমাণ করে।

    যাত্রাবাড়ীতে যে-নারীটিকে, যিনি তার সন্তানদের ইশকুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন, ছেলেধরা সন্দেহে আমরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছিলাম, তার মূল কারণ ছিলো খুনের আনন্দ লাভ।

    একজন স্পেনিশকে আমি জিগ্যেস করেছিলাম— একটি গরুর সাথে যুদ্ধ করে তোমরা কী মজা পাও? হোয়াট দা হেল ইজ আ বুল ফাইট? তার উত্তর ছিলো— দেখো, যুদ্ধ শেষে আমরা কিন্তু গরুটিকে খুনও করি, এবং ওইটিই আসল আনন্দ। মানুষ হয় নিজে খুন করতে চায়, অথবা অন্যকে দিয়ে খুন করাতে চায়। তবে এর কোনোটিরই সুযোগ না পেলে, সে কোথাও বসে একটি খুনের দৃশ্য উপভোগ করতে চায়।

    Download

    পৃথিবীতে যে-কম্পিউটার গেমগুলো আছে, তার অধিকাংশই যুদ্ধ ও খুনোখুনির গেম। গেমগুলো শিশু ও কিশোরদের কাছে এতো জনপ্রিয় কেন? এর কারণও সম্ভবত, তাদের জিনে লুকিয়ে থাকা খুনি প্রবৃত্তি। আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে, খুনোখুনি করার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রয়েছে। মানুষের দাবি, তারা সভ্যতার চরম শিখরে অবস্থান করছে। কিন্তু এটি আমার বুঝে আসে না, সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছেও কেন তারা এ খুনোখুনির প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রেখেছে? কেন কোনো রাষ্ট্রই উদ্যোগ গ্রহণ করছে না, কীভাবে খুনের সরঞ্জামগুলোকে ধ্বংস করা যায়? উল্টো যাদের খুন করা হবে তাদের টাকায়, রাষ্ট্রগুলো নতুন নতুন খুনের সরঞ্জাম কিনছে। সভ্যতা ও খুনোখুনি, এ দুটি কি একসাথে যায়? না কি মানুষের সভ্যতা, মূলত খুনোখুনির সভ্যতা? তার অন্য সকল অর্জন কি খুনোখুনির বাইপ্রোডাক্ট? আমার ধারণা, এর উত্তর আমরা সকলেই জানি, কিন্তু স্বীকার করি না।

    প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই গোঁড়া। সে আমৃত্যু কিছু বিশ্বাসের দাস হয়ে থাকতে পছন্দ করে। এ বিশ্বাস রাজনীতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনীতিক, যেকোনো ধরণের হতে পারে। খুব কম মানুষই, তার নিজের বিশ্বাসের বাহিরে এসে, যুক্তির মানদন্ডে কোনোকিছুকে গ্রহণ অথবা বাতিল করতে পারে।

    মস্তু নামে একজন আমাকে একবার তার পীরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। মস্তুর বিশ্বাস, একমাত্র তার পীরের মুরিদেরাই বেহেশতে যাবে, এবং বেহেশতে যাওয়ার জন্য কেবল নামাজ পড়াই যথেষ্ট নয়। আমি বললাম, তুমি পৃথিবীতে এতো কষ্টে আছো কেন?
    পৃথিবীতে যারা কষ্টে থাকে, পরকালে তাদের হিশাব-নিকাশ সহজ হয়, তারা দ্রুত বেহেশতে যাবে, মস্তু বলে।
    তোমার পীর তো কষ্টে নেই, পাকা ঘরে থাকে, এসি গাড়িতে করে ঢাকা যায়, তিনি কি বেহেশতে যাবেন না? আমি বলি।

    তিনি মুর্শিদ, তার হিশাব আলাদা, আমি পাপী, আমার হিশাব কঠিন, মস্তু বলে।
    মস্তুর পীরকে আমার জ্ঞানী কেউ মনে হয় নি। আল্লাহ, মস্তুর ধারণা, হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করেন। তা না হলে মুর্শিদের (ব্রাহ্মণের) হিশাব আলাদা, এ কথা তার বলার কথা নয়।
    মস্তুর ব্যাপারে, আমার অভিমত হলো— সে গোঁড়া। তার পীরের বিরুদ্ধে যায়, এমন সব কথাকেই সে ফালতু মনে করে। পীর যদি মস্তুর স্ত্রীকে ধর্ষণ করে এসে বলে যে কাজটি তিনি মস্তুর মঙ্গলের জন্যই করেছেন, তাহলে মস্তু কোনো উচ্চবাচ্য করবে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই রাজনীতিক ও ক্ষমতাবানেরা, নাগরিকদের মঙ্গলের নামে এমন কাজ করে থাকেন, এবং তাদের অনুসারীদের ধারণা— স্যার যা করেন ভালোর জন্যই করেন।

    লিখেছেনঃ মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

    ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

    Download

    বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত

    Facebook Comments
    Tags:
    x
    error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করুন