Skip to content
Home » বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : মাক্সিম গোর্কি | শেষ পর্ব | Maxim Gorky Bangla PDF

বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : মাক্সিম গোর্কি | শেষ পর্ব | Maxim Gorky Bangla PDF

    ম্যাক্সিম গোর্কির বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ মা বই জীবনী pdf
    Redirect Ads

    আগে পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : মাক্সিম গোর্কি | প্রথম পর্ব

    রাশিয়ার অধিকাংশ সাহিত্যই সোশ্যাল রিয়ালিজমের সাহিত্য। এর কারণ রাশিয়াতে, রাজনীতিক ও অর্থনীতিক পীড়নের শিকার হয়েছে, এমন মানুষের সংখ্যাই একসময় বেশি ছিলো। যেহেতু গোর্কি ছিলেন স্বশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞতা-নির্ভর লেখক, সেহেতু সোশ্যাল রিয়ালিজমের বাহিরে তাঁর পদচারণা সীমিত ছিলো। রবীন্দ্রনাথ যদি জমিদার না হয়ে ক্ষমতাহীন শ্রেণীর মানুষ হতেন, তাহলে তাঁর কবিতায় হয়তো রোম্যান্টিসিজমের উপস্থিতি থাকতো না। তাঁকেও তখন লিখতে হতো নজরুলের মতো সোশ্যাল রিয়ালিজমের কবিতা।

    Download

    একটি বিষয় এখানে বলতে হয়। আমি বাংলাদেশের বহু মানুষকে দেখেছি, যারা রোম্যান্টিক শব্দটি দিয়ে প্রেম-ভালোবাসা বুঝেন। কিন্তু ব্যাপারটি সেরকম নয়। রোম্যান্টিসিজম সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপে এ ধারার উত্থান ঘটে। এ ধারায় মানুষের আবেগ, ভয়, ভাব, দুশ্চিন্তা, অতীত বন্দনা, প্রকৃতি-প্রেম, ইত্যাদির প্রাধান্য থাকে। গ্যেটে, শিলার, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, কিটস, বায়রন, শেলি, ম্যারি শেলি, ব্লেইক, ক্লেয়ার, এবং আরও অনেক ইউরোপীয় লেখকের লেখায় এ ধারার উপস্থিতি পাওয়া যায়। আমাদের বাংলা ভাষায়, এ ধারার সবচেয়ে বড় কবি রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর রোম্যান্টিসিজমে, জালালুদ্দিন রুমির আধ্যাত্মিকতাকেও মিশিয়েছেন, এবং তৈরি করেছেন তাঁর একটি নিজস্ব স্টাইল। এরকম সংকর স্টাইল আমি আল্লামা ইকবালের কবিতায়ও লক্ষ করেছি। আমাদের লালনের গানগুলোতেও রুমি ধাঁচের হাবভাব রয়েছে। তবে রোম্যান্টিক ধাঁচের উপন্যাস বাংলা ভাষায় খুব একটা একটা নেই।

    সোশ্যাল রিয়ালিজম সম্পর্কেও একটু বলা প্রয়োজন মনে করছি। কারণ কেউ কেউ এ বিষয়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন। সোস্যাল রিয়ালিজম হলো শিল্প-সাহিত্যের এমন একটি ধারা, যা দিয়ে কোনো সমাজের শ্রমিক বা ক্ষমতাহীন শ্রেণীর মানুষদের, রাজনীতিক ও অর্থনীতিক অবস্থাটিকে তুলে ধরা হয়, এবং তাদের সাথে সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণীর যে-সংঘাত, তার বাস্তবিক বা রূপক চিত্রকল্প আঁকা হয়। বাংলাদেশে একসময় যে তীব্র রাজনীতিক কার্টুন আঁকা হতো, তা কিন্তু সোশ্যাল রিয়ালিজমের চর্চা ছিলো। বাংলা ভাষায় অনেকেই এ ধারার সাহিত্য, বিশেষ করে প্রবন্ধ, লিখেছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন, সম্ভবত হুমায়ুন আজাদ। তাঁর ‘নরকে অনন্ত ঋতু’, ‘জলপাই রঙের অন্ধকার’, ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’, ‘মাতাল তরণী, ‘নিবিড় নীলিমা’, ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’, ‘রাজনীতিবিদগণ’, এবং ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, বাংলা ভাষায় সোশ্যাল রিয়ালিজমের গুরুত্বপূর্ণ বই। আবদুল গণি হাজারীর ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’, শহীদ কাদরির ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট’, কাজী নজরুলের ‘সর্বহারা’, হুমায়ুন আজাদের ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ ও ‘গোলামের গর্ভধারিণী’, ফরহাদ মজহারের ‘কর্তৃত্ব গ্রহণ কর, নারী’, হেলাল হাফিজের ‘যার যেখানে জায়গা’, এবং মহিউদ্দিন মোহাম্মদের ‘মাংস নয়, হাড়ের মুক্তি চাই’, এগুলো সোশ্যাল রিয়ালিজম ধারার কবিতা। আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’-ও এ ধারার উপন্যাস।

    গোর্কি সোশ্যাল রিয়ালিজম দ্বারা এতোই ঢাকা ছিলেন যে, তাঁর প্রায় সবগুলো নাটক, গল্প, ও উপন্যাস এ ধারায় রচিত হয়েছিলো। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ ধারা রাশিয়ায় এতো জনপ্রিয় হয়েছিলো কেন? এর উত্তর বলশেভিক পার্টির উত্থানেই পাওয়া যেতে পারে। জারিস্ট রিজিমগুলোর দমন-পীড়নই এ ধারাকে জনপ্রিয় করেছিলো। মানুষ এ ধারায়, তাদের ভেতরে জমা কথাগুলোর একটি ঝর্ণা খুঁজে পেয়েছিলো।

    কিন্তু গোর্কির নাটকগুলো, বিশেষ করে পেটি বুর্জোয়া নাটকটি, মধ্যবিত্তদের একটি বড় চরিত্রও উদঘাটন করেছিলো। অনেক মধ্যবিত্ত নাটকটিকে পছন্দ করে নি। না করারই কথা। মধ্যবিত্তরা যে সমাজের সবচেয়ে আত্মপ্রসাদগ্রস্ত ও স্বার্থপর শ্রেণী, এ সত্যটিই গোর্কি উচ্চারণ করেছিলেন। কোনো সমাজে ফ্যাসিবাদ, এ শ্রেণীর ঘাড়ে ভর করেই টিকে থাকে। এরা প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেণী নয়, আবার পুঁজিবাদী উচ্চবিত্তও নয়। এরা মধ্যবিত্ত। মার্ক্স তাঁর ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্তো’-তে, এদেরকে ছোট পুঁজিবাদী হিশেবে উল্লেখ করেছিলেন।

    Download

    চেখভ মন্তব্য করেছিলেন, নাটকের শিল্পমান বিবেচনা করলে, ‘পেটি বুর্জোয়া’ আহামরি কোনো সৃষ্টি নয়, কিন্তু এর প্লট খুবই আহামরি। মধ্যবিত্তদের এ আঘাত প্রাপ্য ছিলো।

    তবে নাট্যকার হিশেবে গোর্কি তাঁর পরিণত রূপ দেখিয়েছিলেন ‘দি লোয়ার ডেপথ’ নাটকে। এর কারণ সম্ভবত, চেখভের শেখানো কৌশল তিনি এ নাটকে প্রয়োগ করেছিলেন। একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। চেখভের নাটকগুলিতে যেখানে ধনী ও ক্ষমতাবান মানুষদের প্রাধান্য, সেখানে গোর্কিই সর্বপ্রথম কোনো রুশ নাটকে, পতিতা, চোর-চ্যাচ্ছর, ও শ্রমিকদেরকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নিয়ে এসেছেন। এটি শেক্সপিয়ারিয়ান নাটকের প্রভাব থেকে, রুশ নাট্যসাহিত্যকে মুক্ত করার প্রথম প্রয়াস ছিলো বলে মনে করি।

    আরও পড়ুনঃ ম্যাক্সিম গোর্কির আত্মজীবনী আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পথে, পৃথিবীর পাঠশালায় PDF

    তিনি আরও দশ-বারোটি নাটক লিখেছেন, কিন্তু ওগুলো নিয়ে আমি আর আলোচনা করবো না। আমি চলে যাচ্ছি তাঁর (বিখ্যাত) উপন্যাস ‘মা’ প্রসঙ্গে। আমি বিখ্যাত শব্দটিকে বন্ধনীবদ্ধ করেছি, কারণ ‘মা’ মোটেও তাঁর কোনো বিখ্যাত উপন্যাস নয়। এটি বিখ্যাত উপন্যাস বাঙালিদের কাছে। আমি অনেকের সাথে কথা বলে দেখেছি, যারা উপন্যাসটি নিয়ে উচ্চবাচ্চ্য করে, তারা গোর্কির আর কোনো লেখা বা নাটক পড়ে নি। আমার ধারণা, যারা অন্তত তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস তিনটি পড়েছেন, তারা আমার কথার সাথে একমত পোষণ করবেন। তাঁর ‘দি চাইল্ডহুড’ অথবা ‘মাই ইউনিভার্সিটিজ’-এর কাছে ‘মা’ উপন্যাসকে আমার খাটো মনে হয়েছে (‘মাই ইউনিভার্সিটিজ’-কে কেউ কেউ বাংলায় ‘পৃথিবীর পাঠশালা’ নামে অনুবাদ করেছে)। তাঁর ‘দি লাইফ অব আ ইউজলেস ম্যান’ এবং ‘আ কনফেশান’-ও ‘মা’-এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস বলে মনে করি।

    Download

    ‘মা’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯০৬ সালে। প্রথমে ইংরেজি ভাষায়, পরে রুশ ভাষায়। এটি গোর্কির লেখা সবচেয়ে দীর্ঘ উপন্যাস (তলস্তয় বা দস্তয়েভস্কির মতো নয়)। সম্ভবত এ কারণেই অনেকে, এটিকে গোর্কির শ্রেষ্ঠ কাজ বলে ধরে নিয়েছে। হ্যাঁ, শ্রমজীবী মানুষদের বিপ্লবের কথা পড়লে মনে একটু আলোড়ন আসে, এটি অস্বীকার করা যাবে না, কিন্তু কোনো লেখার শিল্পমান আর আর রাজনীতিক গুরুত্ব এক জিনিস নয়। লেনিন এ উপন্যাসের প্রশংসা করেছিলেন নিজের স্বার্থের কারণে। এ উপন্যাস রুশ শ্রমিক শ্রেণীর মনে, সমাজবাদী বিপ্লবের একটি তাজা বীজ রোপণ করে দিয়েছিলো। এদিক থেকে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়।

    উপন্যাসটিকে বাংলায় জনপ্রিয় করেছিলো নজরুলের ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা। শ্রী নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে, ‘মা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো লাঙ্গলে। নজরুলের যে-রাজনীতিক চেতনা, তা মূলত রুশ বিপ্লবের চেতনা। নজরুল যখন সেনাবাহিনীতে ছিলেন, তখন নানা পত্রিকায় নিয়মিত রুশ বিপ্লবের খবর পড়তেন। গোর্কির লেখাও নজরুল, তখন থেকেই পড়তেন। তাঁর ‘সর্বহারা’, ‘শ্রমিকের গান’, ‘কৃষাণের গান’, ‘বিদ্রোহী’, ‘ধীবরদের গান’, এবং আরও অনেক কবিতায় রুশ বিপ্লব ও গোর্কির লেখার সরাসরি প্রভাব রয়েছে। ফেসবুকে এক নজরুলভক্তকে দেখলাম, সে না কি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় হুইটম্যানের প্রভাব খুঁজে পেয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ পড়লে না কি বুঝা যায়— নজরুল হুইটম্যান পড়েছিলেন। নজরুল অশিক্ষিত ছিলেন না, এটি প্রমাণ করতে ভক্তটি এ উদ্ভট কল্পনার আশ্রয় নিয়েছিলো। ওই ভক্ত হয়তো নিজেই হুইটম্যান পড়ে নি। পড়লে সে বুঝতো, হুইটম্যান তাঁর জীবদ্দশায় ‘বিদ্রোহী’ ধাঁচের তো নয়ই, এর কাছাকাছি ধাঁচেরও কোনো কবিতা লিখেন নি। বাংলাদেশের ফেসবুক যেহেতু গর্দভ দিয়ে ভরা, তাই অনেক গর্দভ নজরুল নিয়ে করা এ ভক্তের ভক্তিকে বিশ্বাস করেছিলো। নজরুল পড়াশোনো জানতেন, এটি প্রমাণ করতে কল্পনার আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন নেই। নজরুল যদি হুইটম্যান পড়েও থাকেন, তাহলেও এটা বলার অবকাশ নেই যে নজরুল হুইটম্যান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কারণ নজরুল ও হুইটম্যান, দুজনের পোয়েটিক স্টাইল ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা।

    প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘মা’ উপন্যাসটির নাম তাহলে এতো রটেছে কেনো? এর কারণ হলো এটি একটি প্রোপাগান্ডা উপন্যাস। গোর্কি এটি লিখেছিলেন বিশেষ রাজনীতিক উদ্দেশ্যে। ১৯০৫ সালের ব্যর্থ রুশ বিপ্লবের পর, তিনি যখন ১৯০৬ সালে আমেরিকা ভ্রমণে যান, তখন এটি লিখেছিলেন। বিপ্লবের প্রতি শ্রমিক শ্রেণীর হারানো উদ্যমকে জাগিয়ে তুলতেই তিনি এটি লিখেছিলেন। ফলে এটির প্রচারণার ভার গিয়ে পড়ে বিপ্লবী প্রোপাগান্ডিস্টদের হাতে। লিফলেটের মতো তারা এটিকে বিলিয়েছিলো। এ বিপ্লবীদের একটি শাখা ভারতীয় উপমহাদেশেও ছিলো, যাদের স্বপ্ন ছিলো ব্রিটিশরাজকে বিপ্লব দিয়ে হটানো। তারাই উপন্যাসটির নাম এ অঞ্চলে এভাবে রটিয়েছে। শুধু এ অঞ্চলে নয়, পৃথিবীর আরও নানা অঞ্চলে উপন্যাসটির নাম এভাবে রটেছে।

    আরও পড়ুনঃ মা উপন্যাস ম্যাক্সিম গোর্কি PDF রিভিউ

    Download

    রাশিয়ার প্রতিটি মা যেন তার সন্তানকে, পাভেল ভ্লাসোবের মতো করে গড়ে তোলেন এটিই ছিলো গোর্কির লক্ষ্য। নিলোভনা নামের যে-মা চরিত্রটি আছে, সেরকম শ্রমিক মা তখন রাশিয়ার ঘরে ঘরে ছিলো। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। গোর্কি প্রথমে পাভেলের ভেতর বিপ্লবের চেতনা সঞ্চার করেছেন, এবং পাভেলের বিপ্লবী বইপত্র দিয়ে পাভেলের মায়ের ভেতরও একই চেতনা পুঁতে দিয়েছেন। বইটি পড়ে যেন সাধারণ রুশদের ভেতরও এ চেতনা জাগে, এবং চেতনাটি কোনো সময় হারিয়ে গেলে তার পুনর্জাগরণও যেন ঘটে, তা নিশ্চিত করাই ছিলো ‘মা’ উপন্যাসের মতলব। গোর্কি চেয়েছিলেন, বিপ্লবের নিষিদ্ধ বইগুলো যেন নিলোভনার মতো রাশিয়ার অন্য মায়েরাও মানুষের মাঝে প্রচার করেন। এ বিপ্লব রুশ গণমানুষের জন্য, এবং গণমানুষকেই এ বিপ্লবে অংশ নিতে হবে, এটি প্রচার করাই ছিলো তাঁর এজেন্ডা।

    কিন্তু গোর্কির এ মার্ক্সবাদী এজেন্ডার সাহিত্যমূল্য খুব একটা নেই। গোর্কি ছাড়াও এ ধরণের প্রোপাগান্ডা রাশিয়ায় তখন অনেকেই লিখেছিলেন। পার্থক্য হলো, গোর্কি ছিলেন প্রতিষ্ঠিত লেখক, এবং লেনিনের ব্যক্তিগত বন্ধু। এজন্য গোর্কির প্রোপাগান্ডাটি মানুষ পড়েছে বেশি, প্রচারও পেয়েছে বেশি। এর লিটারারি মেরিট নিয়ে তখনকার রাশিয়ার অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলো। তবে একটি ব্যাপার আমি বলতে চাই। মার্ক্সবাদকে যে আর্টিস্টিক ইমেজ আকারেও উপস্থাপন করা যায়, তা সম্ভবত গোর্কিই প্রথম দেখিয়েছিলেন। কারণ সমাজের পীড়িত মানুষদের চরিত্রগুলো, গোর্কি খুব দরদ নিয়ে আঁকতে পারতেন। গোর্কির জনপ্রিয়তার মূলে, আমি মনে করি এটি একটি প্রধান কারণ।

    একটি প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকে প্রায়ই হতে হয়। রুশ সাহিত্যের সেরা লেখক কে? প্রশ্নটির সরল উত্তর দেয়া আমার জন্য কঠিন। অনেকে প্রশ্নটি আরও সরল করে করেন, ম্যাক্সিম (তারা মাক্সিমকে কী কারণে যেন ম্যাক্সিম ডাকেন) গোর্কিই কি রুশ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক? তাদেরকে বলতে চাই, আমার দস্তয়েভস্কি এবং তলস্তয় ভাষণ দুটি পড়লে, অন্তত এটি স্পষ্ট হবে যে গোর্কি মোটেও রুশ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক নন। তাঁকে স্থান দিতে হলে, অন্তত পুশকিন, গোগল, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, এবং শোলঝিনিতসিনের পরে স্থান দিতে হবে। কিন্তু অনেকেই নিজের অজ্ঞতাকে জ্ঞান হিশেবে জাহির করতে, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও টকশোতে, গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটির অতিরঞ্জিত প্রশংসা করে থাকেন। আশা করি তারা একটু সাবধান হবেন।

    আমি ভাষণটি আর লম্বা করবো না, শেষ করে দেবো। গোর্কির আর কোনো লেখা নিয়ে আমি আলোচনা করবো না, এবং কেন করবো না তার ইঙ্গিত ইতোমধ্যে দিয়েছি। তবে শেষ করার আগে কিছু কথা আমি বলতে চাই।

    আরও পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : ফিওদর দস্তয়েভস্কি | প্রথম পর্ব | Fyodor Dostoyevsky

    গোর্কি আজীবন প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। শুধুমাত্র অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি লেনিনের সাথে সম্পর্ক খারাপ করেছিলেন। স্তালিনের সাথেও তাঁর সম্পর্ক এ কারণেই খারাপ হয়েছিলো। স্তালিন যখন পশু হয়ে উঠেছিলেন (পশুরা আসলে এরকম হিংস্র নয়, পশুদের হিংস্রতার কথা মানুষ তার নিজের হিংস্রতা ডাকতে রটিয়েছে), তখন গোর্কি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। স্তালিনও তা বুঝতে পেরেছিলেন। এজন্য সার্জেই কিরোভকে খুন করার পর, স্তালিন গোর্কিকে গৃহবন্দী করেছিলেন। এমন কি স্তালিন, ইয়াগোদাকে দিয়ে (ইয়াগোদা ছিলেন স্তালিনের খুনি বাহিনী এনকেভিডি পুলিশের পরিচালক) গোর্কির ব্যাক্তিগত সেক্রেটারি পিওতোর ক্রিওশকোভকে চর হিশেবে ভাড়া করেছিলেন। যদিও স্তালিনের দাবি, গোর্কি অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, এবং গোর্কির লাশ কাঁধে নিয়ে তিনি কেঁদেছিলেন, কিন্তু বুখারিন ট্রায়ালের নথিপত্র আমলে নিলে দেখা যায়— ইয়াগোদার এনকেভিডি পুলিশই গোর্কিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলো। আমি বলছি না এটি কোনো প্রমাণিত সত্য, শুধু একটি জোর সম্ভাবনা মাত্র। গোর্কির ঘনিষ্ঠজনেরাও এ সম্ভাবনাটিকেই সত্য বলেছিলেন।

    Download

    গোর্কি ছিলেন মেহনতি মানুষদের লেখক। মানুষের জন্য তাঁর মমতা, এবং মানুষের বাকস্বাধীনতার জন্য তাঁর সংগ্রাম, আমৃত্যু অটুট ছিলো। রুশ প্রোলেতারিয়েতের এরকম অকৃত্রিম বন্ধু, রুশ সাহিত্যে অনেক এলেও, রুশ রাজনীতিতে আর আসে নি। বিপ্লবী রাজনীতিতে কেন জনগণের প্রকৃত বন্ধুরা টিকতে পারে না, এর উত্তর গোর্কিতে লুকিয়ে আছে বলে মনে করি। সমাজের চুপ করে থাকা মধ্যবিত্ত এ দায় এড়াতে পারে না।

    লিখেছেনঃ মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

    ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

    বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার

    Facebook Comments
    Tags:
    x
    error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করুন