Skip to content
Home » সরদার ফজলুল করিম : আমাদের কালের বাতিঘর

সরদার ফজলুল করিম : আমাদের কালের বাতিঘর

    দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম
    Redirect Ads

    বরিশালের প্রত্যন্ত আটিপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র এক কৃষক পরিবারে জন্ম তাঁর। যে কৃষক পরিবারে অন্য সব চিন্তা তো বাদ, প্রথমত খাবারের চিন্তা পোহাতে হতো। যেখানে কেবলই সমস্ত জুড়ে অভাব আর অভাব। লিখেছিলেন নিজেও “কৃষকের সন্তানের কোন ভবিষ্যৎ নেই!” সকাল বেলা পান্তা খেয়ে বাবাকে ফসলের মাঠে সাহায্য করতে লাঙ্গল নিয়ে ছুটতে হতো তাঁকে, অথচ সেই দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসে সরদার ফজলুল করিম হয়েছেন কালের মনীষী, প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক, দেশ সেরা দার্শনিক।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ক্লাস ছিলো জ্ঞানের মহাসমুদ্র। শিক্ষার্থীরা এতো ফাঁকিবাজিই করুক না কেন তাঁর ক্লাস মিস দিতে চাইতো না। অজপাড়াগাঁয়ের সেই অখ্যাত দরিদ্র পরিবার থেকে মেধার শীর্ষ পর্যায়ে উঠে এসেও সারাজীবন অটল ছিলেন নিজের আদর্শে। হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, হয়েছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য। হয়েছেন আমাদের কালের মনীষীদের একজন। তবু ভুলেননি নিজের শিকড়কে, নিজের আত্মসচেতনতাকে। নিঃসংকোচে বলতেন, “আরে আমি তো কৃষকের পোলাই।”

    Download

    সরদার ফজলুল করিমের জন্ম বরিশালের আটিপাড়া গ্রামে ১৯২৫ সালের পহেলা মে। বাবা খবিরউদ্দিন সরদার ছিলেন কৃষক, মা সফুরা বেগম গৃহিণী। তাঁরা ছিলেন পাঁচ ভাই বোন। সরদার ফজলুল করিমের শৈশব ও কৈশোরের প্রথম ভাগ কেটেছে গ্রামে। স্থানীয় এক স্কুল থেকে প্রাথমিক ও বরিশাল কলেজ থেকে মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকায় আসেন ১৯৪০ সালে। মাধ্যমিকে তিনি মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। সেই কৃষক পরিবার থেকে যে তিনি স্কুলে যেতে পেরেছিলেন সেজন্য আজীবন মা বাবার প্রতি পরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন তিনি। লিখেছিলেন,

    “আমার বাবা-মা নিরক্ষর এবং একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন। তাঁদের মতো লোকের কথা ছিল না আমাকে স্কুলে পাঠানোর। কিন্তু তারা আমাকে স্কুলে পাঠিয়েছেন। সেজন্য আমি এ-মাটির মানুষগুলোর কাছে ঋণী এবং এই দেশের মাটির প্রতি আমার মনের মধ্যে একটা ভক্তি জেগে আছে।”

    সরদার ফজলুল করিম ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মতো কিংবদন্তী শিক্ষকদের। ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন তাও প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে। এই সময়ে ইংল্যান্ডে পড়তে যাওয়ার জন্য বৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ইন্টার্ভিউ কার্ড ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন সরদার ফজলুল করিম-

    “ইন্টারভিউ কার্ড নিয়ে আমি কলকাতায় যাই। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে না গিয়ে আমি প্রথমে গেলাম কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে। সেখানে মুজাফফর আহমেদ (যাকে আমরা কাকাবাবু বলতাম), নৃপেন চক্রবর্তী (যিনি পরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন)। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আমি তো বিলেত যাচ্ছি। ’ ওঁরা শুনে হাসতে হাসতে ঠাট্টার ছলে বললেন, ‘আপনি বিলেত যাবেন আর আমরা এখানে বসে ভেরেন্ডা ভাজবো? কাঁথা-কম্বল নিয়ে পার্টি অফিসে চলে আসেন।’ তো কাঁথা-কম্বল নিয়ে পরের দিন আমি পার্টি অফিসে যাইনি কিন্তু ইন্টারভিউ কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।”

    আরও পড়ুনঃ দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম এর কিছু উক্তি

    বিলেতের বৃত্তি পেয়ে পড়তে না গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন সে বছরই।

    Download

    ছাত্রজীবনেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিলেন। বক্তব্য দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অধিকার আদায়ে, শিক্ষার্থীদের পক্ষে। সে ছোঁয়া শিক্ষক অবস্থাতেও তাঁর ছিলো। একটা সময় কমিউনিস্ট পার্টিতে সময় দেয়ার জন্য ছেড়ে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরি। পূর্ণাঙ্গ অনিশ্চিত জীবন যাকে বলে। ঘুরে বেড়িয়েছেন কৃষক, শ্রমিক, জনতার দাবী আদায়ে। গ্রামে কখনোবা আত্মগোপন করতে হয়েছিলো তাঁকে। গ্রামের ছেলে যেন আরেক গ্রামেই ফিরে গেল। একটা সময় রাজনীতির কারণে তাঁকে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছিলো নরসিংদীর নানা গ্রামে কৃষকের বাড়িতে। আর যখনই সুযোগ পেতেন লেখালেখির কাজে আত্মনিয়োগ করতেন। লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন মানুষের দাবী, মানুষের স্বপ্নের বুনন খুঁজতে। নিজেকে কখনো নেতা মনে করতেন না সরদার ফজলুল করিম। মিশে যেতেন মাটি ও মানুষের টানে।

    স্ত্রীর সঙ্গে যুবক বয়সে অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম

    প্রথম দিকে শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইস্তফা দেয়ার পরে তাঁকে থাকতে হয়েছিলো কলকাতায় কবি আহসান হাবীবের বাড়িতে।সেখানে ছিলো বিচিত্র জীবন যাত্রা। কিন্তু এক রাতে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে চলে এলেন নরসিংদীতে। নরসিংদীর চালাকচরে এসে আত্মগোপন করলেন। কেমন ছিলো সেই দিনগুলো? বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে,

    “রাতে থাকতাম এই যেমন ধরুন, কোন একটা গরুর ঘর, তার মধ্যে বিছানাপত্র বিছিয়ে আমি থাকতাম। ঐ গ্রাম গরিব এলাকা ছিল। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তেমন কোন চাহিদা ছিল না আমার। হয়তো কোনদিন একটি পুঁটিমাছ দিয়ে বা কোনোদিন পাটকাঠি দিয়ে শুঁটকি মাছ পুড়িয়ে তা দিয়ে কিছু ভাত খেলাম। সে এলাকায় সাধারণ মানুষ সবসময় ভাত খেতে পেতো না। ওটা আবার কাঁঠালের এরিয়া ছিল। কাঁঠালের সিজনে, সকাল বেলা কিছু কাঁঠাল দিত, সেই কাঁঠালের কোষ খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিতাম।”

    সে সময় কাপাসিয়া, মনোহরদী, চরসিন্ধুর সহ নানান গ্রামে আত্মগোপনে সাংগঠনিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। একটা সময় আবার ঢাকায় এলেন আত্মগোপনের মাঝেই। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে ঢাকা জেলে রাজবন্দিরা ৪০ দিন ব্যাপী অনশন ধর্মঘট শুরু করেলেন। সরদার ফজলুল করিম তখনও গ্রেফতার হননি। এ অনশনের খবর পাওয়ার ভিত্তিতে কর্মীরা দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার দেওয়ার চেষ্টা করে।

    সেসময় দেওয়ালে পোস্টার লাগানো ছিল বিপজ্জনক। তরুণ কর্মীরা রাতের আঁধারে দেওয়ালে পোস্টার লাগাবার চেষ্টা করত। তা লাগাতে গিয়ে অনেক ছাত্র ও তরুণ কর্মী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে চলে গেলেন। এদের মধ্যে ছিলেন আলমুতী, কিশোর আলী আকসাদ সহ অনেকে । ৪০ দিনের অনশনে রাজবন্দিরা কোনো দাবি আদায় করতে পারেননি। অবশেষে জেল কর্তৃপক্ষ এবং মুসলিম লীগের কোনো কোনো নেতার প্রতিশ্রুতিতে সে অনশন তাঁরা প্রত্যাহার করেন। কিন্তু তাঁদের উপর নির্যাতনের আদৌ কোনো উপশম না হওয়ায় ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে ঢাকা জেলের রাজবন্দিরা আবার অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।

    Download

    আরও পড়ুনঃ অধ্যাপক ডঃ নেহাল করিম স্যারের লাইফ চেঞ্জিং কিছু উপদেশ

    সরদার ফজলুল করিম ঢাকা এসে উঠলেন সাংবাদিক ও কবি সন্তোষ গুপ্তের বাড়িতে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা শহরের তাঁতী বাজার থেকে সরদার ফজলুল করিম তাঁর কয়েকজন বন্ধুসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তিনি যখন কারাগারে যান তখন রাজবন্দি হিসেবে মর্যাদা আদায়ের দাবিতে রাজবন্দিদের অনশন ধর্মঘট চলছিল পুরোদমে এবং কারাগারে ঢুকে সাথীদের সঙ্গে তিনিও অনশনে যোগ দেন রাজবন্দি হিসেবে মর্যাদা আদায়ের দাবিতে। অনশনের প্রথম ছ’দিন ‘সেলের’ মধ্যে দিনরাত মেঝেতে চোখ বুজে শুয়ে থাকতেন। মাথার কাছে জেলের সিপাহী জমাদার সকাল বিকাল ভাত-তরকারি থালায় করে রেখে যায় তাঁর সামনে। কিন্তু তিনি সেগুলি ছুঁতেন না। শুধু মাঝে মধ্যে কেবল সামান্য লবন মিশিয়ে পানি খেতেন।

    ছ’দিন পর সরদার ফজলুল করিম স্বেচ্ছায় অনশন না ভাঙ্গার কারণে তাঁকে হাসপাতালে আনা হয় এবং তাঁকে অন্যান্য অনশনরত বন্দিদের সঙ্গে জবরদস্তি করে খাওয়ানোর বা ‘ফোর্সড ফিডিং’ ব্যবস্থার অন্তভূর্ক্ত করা হয়। রোজ সকালে দশটার দিকে তাগড়া, জোয়ান একদল সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীসহ জেল হাসপাতালের কম্পাউন্ডার বা ডাক্তার একটা বাহিনী নিয়ে এসে চড়াও হত। তাদের হাতে থাকত বালতির মধ্যে পানির সঙ্গে দুধের পাউডার মেশানো ‘দুধ-পানি’। ফোর্সড ফিডিং এর এই বাহিনী প্রত্যেক বন্দির কাছে গিয়ে বন্দিরা যেন বাধা দিতে না পারে সেজন্য তাঁর হাত পা চেপে ধরত। তাঁদের হাত পা চেপে ধরে তাঁদের নাকের মধ্য দিয়ে একটা রবারের নল পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করত। এই রবারের নলের উপর দিকে রাখা বাটি বা কুপিতে সেই দুধ মেশানো পানি একসের কি আধসের ঢেলে দিত। এভাবেই খাওয়ানো হতো অনশনরত বন্দিদের।

    গোড়া থেকে যারা অনশন করেছিলেন তাঁদের ৫৮ দিন পুরো হওয়ার পরে একটা ফয়সালা হয়। আর সরদার ফজলুল করিম ত্রিশ দিন পুরো অনশন করে। এর মাধ্যমে কাপড়-চোপড় এবং থাকা খাওয়ার ব্যাপারে কিছু মর্যাদা এবং উন্নত অবস্থার স্বীকৃতি দেয়া হয় তাঁদের। দীর্ঘ সোয়া পাঁচ বছর পর ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে অবশেষে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম।

    Download

    কারাবন্দী থাকা অবস্থাতেই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম। বিখ্যাত মার্কিন পত্রিকাগুলো কারাবন্দী থাকা অবস্থাতে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় ফলাও করে ছাপিয়েছিলো। এক বিখ্যাত পত্রিকার শিরোনাম ছিলো “One communist from jail elected to constituent Assembly!”

    আরও পড়ুনঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী PDF রিভিউ – শেখ মুজিবুর রহমান

    ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত গণপরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি।
    এসময় করাচীতে ছিলেন সরদার ফজলুল করিম। এসময় নামের আগে সরদার থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানীরা মনে করতো তিনি আসলেই সর্দার গোষ্ঠীর। এবং খুব প্রভাবশালী। কিন্তু কিছুদিন পরেই ভুল ভাঙলো তাদের। ভীষণ আড্ডাবাজ ছিলেন। তার বাসাতে সবসময় রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের ভিড় লেগেই থাকতো। তিনি ছিলেন ভীষণ বন্ধু বাৎসল্য। তাঁর চালচলন ছিলো ভীষণ সাদাসিধে। এসময় সীমান্ত গান্ধী তথা খান আবদুল গাফফার খানের কর্মীরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতো।

    অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন,

    “সমারসেট হাউজে পার্লামেন্টের বাঙালি মেম্বাররা সাধারণত উঠতেন। একবার সরদার ভাই এসেছিলেন, আমাদের সরদার ফজলুল করিম। তাঁর ওখানে গিয়েও দেখি সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জমায়েত বটে। তবে এ আরেক কিসিমের। পাগড়ি মাথায়, পরনে লম্বা ঝুলের ঢোলা কামিজ, ঢোলা পাজামা পেশোয়ারি পাঠান। সবাই সীমান্তগান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের অনুগত কর্মী। রাজনৈতিক কারণে কারা-নির্যাতিত এক বাঙালি সরদারের সঙ্গে এঁরা মিলতে এসেছেন। দেখবার মতো সে দৃশ্য। এদিকটায় ছ’ফুট/ সোয়া ছ’ফুট ইয়া ইয়া দশাসই জওয়ান পাঠান-নন্দন ওরা কয়েকজন, বিপরীতে বসে ছোটখাটো কৃশকায় মলিন অবয়বের এক বাঙালি সরদার। পলিটিক্যাল কথাবার্তা… আগ্রহে-শ্রদ্ধায় ওঁরা শুনে গেলেন। কী বিষম অহঙ্কার আমার, বাঙালিদের মুল্লুকেও তাহলে সরদার জন্মায়। সরদার ভাইয়ের মুখে বিনীত হাসি।”

    কিন্তু ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করার পরে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলো। গ্রেফতার হলেন সরদার ফজলুল করিম। চার বছর পরে মুক্তি পেলেন ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে। ১৯৬৩ সালে যোগ দিলেন বাংলা একাডেমীতে। ১৯৬৩ থেকে ‘৭১ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন সরদার ফজলুল করিম।

    ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। অন্য কারাবন্দী অধ্যাপক, শিক্ষকদের সঙ্গে তিনিও মুক্তি পান ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ।

    Download

    আরও পড়ুনঃ চিলেকোঠার সেপাই PDF রিভিউ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

    ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, সেপ্টেম্বর মাসে, তাঁকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গ্রেফতার করে। অন্য কারাবন্দিদের সঙ্গে তিনিও ১৭ ডিসেম্বর মুক্তি পান। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে জাতীয় অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আমন্ত্রণে সরদার ফজলুল করিম শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দিলেন। আগে ছিলেন তিনি দর্শন বিভাগে, এবার যোগ দিলেন রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিষয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেওয়া নিয়ে স্মৃতির কথা বর্ণনা করেছিলেন সরদার ফজলুল করিম। লিখেছিলেন,

    “অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আবার আমাকে নিয়ে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি স্যারকে বলেছিলাম আমি তো দর্শনের লোক। পলিটিক্যাল সায়েন্সে তো আমার এমএ নেই। আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলেন? রাজ্জাক স্যার উত্তরে বলেছিলেন, ‘আপনি ফিলসফির উপর কি সব লেখালেখি করছিলেন না? ঐগুলা আমার দরকার।’ উনি বিশ্বাস করতেন, দর্শন ছাড়া রাজনীতি সম্ভব নয়।”

    সে বছরই প্রকাশিত হলো সরদার ফজলুল করিমের প্রথম গ্রন্থ “নানা কথা”। নানা কথায় উঠে এসেছে অসাধারণ সব বিষয়। ১৯৭৩ সালে যেমন দর্শন কোষ লিখলেন। যেটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দর্শন জ্ঞানকোষ। প্রথমে বাংলা একাডেমী থেকে দর্শনকোষ নিয়মিত বের হতো, এরপর তো পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে আনলেন সরদার ফজলুল করিম। গ্রীক দর্শনের প্রতি প্রচণ্ড মাত্রায় আগ্রহ ছিলো সরদার ফজলুল করিমের। তাইতো প্লেটোর সংলাপ। আর প্লেটোর রিপাবলিক অনুবাদ করলেন।

    বক্তৃতা করছেন দর্শনশাস্ত্রবিদ অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম

    তাঁর অনুবাদে প্লেটোর রিপাবলিক তো আজো প্রচণ্ড জনপ্রিয় এবং পাঠকপ্রিয়। কিংবা ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত অ্যারিস্টটল-এর “পলিটিক্স” এর অনুবাদ। কেবল গ্রীক দর্শনই নয়, মূলত দর্শনের পূর্ণ চর্চায় তিনি মগ্ন থেকেছেন। রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট, এঙ্গেলসের এন্টি ডুরিং, আমি রুশো বলছি তাই প্রমাণ করে। “আমি রুশো বলছি” অনুবাদের মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন আমি এখনো রুশোর ভূতগ্রস্তঃ রুশোর ভূতে পাওয়া। জানিয়েছিলেন তাঁর রুশোর প্রতি মুগ্ধতার কথা। তাঁর অনুবাদের মান ছিলো বিশ্বমানের। শব্দের গহ্বর, অর্থের নানারূপ মাত্রা, আর দর্শনের প্রাণ সবটুকু যেন ঢেলে দিয়েছেন তিনি অনুবাদে। তিনি যেমন ছিলেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মার্ক্সবাদী হয়ে তেমনি, হেগেল নিয়ে লিখেছেন অজস্রবার।

    কমিউনিস্টরা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলো আদর্শ তুলে, বলেছিলো হেগেল দিয়ে কি হবে? হেগেল কোথায় নিয়ে যাবে আপনাকে? জবাবে কেবল একটা বাক্যই বলেছেন সরদার। বললেন, “হেগেল আমাকে মার্ক্সের কাছে নিয়ে যাবে।”

    আরও পড়ুনঃ জনপ্রিয় ও সেরা কিছু বই PDF রিভিউ

    Download

    ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে চলে গেলেন সরদার ফজলুল করিম। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর রুমির আম্মা ও অন্যান্য প্রবন্ধ। যে প্রবন্ধ সংকলনে ছিলো মোট ১৭টি প্রবন্ধ। শুরুটা হয়েছিলো শহীদ রুমির মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে দিয়ে।

    জাহানারা ইমামের সঙ্গে তাঁর স্মৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ ও তাঁর পরবর্তী জাহানারা ইমামের অসামান্য অবদানের কথা উঠে এসেছে এই প্রবন্ধে। কিংবা তার পরের প্রবন্ধ তিন বিখ্যাত নেতা মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর কথা। এই প্রবন্ধ সংকলনে সরদার ফজলুল করিম উঠিয়ে এনেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল নিয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ, বলেছেন বামপন্থী সমাজতন্ত্রী উদ্ভব ও বিকাশ প্রসঙ্গে। বাদ যায়নি তাঁর বাবার স্মৃতি কিংবা পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ নিয়েও তাঁর অসামান্য ব্যাখ্যাও।

    ১৯৯৩ সালে “নূহের কিশতি এবং অন্যান্য প্রবন্ধ” এটিও ছিলো এক অসাধারণ প্রবন্ধ সংকলন। একই বছর প্রকাশিত হলো তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ। যেখানে উঠে এসেছে জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর আলাপ চারিতা। যে গ্রন্থে তিনি তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস থেকে শুরু করে সূচনাপর্ব, আশুতোষ ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম যুগের অধ্যাপকদের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রামমোহন ও সৈয়দ আহমদের ভূমিকা। এসেছে শেরে বাংলার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ, এসেছে ভাষা আন্দোলন নিয়েও নানা স্মৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান নিয়ে।

    বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব যোগ্যতা থেকে নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান, কাজী মোতাহার হোসেন থেকে মোনায়েম খাঁর বক্তৃতা, কাজী নজরুল ইসলামের ঢাকা আগমন পর্যন্ত স্মৃতিও , এই গ্রন্থে দদুজন জাতীয় অধ্যাপকের সাক্ষাৎকার আছে। প্রথমজন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, আড় দ্বিতীয়জন কাজী মোতাহার হোসেন ।

    আরও পড়ুনঃ বাংলা প্রবন্ধ সমগ্র PDF রিভিউ | বঙ্কিমচন্দ্র, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ

    এই গ্রন্থকে এক অসামান্য স্মৃতিকথা বলা চলে সরদার ফজলুল করিমের। এই গ্রন্থে সরদার ফজলুল করিম যেন মেলে দিয়েছেন নিজেকে, উজাড় করে নিজের সমস্ত স্মৃতি, মতামত, আড় ঘটনাপ্রবাহ সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। এর পরের বছর প্রকাশিত হয়েছিলো তাঁর স্মৃতিকথা “চল্লিশের দশকের ঢাকা” ।

    Download

    ১৯৪০ সালেই প্রথম ঢাকায় পা রাখেন সরদার ফজলুল করিম। তাই তাঁর প্রথম স্মৃতিটাও তিনি শুরু করেছিলেন, ‘বরিশালের পোলার “ঢাকা” আগমন’ শিরোনাম দিয়ে। পুরো গ্রন্থটাই ছিলো তাঁর স্মৃতিকথা, ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হয়ে অবশেষে গ্রামে প্রত্যাবর্তন দিয়ে। যেখানে উঠে এসেছে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর স্মৃতিচারণা, এসেছে সাহিত্যিক ও বিপ্লবী সোমেন চন্দের হত্যাকাণ্ড ও তাঁর কিশোর মনের প্রতিক্রিয়া। এসেছে তাঁর শিক্ষক হরিদাস ভট্টাচার্যের স্মৃতি, সিনেমার গল্প, শিক্ষার্থী থাকাকালীন স্মৃতির কথা। ঢাকা কলেজ প্রথম দেখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “কলেজ তো নয় যেন রাজপ্রাসাদ”।

    চল্লিশের দশকের প্রতিটি স্মৃতিই দারুণ সুখপাঠ্য। রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্টের কথা তো আগেই বলেছি। সেটি প্রকাশিত হয়েছিলো ২০০০ সালে। সমাজ, রাজনীতি, আইনের প্রসঙ্গ, দাসত্ব সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রের অধিকার , ভোট, ধর্ম, এক নায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র নির্বাচন নিয়ে সবিস্তারে লিখেছিলেন রুশো। সেই অনুবাদ যেন বাংলা ভাষায় প্রাণ পেল সরদার ফজলুল করিমের হাত ধরে। তিনি দেশীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেছেন বারেবারে।

    কিংবা বলা যায় তাঁর ২০০১ সালে প্রকাশিত “সেই সে কাল : কিছু স্মৃতি কিছু কথা” গ্রন্থের কথা। যেখানে তিনি লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কালের কথা। যেখানে এসে লাইব্রেরী সহকারী ওসমানের কথাও। সরদার ফজলুল করিম যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭২ সালে ফিরে গেলেন, তখন দেখা ওসমানের সঙ্গে। ঘটনা প্রসঙ্গে ওসমান বলছে,

    “স্যার আপনি তো একটা ডেঞ্জারাস লোক। আপনি সেই যে পাকিস্তান ভাঙ্গবেন বইলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাড়লেন, পাকিস্তান না ভাইঙ্গা আপনি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলেন না।”

    সরদার ফজলুল করিম এরপর লিখলেন ‘আমার জীবনটাকে আমি এই দৃষ্টিতে দেখিনি। কিন্তু ওর অব্জারভেশনে যে কিছুটা সত্য আছে তা অস্বীকার করি কি করে?’ এই গ্রন্থের পুরোটা জুড়ে তাঁর অসামান্য সব স্মৃতি।

    আরও পড়ুনঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনচরিত

    বলা যায় তাঁর লেখা স্মৃতিকোথা আরেক যুগে আর এক যুগোস্লাভিয়া গ্রন্থের কথা। যেখানে তিনি লিখেছেন ১৯৭৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর যুগোস্লাভিয়া সফরের কথা। এসেছে নোডিসাফ শহরের কথা, বেলগ্রেডের কাঁচাবাজারের কথা, এসেছে এক পাকিস্তানীর সঙ্গে কথোপকথন, এক ফরাসী প্রেমিকের কথা। যেখানে তিনি তুলে এনেছেন, রাজনীতি অর্থনীতি, চিরুনির দাম, ফুটপাতে মানুষের জীবন পর্যন্ত বাদ যায়নি এই গ্রন্থে।

    কিংবা বলা যায় সরদার ফজলুল করিমের লেখা আমি মানুষ গ্রন্থের কথা। তিনি যেখানে সবিস্তারে তুলে ধরেছেন আড়াই হাজার বছর বয়সী এক বৃদ্ধের কথা; যিনি কিনা এরিস্টটল। এরিস্টটলের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এসেছে ধূসরিত বাংলার প্রসঙ্গও। বলেছেন মানুষ হিসেবে মূল্যবোধের কথা, সেই প্রসঙ্গ তুলে আনতে ১৯৭১ এর হানাদারদের ধ্বংসযজ্ঞের কথাও বলেছেন। বলেছেন মার্কিনের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সমস্যা নিয়ে, পেন্টাগন সিআইএর বিষয় ও উঠে এসেছে এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থে বাদ যায়নি রবীন্দ্রনাথ, দেয়াল পঞ্জিকার সংস্কৃতিও।

    তাঁর লেখা স্মৃতিকথা আমি সরদার বলছি তো এক অসামান্য স্মৃতিকথা। যদিও সেই সেই কাল কিছু স্মৃতি কিছু কথা, বরিশালের পোলার “ঢাকা” আগমন আগেই ছাপা হয়েছিলো। কিন্তু বরিশালের পোলার “ঢাকা” আগমন অধ্যায়ে তিনি সবিস্তারে লিখেছিলেন। আমি সরদার বলছিতে শেষ অধ্যায় “জীবন জয়ী হবে”। পুরো স্মৃতিকথার গ্রন্থটিই যেন এক ইতিহাস, এক মানুষের জীবন যাত্রার সম্পূর্ণ পরিচ্ছেদ। প্রায় সাড়ে ছয় দশক ব্যাপ্তিকালের সময় রেখা।

    Download

    সরদার ফজলুল করিম যে কেবল মৌলিক আর অনুবাদই করেছেন তা নয়। তিনি সম্পাদনা করেছেন একাধিক স্বারকগ্রন্থ। রঙ্গলাল সেনের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছিলেন “শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা স্মারকগ্রন্থের।

    সম্পাদনা করেছেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মুজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে নিয়ে ” মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ ও। এছাড়া নিয়মিত লিখেছেন পত্রিকায়, মতামত দিয়েছেন নানা ভাবে।

    আরও পড়ুনঃ সত্যের সন্ধান – আরজ আলী মাতুব্বর

    সরদার ফজলুল করিমের পুরোটা জীবনই ছিলো ত্যাগের। আজীবন লড়াই করে গেছেন শোষণের বিরুদ্ধে, মানুষের অধিকার আদায়ে। সেই বরিশালের আটিপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ের এক দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসে দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পদার্পণ করার কয়েকটি যুদ্ধ জয়ের সমান। সেই জায়গা ছাড়তেও ন্যূনতম কার্পণ্য করেননি। তাঁর জীবনের চিন্তা আর লক্ষ্যই ছিলো গণ অধিকার। মানুষের অধিকার আদায়, কৃষক , শ্রমজীবী মানুষকে নিজের অধিকার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা। নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো কারাগারে পার করেছেন তিনি। তাঁর যখন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় তখন মোট ১১ বছর তিনি কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দী। তবু বিন্দুমাত্র অপ্রাপ্তি ছিলোনা তাঁর।

    শিক্ষকতা জীবনে যেমন ছিলেন ছাত্রদের প্রতি কর্ম নিষ্ঠ, উদার, আন্তরিক ও বন্ধু বাৎসল্য ঠিক তেমনি গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষের মাঝে ছিলেন ভীষণ কোমল। কেবল তাই নয়, সময়ে অসময়ে কতো লোভনীয় প্রস্তাব যে তাঁর কাছে ধেয়ে এসেছিলো, কিন্তু তিনি তা পাত্তা দেননি। বরং নিজেকে শাণিত করেছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উজ্জীবিত করাই ছিলো তাঁর ধ্যান।

    দর্শন চিন্তা থেকে, সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি কোন কিছুই তাঁর দৃষ্টি থেকে এড়ায়নি। নিজেকে বারেবারে শাণিত যেমন করেছেন, দিয়েছেন মতামত। নিজের বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা আর জ্ঞানের ভাণ্ডার আজীবন বিলিয়ে গেছেন একটি দেশ আর একটি জাতির জন্য। মুক্ত বাক, বাক স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন,

    Download

    “বুদ্ধিজীবী বলতে আজ আর কোন একটি আদর্শের অনুসারী ব্যক্তিকে বুঝায় না। এই বুদ্ধিজীবীর মধ্যেই রয়েছে শ্রমজীবী অর্থাৎ ব্যাপকতর মানুষের সংগ্রামের প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য শত্রু এবং এই বুদ্ধিজীবীর মধ্যেই রয়েছে শ্রমজীবীর সুহৃদ, মিত্র। এই উভয় অংশের স্বার্থ এবং চিন্তাগত বিরোধই নানা আবরণে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীর চিন্তাজগৎকে আকীর্ণ করে আছে।”

    আরও পড়ুনঃ প্রশ্নের শক্তিতে শক্তিমান একজন আরজ আলী মাতুব্বর

    সরদার ফজলুল করিম যেন তাঁর কথাই বলে গিয়েছিলেন। যিনি আজীবন ছিলেন এই বাংলার মাটি ও মানুষের সবচেয়ে কাছের মানুষ। বরিশালের সেই অজপাড়াগাঁয়ের নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী হয়েও তাঁর পা চড়েনি মাত্র এক ইঞ্চি উপরেও।

    একটা ঘটনার কথা বলে শেষ করি। সেবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে তাঁকে মধ্যাহ্নভোজনের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। তিনি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, “Your time is valuable and my time is also valuable. Let us not waste our time.” আজকের সময় বসে কোন বুদ্ধিজীবী কি কল্পনা করতে পারবেন?

    আজ ১ মে কিংবদন্তী দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার সরদার ফজলুল করিমের জন্মদিন। আমাদের কালের বাতিঘরের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

    Download

    লিখেছেনঃ আহমাদ ইশতিয়াক

    ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

    বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার

    Facebook Comments
    Tags:
    x
    error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করুন