Skip to content
Home » প্রশংসার নিন্দা : মানুষ তোষামোদ বা দালালি কেন করে?

প্রশংসার নিন্দা : মানুষ তোষামোদ বা দালালি কেন করে?

    Redirect Ads

    তোষামোদী, দালালি, এবং ফন্দিবাজি প্রশংসা— এ তিনটিকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। তিনটিই মোটামুটি সমার্থক শব্দ। এজন্য তিনটি শব্দকে আমি আলাদা আলাদা আলোচনা না করে, এর বিষয়বস্তুকে একসাথে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

    মানুষ প্রশংসা করে দুই ধরণের মানুষকে। এক— যাদের প্রশংসা প্রাপ্য, দুই— যাদের প্রশংসা প্রাপ্য নয়। আমার আলোচনার বিষয়বস্তু, প্রশংসার এই দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রাপকেরা, এবং একইসাথে, তাদের যারা প্রশংসা করেন তারা। এই অপ্রাপ্য প্রশংসাগুলোকেই আমরা নাম দিতে পারি তোষামোদ, দালালি, বা ফন্দিবাজি প্রশংসা। এ প্রশংসা কখনো প্রশংসাকারীর মনের ভেতর থেকে আসে না। আসে তার বনের ভেতর থেকে। তার মগজে যে-স্বার্থসিদ্ধির বনটি রয়েছে, সেটিই এ প্রশংসার প্রকৃত উৎস।

    Download

    প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষ তোষামোদ করে কেন? এর সরল উত্তর হলো, তোষামোদ যাকে করা হয়, তিনি সেটি খুব উপভোগ করেন। তবে আসল কারণটি ওরকম সরল নয়। তোষামোদের প্রকৃত কারণটি বুঝতে হলে, সবার আগে আমাদেরকে এর পেছনের রাজনীতিটিকে বুঝতে হবে।

    লক্ষ করলে দেখা যাবে, যারা তোষামোদ করেন, তারা সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির অংশ। ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি’ বলতে অনেকে দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক, মজুর, ও অশিক্ষিত মানুষদের বুঝে থাকেন, যা সঠিক নয়। পিএইচডি করা কোটিপতি মানুষও ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি’-র অংশ হতে পারেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ছাত্র-শিক্ষকরা আছেন, এবং আমাদের সরকারি চাকুরিতে যে তরুণ অফিসারেরা আছেন, তারাও এ জনগোষ্ঠির অংশ। বিষয়টি ধনসম্পদ বা শিক্ষাদীক্ষার নয়, বিষয়টি ক্ষমতার।

    কোনো অসম সমাজে, ক্ষমতা দ্বারাই নির্ধারিত হয় মানুষের সামাজিক নিয়তি। সমাজটিতে কে কতোখানি সমীহ পাবে, তা নির্ধারিত হয় ওই সমাজে মানুষের ক্ষমতার বন্টন দ্বারা। প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতার এ বন্টন সুষম হলেও, অগণতান্ত্রিক বা ছদ্মগণতান্ত্রিক সমাজে এ বন্টন অসম। এ ধরণের সমাজকে বলা যেতে পারে শয়তানের সমাজ। শয়তানের সমাজে ক্ষমতার কিছু মই তৈরি হয়। এটি আপনাআপনিই হয়, এবং এ মইয়ে চড়ার জন্য যে-গ্রাহকশ্রেণী, সেটিও আপনাআপনিই সৃষ্টি হয়। তোষামোদ যিনি করেন, তিনি এ ক্ষমতার মইয়ের পাদদেশের অংশ, আর তোষামোদ যিনি উপভোগ করেন, তিনি এ মইয়ের চূড়ার অংশ। মইটির চূড়ার জীবন আর তলার জীবন এক নয়। এ দুই জীবনের বৈষম্য যতো বেশি হবে, সমাজে মোট দালালির পরিমাণও ততো বেশি হবে।

    কিন্তু সমাজ যদি প্রকৃত অর্থেই গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে ওই সমাজে ক্ষমতার এ মইটি থাকে না। ইংল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডের কোনো প্রধানমন্ত্রী যখন ট্রেনে বা বাইসাইকেলে চড়ে অফিস করেন, বা পাবলিক পার্কে জটলাবিহীন হাঁটাহাঁটি করেন, অথবা কোনো হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে রোগীর তিরস্কারের শিকার হন, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, তাদের সমাজে ক্ষমতার এ মইটি নেই। মইয়ের বদলে ওখানে আছে নানা পথ। এসব পথের যেকোনো একটি ধরে হাঁটলে, একজন মানুষ ঘুরে দেখে আসতে পারেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুটিকে। ওই কেন্দ্রবিন্দুগুলোও খুব পানসে। তারা কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে দেখতে পান, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির জীবনের চেয়ে সাধারণ নাগরিকের জীবন অনেক আরামের। এজন্য নানা তুচ্ছ কারণে, তাদের আমরা হাসিমুখে পদত্যাগ করতে দেখি। অনেকেই একবার প্রধানমন্ত্রী হলে, বাকি জীবনে আর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নাম নেন না।

    Download

    তারা জানে যে, ক্ষমতা আর দায়িত্ব এক জিনিস নয়। দায়িত্ব পালন করা একটি পরিশ্রমের কাজ, যা ক্লান্তিকর। কিন্তু ক্ষমতা মাদকের মতো। সারাক্ষণ শুধু উপভোগ আর উত্তেজনা। যে-ব্যক্তি মাদকে অভ্যস্ত, সে সহজে মাদক ছাড়তে চায় না। কেউ ৩৩৩ নাম্বারে ফোন করে খাদ্যসাহায্য চাইলে, তাকে খাদ্যসাহায্য দেয়াটা হলো দায়িত্ব। আর তাকে খাদ্যসাহায্য না দিয়ে, কোনো অজুহাতে জেল-জরিমানা করাটা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতা প্রয়োগের এ স্বাদ, মাদক নেয়ার মতোই মিষ্টি। শরীরে হেরোইন বা পেথিড্রিন নিলে যে আবেশ আসে, ক্ষমতা চর্চা করার সময়ও শরীর ও মনে এরকম যাদুকরী আবেশ আসে।

    ক্ষমতার যারা শিকার বা ভিক্টিম, তারা এটি অনুধাবন করতে পারে। তাদেরও সাধ জাগে, ক্ষমতা, সম্মান, সমীহ, এ মাদকগুলোকে একটু চেখে দেখার। এ চেখার আশা থেকেই তারা শ্লোগান দেয়— অমুক তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই। পোস্টারে লেখে— আমরা অমুকের সৈনিক।

    আরও পড়ুনঃ দার্শনিক ভাষণ | বিষয়: শিক্ষা | পঞ্চম পর্ব | মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

    বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ‘বড় ভাই’ ও ‘স্লামালেকুম ভাই’ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার পেছনের কারণও ক্ষমতার এই মাদকটিকে একটু চেখে দেখা। শিক্ষকরাজনীতিও এ কারণেই টিকে আছে। শুধু শিক্ষক, শুধু অধ্যাপক, এ জীবন খুব পানসে। জীবনকে মধুমাখা করতে হলে স্বাদ পেতে হবে উপাচার্য বা কোনো কমিশনের চেয়ারম্যান পদের। প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজে, এ স্বাদ শিক্ষকেরা স্বাভাবিক পথেই পান, কিন্তু বাঙালি যে-সমাজে আছে, সেখানে এ স্বাদ পেতে হলে একজন শিক্ষককে হাঁটতে হয় নানা বিকৃত পথে।

    Download

    এ বিকৃত পথগুলোর একটি হলো তোষামোদ, বা দালালি, বা ফন্দিবাজি প্রশংসা। তারা জানেন, কার প্রশংসা করলে কী পাওয়া যাবে। সত্যেন বোস বা জগদীশ চন্দ্র বোসের প্রশংসা করে কোনো লাভ নেই, কাজী নজরুলের মাজার জিয়ারত করে কোনো নগদ প্রাপ্তির আশা নেই, এটি তারা বুঝেন। এজন্য তারা প্রশংসা করেন শুধু বিশেষ বিশেষ মানুষদের, আর জিয়ারত করেন শুধু বিশেষ বিশেষ মাজার। বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মাজারে আমি অনেককেই যেতে দেখি, কিন্তু তারা ওই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে কতোটা ভালোবাসেন তা নিয়ে সন্দেহ জাগে। যারা ওই ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, তাদের তো দুই হাজার টাকার পর্দা বাইশ হাজার টাকায় কেনার কথা নয়। এর চেয়ে গ্রামের মানুষেরা যে নানা পীর-মুর্শিদের মাজারে মানত আদায় করেন, তা আমার কাছে বেশি অকৃত্রিক ও ভালোবাসাপূর্ণ মনে হয়।

    তোষামোদের যে-রাজনীতিক রূপ, তা শুধু ক্ষমতার মই বেয়ে উপরে উঠার রূপ নয়। ক্ষমতার মইটির কাছাকাছি থাকাও তোষামোদকারীর লক্ষ্য থাকে। বিসিএসের কথাই ধরা যাক। আমি এমন অনেক মানুষ পেয়েছি, যারা ট্রফিক সার্জেন্টের হাত থেকে মোটরসাইকেল বাঁচানোর জন্য, পুলিশ ক্যাডারের কোনো অফিসারের ছবি ফেসবুকে দিয়ে তোষামোদ করে থাকেন। আমার ধারণা, এ ধরণের তোষামোদ ওই পুলিশ কর্মকর্তাও বুঝতে পারেন। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের তরুণেরা যে অভিনন্দন কম পান, এর কারণও ক্ষমতা। মানুষ জানে, ট্রাফিক সার্জেন্ট মোটরসাইকেল আটকালে, কলেজের শিক্ষক কোনো কাজে আসবে না।

    আবার ‘অমুক ক্ষমতাধর আমার পরিচিত, তার সাথে আমার ওঠাবসা আছে’ এটি জাহির করতেও অনেকে তোষামোদ করে থাকেন। বাংলাদেশে এই মুহুর্তে যতো পোস্টার আছে, তার আশি ভাগ সম্ভবত এ ঘরানার তোষামোদের পোস্টার। এর উদ্দেশ্য হলো, চারপাশের মানুষকে একটু সতর্ক করে দেয়া, যেন তার সাথে কেউ লাগতে না আসে। এটি অনেকটা এক দানব থেকে বাঁচতে আরেক দানবের আশ্রয় নেয়ার মতো ব্যাপার।

    রাষ্ট্রে আইনের শাসন বহাল থাকলে, এবং রাষ্ট্রের পরিচালকদের উপর মানুষের আস্থা থাকলে, এ ধরণের তোষামোদের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। তোষামোদ প্রয়োজন পড়ে তখন, যখন মানুষ টের পায় যে— কোনো মানবিক নীতি বা আইন দ্বারা সমাজ শাসিত হচ্ছে না। সমাজ শাসিত হচ্ছে কিছু মানুষের খামখেয়ালি দ্বারা, অথবা কিছু মানুষ দ্বারা উদ্ভাবিট নিপীড়নমূলক আইনের শক্তিতে। আমাদের দেশের নিম্ন আদালতগুলো, মাত্র দু-তিন মিনিট শুনানি নিয়ে মানুষকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়ে থাকে। একজন মানুষকে জামিন না দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, একজন বিচারক তিন মিনিটে কীভাবে নেন? একমাত্র খামখেয়ালি ছাড়া আর কোনো উপায়ে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব বলে মনে করি না।

    Download

    আরও পড়ুনঃ অন্ধকার ও মানুষের প্রশংসা | প্রথম পর্ব | মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

    বিচারের আগেই কাউকে শাস্তি দেয়ার মানসিকতা, সমাজে তোষামোদ বৃদ্ধির অন্যতম রাজনীতিক কারণ। মানুষ যখন টের পায় যে, কোথাও বেআইনি পীড়নের শিকার হলে আদালতগুলোও তাকে রক্ষা করতে পারবে না, তখন সে আদালতের বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করে থাকে। সে চেষ্টা থেকেই সে নানা ক্ষমতাধর ব্যক্তির তোষামোদ করে থাকে। তার আশা, ভবিষ্যতে কোনো বিপদে পড়লে, আদালত তাকে রক্ষা না করলেও, পোস্টার বা ফেসবুক প্রোফাইলে দেয়া বিশেষ ক্ষমতাবান ব্যক্তি তাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু আদালতগুলো যদি স্বাধীনভাবে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলির সুরক্ষা দিতো, তাহলে এ ধরণের তোষামোদ কমে যেতো।

    এখানে আমি একটি উদাহরণ দিতে চাই। শিকদার গ্রুপের দুই ছেলে, একটি মামলার পর বিশেষ এম্বুলেন্সে করে বিদেশে চলে গিয়েছিলো। কারণ তারা হয়তো এমন কাউকে তোষামোদ করেন, যিনি তাদের যেকোনো দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু শিকদার গ্রুপের ছেলেরা, এক পর্যায়ে বুঝতে পারে যে দেশে ফিরে যাওয়াই ভালো। এজন্য তারা বিদেশ থেকেই জামিনের আবেদন করেন। কিন্তু আদালত তাদের এ আবেদন শুনেনই নি। উল্টো উষ্মা প্রকাশ করে তাদের জরিমানা করেন। এটি কেন করা হয়েছিলো? এর পেছনে খামখেয়ালি ছাড়া যৌক্তিক কারণ কী থাকতে পারে? যিনি একটি মামলাকে আইনিভাবে মোকাবেলা করার জন্য দেশে ফিরতে চাচ্ছেন, এবং এ উদ্দেশ্যে দেশের আদালতের কাছে জামিন চাচ্ছেন, তাকে আদালত সে-সুযোগ না দিয়ে দেশের কী উপকার করলো? কোনো উপকারই করে নি। আদালত শিকদার গ্রুপের ছেলেদের, পুনরায় তোষামোদের দিকেই ঠেলে দিলো। এরপর তারা তাদের নিজস্ব তোষামোদী প্রক্রিয়াতেই দেশে ফিরে এসেছিলো, এবং চব্বিশ ঘন্টার ভেতরেই জামিন লাভ করেছিলো।

    কোনো রাষ্ট্রে অন্তত একটি প্রতিষ্ঠান থাকতে হয়, যেটির উপর ধনী-গরিব সকল মানুষ নির্ভয়ে নির্ভর করতে পারে। যেকোনো প্রকৃত গণতন্ত্রে, আদালতগুলোই এ ভূমিকা পালন করে থাকে।
    কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, মানুষ তো অরাজনীতিক কারণেও তোষামোদী করে থাকে, এটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? যেমন ছাত্র কর্তৃক শিক্ষকের তোষামোদী, ভক্ত কর্তৃক লেখকের তোষামোদী, অনুসারী কর্তৃক মতাদর্শের তোষামোদী।

    দেখুন, এ তোষামোদীগুলোও রাজনীতিক, যদিও এর রাজনীতিক রূপটি এতোটা প্রকাশ্য নয় বলে সহজে বুঝা যায় না। একজন ছাত্র অবশ্যই তার শিক্ষকের প্রশংসা করতে পারেন, কিন্তু তা যখন প্রশংসার গন্ডি পেরিয়ে তোষামোদের আকার ধারণ করে, তখন বুঝতে হবে ছাত্রটির অন্য মতলব আছে। হয়তো সে কোনো কোর্সে নম্বর বেশি পেতে চায়, অথবা ওই শিক্ষকের কোনো বিশেষ ক্ষমতার আনুকূল্য পেতে চায়। আমি কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে চিনি, যারা ভালো ‘রিকামেন্ডেশান লেটার’ পাওয়ার আশায় শিক্ষকদের তোষামোদী করতো। এগুলো কিন্তু রাজনীতিক কারণ। ছাত্র তার ভবিষ্যৎ লাভের আশায় এ তোষামোদী করে থাকে।

    আবার ভক্তরা, নানা কারণে তাদের পছন্দের লেখকের তোষামোদী করে থাকে। যেমন— ভিন্ন মতাদর্শের কোনো লেখককে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে, লেখকের সাথে কিছু ছবি তোলার জন্যে, লেখকের অন্যান্য ভক্ত থেকে নিজেকে একটু আলাদা ভক্ত হিশেবে উপস্থাপনের জন্যে, এবং লেখককে ধ্বংস করার জন্যে। এর বাহিরেও নানা কারণ থাকতে পারে, এবং ভক্তদের এ আচরণগুলো কিন্তু রাজনীতিক। রাজনীতি শুধু ভোটে দাঁড়ানো বা ইলেকশান করা নয়।

    Download

    ইলেকশানের বাহিরেও রাজনীতি আছে। মানুষ জন্মের পর থেকে কবরে ঢোকার আগ পর্যন্ত যা করে, তার সবই রাজনীতিক। এমন কি প্রার্থনাও। তারা জানে, বেহেশতেরও নানা স্তর আছে। উঁচু স্তরের ফেরদাউস রেখে নিচু স্তরের ‘মাকাম আল আমিন’-এ কে যেতে চায়?

    আরও পড়ুনঃ জিপিএ ফাইভ পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছিলো জুতোর ফ্যাক্টোরিতে

    নানা মতাদর্শের অনুসারীরা, তাদের নিজ নিজ মতাদর্শের, বা ওই মতাদর্শের কোনো প্রচারকের পক্ষে যে-তোষামোদি বা দালালি করে থাকে, তাও রাজনীতিক। এক লাখ মতাদর্শের মধ্যে, তার মতাদর্শের মাথাটিকে সবচেয়ে উঁচুতে তোলার জন্যে সে এ তোষামোদী করে থাকে। এতে তার কিছু ইহলৌকিক, অথবা পরলৌকিক স্বার্থও জড়িত থাকে। বাংলাদেশে যে ওয়াহাবি-সুন্নি মারামারিটি আছে, তা টিকে আছে মূলত এ দুই মতাদর্শের অনুসারীদের তোষামোদীর কারণে। এক পক্ষের অনুসারীরা আরেক পক্ষের অনুসারীদের ধূলোয় মিশিয়ে দিতে চায়। তাদের নেতারা এমন এমন অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন, যা স্রেফ এ অনুসারীদের খুশি এবং চাঙ্গা রাখার জন্যই বলেন। এখানে তোষামোদের একটি উল্টো চিত্র পাওয়া যায়। সব জায়গায় নিচু মানুষেরা উঁচু মানুষদের তোষামোদী করলেও, এখানে দেখা যায় নেতারা তোষামোদ করছেন অনুসারীদের! এক মাহফিলে আমি নিজ কানে শুনেছি, এক পক্ষের বড় বক্তা, আরেক পক্ষের বড় বক্তাকে ‘পানখোর বুইড়া ছাগল’ নামে অভিহিত করছেন, এবং এটি শুনে মাহফিলের শ্রোতাদের সে কী আনন্দ!

    তোষামোদের উপকারিতা কী? তোষামোদের কোনো উপকারিতা নেই। এর শুধু অপকারিতাই আছে। হ্যাঁ, ব্যক্তিগত লাভ এতে কিছু হয়, কিন্তু তা আসলে লাভের মুখোশে ক্ষতি। তোষামোদ, তোষামোদকারী ব্যক্তি এবং এর গ্রহীতা, উভয়ের ব্যক্তিত্বকেই নষ্ট করে। যারা সুযোগ ছিলো উৎকর্ষ সাধনের, সে তোষামোদ পেয়ে ধাবিত হয় অবকর্ষের দিকে। যেকোনো সমালোচনাকে সে গিবত মনে করে, এবং সমালোচনাকারীকে জ্ঞান করে শত্রু। এটি তাকে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাচারী একনায়কে পরিণত করে। প্রশংসা ছাড়া সে তখন আর কিছুই শুনতে চায় না। মাদকাসক্তের মতো সে হয়ে উঠে প্রশংসাসক্ত। এই তোষামোদের মাদক যাকে একবার পেয়েছে, তার শরীর না হোক, আত্মা যে কবুতরের খোপ হয়ে গেছে, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

    তোষামোদ এক প্রকার আনন্দ-অভ্যাসের সৃষ্টি করে। ফলে যাদের ক্ষমতা আছে তোষামোদ প্রাপ্তির, তারা সারাক্ষণ এমনভাবে কাজ করেন, যেন কাজটি শেষে তারা কিছু তোষামোদ পান। শুধু প্রশংসা পাওয়া তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের লক্ষ্য মাদকের মতো উপভোগ্য তোষামোদ, যা পেয়ে তারা অবশ ও বুঁদ হয়ে থাকবেন আনন্দ সুখে। ফলে কোনো নীতি বা প্রিন্সিপল নয়, তারা তাদের কাজে প্রাধান্য দেয়া শুরু করেন আবেগকে।

    যেমন কয়েকমাস আগে কিছু ক্ষমতাধর ভদ্রলোক, লম্বা চুলের ছেলেদেরকে সেলুনে ঢুকিয়ে চুল ছাটাতে বাধ্য করেছেন। তাদের দাবি এগুলো অসামাজিক চুল। আমার ধারণা, তারা নিউটনকে রাস্তাঘাটে পেলে, তাঁকে ধরেও সেলুনে ঢুকিয়ে দিতেন। এই যে কাজগুলো, এগুলো কিন্তু পরিষ্কারভাবে অসাংবিধানিক কাজ। একজন স্বাধীন নাগরিকের যেভাবে খুশি সেভাবে চুল রাখার অধিকার রয়েছে।

    Download

    যারা ক্রিমিনাল ল পড়েছেন তারা জানেন, বিনা সম্মতিতে কারও একটি চুল স্পর্শ করা হলো ‘ব্যাটারি অফেন্স’, কারও একটি চুল কাটা হলো ‘অ্যাকচুয়াল বডিলি হার্ম বা এবিএইচ অফেন্স’, এবং চুল কাটতে গিয়ে কারও মাথার চামড়া কেটে ফেলা হলো ‘গ্রিভাস বডিলি হার্ম বা জিবিএইচ অফেন্স’, এবং এর প্রত্যেকটিই ফৌজদারি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
    কিন্তু ভদ্রলোকেরা এসবকে আমলে না নিয়ে, আমলে নিয়েছেন সামাজিক বাহ্বা প্রাপ্তিকে। এই অন্ধ বাহ্বাও খুবই মারাত্মক তোষামোদী। কোনো সমাজে অন্ধ মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে, এরকম বাহ্বা খুব বেড়ে যায়। তখন ক্ষমতা যারা উপভোগ করেন, তারা নিয়মিত মাদকের মতো এ বাহ্বা পেতে চান।

    তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় তোষামোদ যিনি করেন তার। সে তোষামোদ করতে গিয়ে পরিণত হয় দাস বা গোলামে। এক মানুষ আরেক মানুষের দাসে পরিণত হচ্ছে, এটি কি খুব শোভনীয় কিছু?

    আরও পড়ুনঃ ছাগল ও তার পিএইচডি ডিগ্রি : ডক্টরেট ডিগ্রির আদ্যোপান্ত

    আমি আশা করবো, দাসপ্রথার মতো তোষামোদ প্রথারও একদিন বিলুপ্তি ঘটবে। কিন্তু এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে তাদেরকেই, যারা তোষামোদ করে থাকেন। হৃদয় থেকে সালাম না এলে কাউকে সালাম দেয়া যাবে না। হৃদয় থেকে প্রশংসা না এলে কারও প্রশংসা করা যাবে না। কাউকে ভয় পেয়ে তার সম্পর্কে ভালো ভালো মন্তব্য করা যাবে না। অপ্রয়োজনীয় ফালতু শ্লোগান পরিহার করতে হবে। নিজেকে ক্ষুদ্র ভাবার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। শরীরের মেরুদন্ডের চেয়ে মনের মেরুদন্ডটিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ উদ্দেশ্যে, ক্ষমতাবান মানুষদের ছবি ফেসবুকে প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ পরিত্যাগ করতে হবে। ক্ষমতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে হবে।

    দায়িত্বকে ক্ষমতা ভাবা বন্ধ করতে হবে। অন্যের মতো হওয়ার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোকে সম্মান করতে হবে। কারও দুর্ভোগকে উপভোগ করা যাবে না। একা একা চলার অভ্যাস করতে হবে। অন্যথায় তোষামোদ নামক মাদক থেকে সহজে মুক্তি মিলবে না।

    লিখেছেনঃ মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

    Download

    ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

    বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার

    Facebook Comments
    Tags:
    x
    error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করুন