আগে পড়ুনঃ দার্শনিক ভাষণ | বিষয়: শিক্ষা | চতুর্থ পর্ব
শিক্ষার দ্বিতীয় কাজ ভয় সৃষ্টি করা। শিক্ষিত মানুষ ভীতু হয়। এ ভয়ের জন্ম সচেতনতা থেকে। শিক্ষা মানুষকে তার স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিশ্চয়তা দেয় যে, তোমার স্বার্থ রাষ্ট্র রক্ষা করবে, যদি তুমি রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করো। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে থাকে। আইন, শিক্ষিত মানুষদের জানিয়ে দেয়, কী কী করা যাবে, ও কী কী করা যাবে না। তবে রাষ্ট্র খারাপ হলে, আইন এমনভাবে প্রণয়ন করে, যেন নাগরিকেরা আইন না ভেঙে চলতে পারে না। এর উদ্দেশ্য হলো, রাষ্ট্র চাইলে যেন যেকোনো সময় যেকোনো নাগরিককে, আইনের আওতায় আনতে পারে। এ আইনগুলোকে আমি বলি নাজি আইন, এবং নাজি আইন কোনো আইন নয়। এগুলোর খসড়া এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেন পড়লে মনে হবে— সবই করা যাবে, আবার কিছুই করা যাবে না। অপরাধকে এসব আইনে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় না। এমন এমন শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা হয়, যেন আইনটি প্রকৃত অর্থেই মাছ ধরার জাল হয়ে ওঠে।
এ জালের মাধ্যমেই রাষ্ট্র, শিক্ষিত মানুষদের মনে ভয়ের সঞ্চার করে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যখন পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়েছিলো, তখন যারা অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেছিলো, তাদের অধিকাংশই অশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। শিক্ষিত মানুষেরা, জহির রায়হান আমাদের জানিয়েছেন, ভয়ে কলকাতায় পালিয়ে গিয়েছিলো। কেউ কেউ, যেমন হুমায়ুন আহমেদ ও তাঁর ভাই, দেশেই নানা স্থানে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। মহিউদ্দিন খান আলমগীর, প্রভাবশালী আমলা ছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন নি। হুমায়ুন আজাদ, স্কটল্যান্ড থেকে পত্রিকায় যুদ্ধের খবর নিতেন, কিন্তু দেশে আসেন নি (অবশ্য ওই সময় দেশে আসা হয়তো সম্ভব ছিলো না, এবং সম্ভব হলেও তিনি আসতেন না বলেই মনে করি)। ফরহাদ মজহার, আহমদ ছফা, আল মাহমুদ, মুনীর চৌধুরী (মুনীর চৌধুরী নিহত হয়েছিলেন, কিন্তু যুদ্ধ করেন নি), আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শামসুর রাহমান, এবং পূর্ব পাকিস্তানের আরও লাখ লাখ শিক্ষিত সিভিলিয়ান মানুষ, অস্ত্র হাতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ করেন নি (আমি এখানে কেবল বেসামরিক নাগরিকদের সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার কথা বলছি)।
আমি প্রায় একশোটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প পড়েছি, কিন্তু কোনো গল্পেই স্যুট-টাই পরা কাউকে পাই নি। সেলিনা হোসেন, বানিয়ে বুনিয়ে একটি অত্যন্ত নিম্নমানের মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখে, পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু নিজে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি, যদিও তার জন্ম ১৯৪৭ সালে। এর কারণ সচেতনতা ও ভয়। শিক্ষার মাধ্যমে পাকিস্তান তাদের জানিয়ে দিয়েছিলো, রাষ্ট্রদ্রোহের পরিণাম কী। হ্যাঁ, কিছু ব্যতিক্রম আছে, তবে তা আমার আলোচনার বিষয়বস্তু নয়।
কিন্তু অশিক্ষিতরা রাষ্ট্রদ্রোহ শব্দটির সাথে পরিচিত ছিলো না। এখনও গ্রামের কোটি কোটি মানুষ, যারা শিক্ষিত নয়, তারা জানে না রাষ্ট্রদ্রোহ কী। এই মুহুর্তে সিলেট যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে, এবং বাংলাদেশের সাথে সিলেটবাসীর যদি যুদ্ধ বাঁধে, তাহলে সিলেটের পক্ষে আমার যুদ্ধ করার সম্ভাবনা কম, কারণ শিক্ষা আমাকে ভীতু করে দিয়েছে, কিন্তু গ্রামের ওই অশিক্ষিত মানুষেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
আরও পড়ুনঃ শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা তিনটি বই PDF রিভিউ
শেখ মুজিব যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই ডিগ্রিটি নিতেন, এবং শিক্ষিত হয়ে যেতেন, তাহলে মার্চ মাসের ওই ভাষণটি দেয়া হয়তো তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাঁর সহপাঠীরা যখন নিরাপদ ছাত্রত্ব ও সরকারি চাকুরি উপভোগ করেছে, শেখ মুজিব তখন বছরের পর বছর জেলখানায় ধুঁকেছেন। শেখ হাসিনা এক সভায় প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তাঁর বাবার লাশটি বাড়ির সিঁড়িতে এতো সময় পড়েছিলো, কেন এতো বড় দলের একজন নেতাও তাঁর বাবার পক্ষে এগিয়ে আসেন নি। এর অনেক ব্যাখ্যা থাকতে পারে, তবে আমার ব্যাখ্যাটি হলো, তখন শেখ মুজিব যাদের বিশ্বাস করতেন, তাদের সবাই শিক্ষিত নাগরিক ছিলো। শিক্ষিত নাগরিকেরা স্বার্থপর হয়। এখনও, শেখ হাসিনাকে যারা ঘিরে রেখেছেন, তাদের সবাই শিক্ষিত নাগরিক, এবং কোনো দুর্যোগ এলে, এদের একজনকেও তাঁর পাশে পাওয়া যাবে না।
তবে রাষ্ট্র ভালো হলে, শিক্ষিত মানুষেরাই বেশি সাহসী হয়, কারণ তখন শিক্ষার উদ্দেশ্য থাকে, নাগরিকদের মনে, ভয়ের বদলে সাহসের সঞ্চার করা। এজন্য প্রয়োজন আইনের সংখ্যা কমানো। কোনো রাষ্ট্রে আইনের সংখ্যা যতো বেশি হয়, সে-রাষ্ট্রের নাগরিকেরা ততো বেশি ভীতু ও অপরাধপ্রবণ হয়। আইনের প্রতি ভয়, তাদের ধীরে ধীরে নপুংসক করে তোলে, এবং যা করার কথা প্রকাশ্যে, তা তারা করে লুকিয়ে লুকিয়ে। কোনো ভালো রাষ্ট্রে বেশি আইন থাকে না। ওখানে আইন থাকে অল্প, এবং আইনের ভাষা থাকে অত্যন্ত পরিষ্কার। কোনো জিনিস সংখ্যায় বেশি হলে, তা প্রাকৃতিকভাবেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এজন্য আইনকে শক্তিশালী করতে হলে, প্রথমেই তার সংখ্যা কমাতে হবে। কোনো রাষ্ট্র ভালো কি না, সেটি বুঝার জন্য আমি প্রথমেই দেখি ওই রাষ্ট্রে আইন ও জেলখানার সংখ্যা কম কি না। যদি দেখি আইন ও জেলখানা সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে, তাহলে ধরে নিই, রাষ্ট্রটি অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে।
শিক্ষা যে-স্বার্থসচেতনতার সৃষ্টি করে, তার সাথে সম্পর্ক আছে লোভের। এ লোভ, নিজেকে ও নিজের সম্পত্তিকে রক্ষা করার লোভ। এ লোভে পড়েই একজন নাগরিক পা দেন, রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের ফাঁদে, কারণ রাজা, পুলিশ দিয়ে নাগরিকের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব নেন। বিনিময়ে নাগরিক, রাষ্ট্রকে ইনকাম ট্যাক্স, ভ্যাট, আমদানি শুল্ক, ইত্যাদি পরিশোধ করেন।
শিক্ষার তৃতীয় কাজ উৎপাদন বাড়ানো। প্রয়োজনীয় উৎপাদন নয়, অপ্রয়োজনীয় উৎপাদন। যদি একজন কৃষক শুধু ততোটুকোই উৎপাদন করেন, যতোটুকো তার জীবন ধারণের জন্য দরকারি, এবং আর কোনো অতিরিক্ত উৎপাদন না করেন, তাহলে খাওয়ার জন্য, রাষ্ট্রের চালকদের কিছু থাকবে না। কারণ ক্ষমতা ও সিংহাসন, লোভনীয় হলেও তা ভক্ষণযোগ্য নয়। এজন্য তারা শিক্ষার মাধ্যমে, এমন একটি জনগোষ্ঠি তৈরি করেন, যারা নিজেরা কৃষিকাজ করবে না, কিন্তু প্রশংসা করবে কৃষিকাজের (যেমন একটু আগে আমি দেখিয়েছি, কীভাবে নিজেরা মুক্তিযুদ্ধ না করেও, খুব ভাল প্রশংসা করা যায় মুক্তিযুদ্ধের)। চারদিকে যে কৃষকদের এতো প্রশংসা শোনা যায়, এর কারণ হলো এটি। এই প্রশংসা দিয়েই কৃষকদের ভুলিয়ে রাখা হয় কৃষিকাজে। কৃষকেরা ভাবেন, কৃষিকাজ খুব মহান কাজ। কিন্তু এর মূলে যে একটি অসৎ চালাকি রয়েছে, তা কৃষকেরা ধরতে পারেন না। শিক্ষা
শিক্ষা যে-অনুৎপাদনশীল ভোক্তা শ্রেণীটি তৈরি করে, তারা কৃষক ও শ্রমিকদের এ অতিরিক্ত উৎপাদনকে কিনে নেন, এবং লিপ্ত হন ভোগ ও বিক্রয়কর্মে। এই ক্রয় বিক্রয় প্রক্রিয়া থেকে যে-কর আহরিত হয়, তা দিয়েই রাষ্ট্র চলে।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : মাক্সিম গোর্কি | প্রথম পর্ব | Maxim Gorky
শিক্ষিত মানুষেরা, খুব কমই, সরাসরি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এ লেখাটি আমার কোনো উপকারে আসবে না, যদি অশিক্ষিতরা আগামীকাল থেকে বন্ধ করে দেয় অপ্রয়োজনীয় উৎপাদন, কারণ লেখাটি খেয়ে আমার পেট ভরবে না। লেখালেখি, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, ও ধর্মচর্চার জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত উৎপাদনের এ চাকাটি সচল রাখা। যদি অশিক্ষিতরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন না করতো, তাহলে নিউটনকে হালচাষ করে দিন কাটাতে হতো। কেরানিগিরির চাপে, আইনস্টাইন জেনারেল রিলেটিভিটি নিয়ে ভাবার সময়ই পেতেন না। সক্রেটিসও বেঁচে যেতেন, তাঁকে হেমলক পান করতে হতো না। প্লেটো হয়তো কাউকে ছুরি মারতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হতেন, আর আমি হয়তো, গ্রামের ওই মাঠটিতে এখনও গোবর কুড়াতাম।
রাজা বাদশারা নয়, একমাত্র জনগণই অমর, এরকম মিষ্টি কথা স্তালিন বলতে পারতেন না, যদি রুশ প্রলেতারিয়েতরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন না করতো। ট্রটস্কি তাঁর ‘হিস্ট্রি অব রাশিয়ান রেভুল্যুশন’ লিখতে পারতেন না, যদি অশিক্ষিত রুশরা তাঁর আহারের সংস্থান না করতো। লেনিন, শ্রমিকদের এতো প্রশংসা করতেন না, যদি তিনি নিজে শ্রমিক হতেন। মার্ক্স তাঁর ওই মোটা জস ক্যাপিটাল, আর ছোট্ট ম্যানিফেস্তোটি রচনা করতে পারতেন না, যদি কোনো সুয়েটার ফ্যাক্টোরিতে তাঁকে কাজ করতে হতো। রবীন্দ্রনাথ যদি জমিদার না হয়ে তিউনিশিয়ার বাওয়াজিজি হতেন, তাহলে গীতাঞ্জলি লেখার অবসর তিনি পেতেন না।
জীবানানন্দ যদি কলেজে মাস্টারি না করে কুলিগিরি করতেন, তাহলে তিনি এলান পো’র ‘টু হেলেন’ ও বায়রনের ‘শি ওয়াকস ইন বিউটি’ পড়তেন না, এবং রচনা করতেন না— চুল তার কবেকার অন্ধকার পাগলের নিশা।
লিখেছেনঃ মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
বিদেশী অনুবাদ বই রিভিউ | Bangla Translated Books PDF Free Download