Skip to content
Home » দার্শনিক ভাষণ | বিষয়: শিক্ষা | তৃতীয় পর্ব | মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

দার্শনিক ভাষণ | বিষয়: শিক্ষা | তৃতীয় পর্ব | মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

    বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার বর্তমান অবস্থা
    Redirect Ads

    আগে পড়ুনঃ দার্শনিক ভাষণ | বিষয়: শিক্ষা | দ্বিতীয় পর্ব

    কোনো কোনো দেশে, শিক্ষা, একটি শিশুকে যে-প্রক্রিয়ায় শিক্ষিত করে, তার সাথে মিল আছে কুরবানি ও পাঁঠাবলির। বলি দেয়ার সময় আমরা যেমন পশুর মতামত নিই না, শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার সময়ও, প্রণয়নকারীরা শিশুদের কোনো মতামত নেয় না। যাদের জন্য শিক্ষানীতি, তাদের কোনো কন্ঠস্বরই এ নীতিতে থাকে না। এ নীতি যারা প্রণয়ন করেন, তাদের ধারণা, শিশুরাও তাদের মতো ধাড়ী বুড়ো মানুষ। পশুবলিতে যেমন বলিদাতার ইচ্ছাই সব, শিক্ষানীতি প্রণয়নেও রাজার ইচ্ছাই সব। এ কাজে রাজা, কিছু বুড়ো শয়তানকে ভাড়া করেন, যারা কবরে যাওয়ার আগে অভিনয় করে জল্লাদের চরিত্রে।

    Download

    এ জল্লাদেরা মাস ও বছরব্যাপী পরিকল্পনা করে, কীভাবে শিশুদের পিছমোড়া করে বেঁধে, ইশকুলে পাঠিয়ে, নির্বিঘ্নে বলি দেয়া যায় শিক্ষার মন্দিরে। শিশুরা কী কী চায়, ও কী কী চায় না, কী কী ভালোবাসে, ও কী কী ভালোবাসে না, কী কী ঘৃণা করে, ও কী কী পূজো করে, এ খবর জল্লাদেরা রাখে না। রাখার কোনো প্রয়োজনও বোধ করে না। শিশুদের হয়তো ক্ষমতা আছে বছরে তিনটি বই পড়ার, কিন্তু বুড়োরা কুড়াল হাতে নিয়ে বলে— তোদের পড়তে হবে বারোটি বই! কোনো শিশুর পক্ষে কি, বারোটি বইকে ভালোবাসা সম্ভব? সম্ভব নয়। কিন্তু ইশকুলগুলো, বুড়োদের প্রেসক্রিপশনে, শিশুদের এ অসম্ভব কাজটিকেই প্রতিদিন করতে বলে।

    শিশুদের কোনো প্রশ্নও করতে দেয়া হয় না। কেউ কৌতূহলী হয়ে উঠলে, শিক্ষক তাকে সর্বশক্তি দিয়ে নিবৃত্ত করেন, এবং এ কাজে মগজের কোনো শক্তি তিনি ব্যবহার করেন না। শিশুদের হাঁটতে হয় রাজার নির্দেশিত পথে। পুরনো ভাঙা পথ ছাড়া, ইশকুলে একটি শিশুর সামনে, আর কোনো পথ থাকে না। নতুন দিগন্ত, নতুন প্রস্থান, নতুন চিন্তার বন, তাদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়। তারা যে-আকাশের নিচে বেড়ে ওঠে, তা তাদের নিজস্ব আকাশ নয়। তারা যে-স্বপ্নকে অনুসরণ করে, তা তাদের নিজের স্বপ্ন নয়। রাষ্ট্রের স্বপ্ন, সমাজের স্বপ্ন, বাবা-মায়ের স্বপ্ন, ধর্মের স্বপ্ন, এরকম হাজারো অন্যের স্বপ্ন, শিশুদের ঘাড়ে ভূতের মতো বসে থাকে। মৃত্যু ছাড়া এ ভূতের কবল থেকে, শিশুদের আর কেউ মুক্তি দিতে পারে না।

    আরও পড়ুনঃ ছাগল ও তার পিএইচডি ডিগ্রি

    নারী ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে আমি অনেককেই কথা বলতে দেখি, কিন্তু শিশুদের অধিকার নিয়ে কাউকে কথা বলতে দেখি না। এর কারণ সম্ভবত, শিশুরা লিখতে জানে না। শিশুদের হাতে কোনো মাইক নেই। কোনো পত্রিকা ও টেলিভিশনের মালিক শিশু, এরকমটি শোনা যায় না। রাষ্ট্র যারা চালায়, তারা মনে করে শিশুদের কোনো অধিকারই নেই। শিশুদের আবার অধিকার কী? তারা ভাবে, শিশুরা অবুঝ। শিশুদের কন্ঠ পাগলের কন্ঠ। পাগলদের রাখতে হবে খোঁয়াড়ে, এবং রেখে রেখে করে তুলতে হবে সুস্থ। রাষ্ট্র যেহেতু বুড়োরা চালাচ্ছে, তাই রাষ্ট্র ভাবে, একমাত্র বুড়োরাই সুস্থ। বাকিরা অসুস্থ।

    Download

    বুড়োরা এই খোঁয়াড়ের নামই রেখেছে ইশকুল। ইশকুল এক প্রকার বিনিয়োগ। চাইলে এটিকে আমি কল-কারখানার সাথেও তুলনা করতে পারি, যেরকম ‘জিপিএ ফাইভ’ প্রবন্ধে আমি ইতোমধ্যে দেখিয়েছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে জুতোর ফ্যাক্টোরির কী চমৎকার সাদৃশ্য রয়েছে।

    রাজার চোখে, শিশুরা হলো ভবিষ্যতের খাজনাদাতা, অথবা খাজনা আদায়কারী। এজন্য খারাপ রাষ্ট্রসমূহে, শিক্ষানীতি এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যেন শিশুদের পেছনে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বিফলে না যায়। শিশুদের মাথায় এমনভাবে বই, পরীক্ষা, ও আদেশ-নিষেধ চাপিয়ে দেয়া হয়, যেন তারা কোনোদিন আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকাতে না পারে।

    শিশুদের মস্তিষ্কের অবারিত বিকাশ, শিক্ষার লক্ষ্য নয়। শিক্ষার লক্ষ্য হলো, তাদের বুদ্ধিবিকাশের পথগুলো সুনির্দিষ্ট করে দেয়া। এথেন্সের ইশকুলগুলোতে শিশুদের প্রধান কাজ ছিলো, হোমারের পুঁথি মুখস্ত করা। এর কারণ কী ছিলো? পীথাগোরাসের চেয়ে হোমার কেন মুখ্য হয়ে উঠেছিলো?

    এর কারণ, আমার মনে হয়েছে, এথেন্সের সাথে স্পার্টা ও অন্যান্য শহরগুলির যুদ্ধবিগ্রহ। এথেন্সের শাসকেরা, তাদের শিক্ষানীতি তৈরি করেছিলেন যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে। একজন এথেনীয়কে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করাই ছিলো তাদের প্রধান লক্ষ্য। তবে যুদ্ধে শুধু অংশগ্রহণ করলেই চলবে না, প্রয়োজনে হাসতে হাসতে ওখানে প্রাণও দিতে হবে, এ কথা প্রচার করাই ছিলো শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। হোমারের ইলিয়াডে, আচিলিস ও হেক্টরের যে-বীরত্ব রচিত হয়েছে, তা পড়ে যেকোনো শিশুরই যুদ্ধে প্রাণ দেয়ার আগ্রহ জাগার কথা। এ প্রাণ দেয়ার ব্যাপারটিকেই তারা শিক্ষার মাধ্যমে মহিমান্বিত করেছে।

    Download

    আরও পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : লিও তলস্তয় | প্রথম পর্ব

    তারা ইলিয়াডের মাধ্যমে শিশুদের জানিয়ে দিয়েছে— জীবিত প্রাণের চেয়ে মৃত প্রাণই বেশি আরাধ্য। জীবিত আচিলিসের চেয়ে মৃত আচিলিসই অধিক সম্মানের। এথেনীয়দের এ ধারণা, আমি মনে করি, পরবর্তীতে ধার করেছিলো বিভিন্ন ধর্মের জঙ্গীরা।

    শিশুরা কৌতূহলী, কিন্তু খুব কম রাষ্ট্রই শিশুদের এ কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারে। বহু রাষ্ট্রেই, শিশুদের এ কৌতূহলকে জ্ঞানযোগে নিবৃত্ত না করে, দমন করা হয় বলপূর্বক। ভারতে যদি কোনো শিশু গরুভক্তি নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠে, তাহলে সে নিজের জন্য ডেকে আনতে পারে মর্মান্তিক পরিণতি। বাংলাদেশে কোনো শিশু, মুসলিমদের কোনো কাজকে সন্দেহের চোখে দেখবে, বা ক্ষমতাবান কোনো গোষ্ঠীর মতামতকে উপেক্ষা করবে, এটি ভাবাও যায় না। সমাজ ও রাষ্ট্র যখন কোনো শিশুর কৌতূহল নির্দিষ্ট করে দেয়, তখন ওই শিশুর আচরণে বিকৃতি আসতে বাধ্য, এবং তার বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্থ হতে পারে মারাত্মকভাবে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত— শিশুদের এ কৌতূহলকে নিবৃত্ত করা, এবং না পারলে, এ কৌতূহলকে আরও উস্কে দেয়া। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই দমন করা যাবে না।

    ইশকুলগুলো পাঠদানে, শিশুদের এ কৌতূহলকে কাজে লাগাতে পারতো চমৎকারভাবে, যদি রাষ্ট্রগুলো, তাঁদের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার সময় শিশুদের এ কৌতূহলের ব্যাপারটি মাথায় রাখতো। কিন্তু তারা তা করবে না। তারা জানে, শিশুরা যদি কৌতূহলী হয়ে ওঠে, তাহলে বড় হয়ে একদিন রাষ্ট্রের নানা বিষয় নিয়েও তারা মাথা ঘামানো শুরু করবে। এটি রাষ্ট্র যারা চালায়, তাদের জন্য হবে আত্মঘাতী, ও বিপর্যয়কর। এজন্য রাষ্ট্র সবসময়, শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের ভার, এমন সব মানুষদের হাতে দেয়, যারা নিজেরাই কৌতূহলী নন।

    Download

    সভ্যতার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, যে-দেশগুলো তাদের শিশুদের পরিচর্যা ঠিকমতো করেছে, কেবল সে-দেশগুলোই এগিয়ে গেছে ভবিষ্যতের দিকে। কারণ তারা জানে, এ রাষ্ট্র একদিন শিশুরাই চালাবে। সুতরাং শিশুদের সাথে লুকোচুরি খেলে কোনো লাভ নেই। আমরা বুড়োরা বর্তমানের মালিক, কিন্তু ভবিষ্যতের মালিক শিশুরা, এ সত্য তারা অনুধাবন করতে পেরেছে। এজন্য তারা, শিক্ষাকে শিশুদের সামনে বিষের বোতলের মতো উপস্থাপন না করে, করেছে উপাদেয় খাদ্য হিশেবে। শিশুরা এ খাদ্য খেয়ে পুষ্ট হয়েছে, যার ফলাফল ভোগ করছে রাষ্ট্র ও তার জনগণ।

    তারপর পড়ুনঃ দার্শনিক ভাষণ | বিষয়: শিক্ষা | চতুর্থ পর্ব

    লিখেছেনঃ মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

    ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

    মন্তু-টুনি, ফটিক, হৈমন্তী, বিলাসী বিহীন একটি হাহাকার প্রজন্ম ও আমাদের পাঠ্যবই

    Facebook Comments
    Tags:
    x
    error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করুন