বই: শ্রীকান্ত
লেখক: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
“একবার যে শরৎ -এ ডুবিয়াছে তার কোনো নাওয়ে উঠিবার ইচ্ছার মরণ ঘটে। “
কলেজের একজন স্যারের মুখে খানিকটা এরকম কথা শুনিয়াছিলাম। এই কথা তখন আমার বিশ্বাস হয়নি। দুইটি কারণ ছিলো। প্রথমত তিনি হলেন পুরো দমে শরৎ ভক্ত, তাই প্রিয় লেখকের সমন্ধে তার এমন ধারণা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, ইতোমধ্যেই তখন আমি শ্রীকান্ত দুই পাতা পড়ে রেখে দিয়েছিলাম।
স্কুলে পড়ার সময় একজন স্যার বলেছিলেন জীবনে আর কোনো বই পড়ো না পড়ো রবীন্দ্রনাথের “গল্পগুচ্ছ” আর শরৎ চন্দ্রের “শ্রীকান্ত” এই দুটো বই অবশ্যই পড়ো । খুব মজার বিষয় হলো এই দুটো বইয়েই হলো আমার সংগ্রহের প্রথম বই। ক্লাস সেভেন এ একটা স্কলারশিপের পুরষ্কার হিসেবে গল্পগুচ্ছ পেয়েছিলাম তাই স্যারের উপদেশ পাবার আগেই ওইসময়েই কোনো গাম্ভীর্যের ভেতর না গিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাতা উল্টানোর কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কিছু কিছু গল্প বুঝেছিলাম আর কিছু কিছু ওইসময়ের অপক্ক মস্তিষ্ক ভেদ করে চলে গেছে । কারণ তখন পর্যন্ত আমি কেবল হুমায়ূন আহমেদ, বিভূতি-ভূষণ, বিশ্বসাহিত্যের কিছু আরব্যোপন্যাস, কিছু অনুবাদ আর কিছু চিরায়ত বাংলা কিশোরোপনুয়াসে অভস্থ্য।
আরও পড়ুনঃ মহেশ গল্প – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
স্কুলের গন্ডি পার হয়ে স্যারের কথা রাখতে প্রবল উৎসাহে শ্রীকান্ত কিনে ফেলি। বস্তুত আমার সংগ্রহের প্রথম কেনা বই হলো ‘শ্রীকান্ত”। যেই উৎসাহে বইটা নিয়ে বসেছিলাম, কিন্তু দুইপাতা পড়ার পর আমার সে উৎসাহ দমে যায়। শরৎ বাবু এবং আমার শ্রদ্ধেয় সেই শিক্ষককে দুই একটা লঘু কটোক্তি করে হাতে নেই বঙ্কিমচন্দ্রের “কপালকুণ্ডলা”। শ্রীকান্ত আমাকে একপ্রকার দমিয়ে ফেলেছিলো বটে কিন্তু কপালকুণ্ডলা পড়তে গিয়ে আমি উদভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বহুকষ্টে ১৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত এসে সেই যে আটকে গেছিলাম আর বের হতে পারি নাই, এখানে সেখানেই পড়ে আছি। তখন বুঝে গেছিলাম সব খাবার সকল বয়সোপযোগী নয়। তাই তখন পুরোদমে মন দিলাম হুমায়ূন আহমেদে।
আরও পড়ুনঃ বিলাসী গল্প – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কিছু দিন পর কলেজে স্যারের সেই উক্তি শুনে ঠিক করে ফেললাম আটধাট বেধেই শরৎ বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বসবো। মাঝখানে বছর দুয়েক কেটে গেছে। এরমধ্যে অনেক বই পড়া হয়েছে, নতুন পুরাতন অনেক লেখকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, আমার পাঠক মন কিছুটা হলেও পরিপক্কতা পেয়েছে। মনে হলো এবার শরৎ বাবুর হালচাল জানা যাক। গৃহদাহ দিয়ে শুরু করেছিলাম মাঝে পরিণীতা, দত্তা, দেনাপাওনা, শেষের পরিচয়, শেষ প্রশ্ন, বড়দিদি, পল্লীসমাজ, দেবদাস, শুভদা, পণ্ডিতমশাই, অরক্ষণীয়া, চরিত্রহীন এবং শেষ হলো গিয়ে শ্রীকান্তে। পড়া শেষের পর মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যিই আমিও শরৎ-এ ডুবে গেছি এখান থেকে উঠবার আমার আর সাধ্যিও নেই, ইচ্ছাও নেই।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
শ্রীকান্ত হলো শরৎচন্দ্রের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। এটি ৪ খন্ড বিভক্ত ।
প্রথম খন্ডে শরৎচন্দ্রের শৈশব ও কৈশোরের ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। যা তার বাল্যবন্ধু ইন্দ্রকে ঘিরে ঘটনা আবর্তিত হতে থাকে, আর দেখা যায় অন্নদাদিদির মত একজন নারীকে যিনি শরৎচন্দ্রের মনে সারাজীবনের জন্য একটা গভীর প্রভাব রেখে গেছে। যিনি সংস্কার ঠেলে তার স্বামীকে মনে-প্রাণে ভালোবেসেছেন। লেখক পরবর্তী জীবনে প্রায় সকল নারীকে এই অন্নদাদিদির সাথে আগে তুলনা করে নিতেন। ১ম খন্ড আত্মজীবনীমূলক বই থেকে কিশোর উপন্যাস বেশি মনে হয়েছে। এখানে আছে রাতে নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার মত এডভেঞ্চার।
আরও পড়ুনঃ পল্লীসমাজ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
১ম খণ্ডে ইন্দ্র আর অন্নদাদিদির বর্ণনা ছাড়া আর বেশি কিছু নেই। তবে খুবই সুখপাঠ্য। ২য় খন্ডে লেখক এর সাথে দেখা হয় বাল্যকালের প্রণয়ী রাজলক্ষী বা পিয়ারী বাইজির সাথে।২য় খণ্ডের মূলত লেখকের বার্মা গমন এর ঘটনা উল্লেখ রয়েছে এখানে লেখকের নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ দেখা যায়। আর দেখা যায় সংস্কার মুক্ত দুইজন শক্তিশালী নারী চরিত্র রাজলক্ষী আর অভয়াকে। ২য় খন্ড শেষ হয় লেখকের কলকাতা প্রত্যগমন এর মাধ্যমে।
৩য় খন্ডে বলতে গেলে পুরোটাই লেখক আর রাজলক্ষীকে নিয়ে ঘটনা আবর্তিত হতে থাকে লেখকের গঙ্গাজল গমন এবং রাজলক্ষীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে নিজের মধ্যে আবার অন্তর্দ্বন্দ্ব এ ভোগার উল্লেখ রয়েছে ।
আরও পড়ুনঃ চরিত্রহীন – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪র্থ খন্ডেও এ দেখা যায় কমললতার মত সাহসী চরিত্রকে অন্নদা, অভয়া, রাজলক্ষী, পুটু, কমললতা এই চরিত্র গুলো দিয়ে সংস্কার আর কুসংস্কার এর বেড়াজাল ফুটিয়ে তুলেছেন তা এক কথায় অসাধারণ। আমার মনে হয় না আর কেউ এর আগে নারীদেরকে এতটা সম্মান দিয়েছেন যতটা শরৎচন্দ্র দিয়েছেন। যাইহোক এই বইতে শরৎচন্দ্রের রোমাঞ্চকর জীবনের বর্ণনা রয়েছে। এটি একটা অসাধারণ আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। উপন্যাসটির কিছুঅংশ গল্প হিসেবে একসময় বাংলা বইয়ে “নতুনদা” নামে পাঠ্য ছিলো।
লিখেছেনঃ Habiba Kamrun Shia
বইঃ শ্রীকান্ত [ Download PDF ]
লেখকঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা সমগ্র