গল্প: বিলাসী
লেখক: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বলি, মৃত্যুকে কি জয় করা যায়? সে যে অবধারিত! কিন্তু হ্যাঁ, সাময়িকভাবে মৃত্যুকে এড়ানো তো যায়ই। এই যে কিছুদিন বেশি বেঁচে থাকা, কিছু বেশি প্রাপ্তি -এইবা মৃত্যুকে জয় করার চেয়ে কম কিসে! এ জন্যই তো সে মৃত্যুঞ্জয়, যে মৃত্যুকে জয় করে এসেছে!
গল্পকথক ন্যাড়ার গল্পের নায়কও মৃত্যুঞ্জয়। নামটি সে বয়ে বেরিয়েছিলো বাস্তবিক জীবনেও। বাপ-মা, আপনজনহীন এই ছেলেটা পড়ত গ্রামের তৃতীয় ক্লাসে, তাকে কেউ কখনো চতুর্থ ক্লাসে যেতে দেখেনি। তার ছিল এক জ্ঞাতি খুড়ো, সে কেবল নামেই! যেই আমবাগানটা দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় তার ভরণপোষণ করতো, মূলত তার লোভ ছিল ওখানেই। আহারে মৃত্যুঞ্জয়! তার সরলমনের ফায়দা লুটে না জানি কতজন নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতো, অথচ কি ভীষনভাবেই না তারা তাকে এড়িয়েও চলতো!
আরও পড়ুনঃ মহেশ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
তো যা বলছিলাম, গল্পকথক ন্যাড়া জানতে পারে অনেকদিন হলো মৃত্যুঞ্জয় অসুস্থ্য। তার সেবা করছেন এক বুড়ো সাপুড়ে আর তার কন্যা। স্বচক্ষে দেখতেই চলে যায় ন্যাড়া। ভঙ্গুর স্বাস্থের মৃত্যুঞ্জয়কে পরম যতনে আগলে রাখা মানুষটি বিলাসী, সেই সাপুড়ের কন্যা। জীর্ণ, ভাবলেশহীন, ক্লান্ত চোখ -সবকিছু যেন নিঃশব্দে বলে যাচ্ছিলো যে কতটা সযতনে একজন শয্যাগত মানুষের মৃত্যুকে সে তিল তিল করে জয় করছিলো। সেদিন হলো দুচারটি কথা, অতঃপর গল্পকথক নিলেন বিদায়।
সেদিন ফিরার পর আর মাস দুয়েক যোগাযোগ হয়নি তাদের। একদিন ন্যাড়া শুনে মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীকে বিয়ে করেছে, কি সাংঘাতিক কথা! মিত্তির বংশের ছেলে বিয়ে করলো মালোর মেয়ে! বিয়ে করলো আবার কিনা তার হাতে ভাত খেয়ে অন্নকে অপমান করলো! ব্যাস্, তার সেই জ্ঞাতি খুড়ো পেয়ে গেলো রসদ তাদের হেনেস্ত করবার। ছেলেপুলে নিয়ে চলে গেলো উচ্ছেদ করতে! হায়রে সোনার ছেলেরা, তাদের না ছিল একজন অসুস্থ্য ব্যক্তিসহ স্ত্রীকে এভাবে ফেলে না দেয়ার বিবেক, না ছিল প্রতিবাদ করার মানসিকতা!
আরও পড়ুনঃ চরিত্রহীন – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বছরকাল পরে ন্যাড়া দেখে মৃত্যুঞ্জয় একেবারে খাঁটি সাপুড়ে হয়ে গেছে, সে রাতে কিছুটা লুকিয়ে চাপিয়ে এই ন্যাড়াই তাদের একটা গতি করেছিলো বলে! ন্যাড়া একেবারে তার মুরিদই হয়ে যায় যেন! সঙ্গে লেগে থেকে সাপ ধরা দেখে। বিলাসীর এতে কখনোই মত ছিল না! হয়তো এই অমতের কারনটা হতে পারে যে, যেই মানুষটাকে সে সুস্থ্য করেছে দিনরাত পরিচর্যা করে; যার জীবনটা পুনরায় পাওয়া তার জন্য একটা অর্জন, সেই মানুষটাকে তার হারানোর ভয় ছিল। কেমন হতো যদি মানুষের জীবনের সব শঙ্কা বৃথা হতো। কেমন হতো যদি মানুষের জীবনের সব শঙ্কা বৃথা হতো। হয়তো এই কুচিন্তা বৃথা গেলে সবাই খুশী হতো, কিন্তু ভাগ্য এত অনুকূল হয়না, অন্তত বিলাসীর ক্ষেত্রে তো নয়ই!
মৃত্যুঞ্জয় চলে যায়, তার পিতামাতার দেয়া নাম ব্যার্থ করে, বিলাসীর শুশ্রূষা বিফল করে তার মনে হৃদয় জয় করে দখল করার মত একটা সাময়িক সস্তি এনে সে চলে যায় চিরতরে! আর বিলাসী? সে কি আর জীবিত থাকে! দেহে মরেনি তো মনে মরেছে! মরণ তো হবেই! তবে আর তা থেকে দূরে থাকা কেন, আলিঙ্গন করে নরকেই নাহয় গেলো সে! সেই মৃত্যুঞ্জয়ের বিলাসী!
শরৎচন্দ্র এর বিলাসী উপন্যাসে খুব নিখুঁত ভাবে সমাজের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে মৃত্যুঞ্জয়ের ত্যাগ, সততা, ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। মৃত্যুঞ্জয় ও বিলাসীর যে প্রেম ছিল তা বর্তমানে বিরল। মৃত্যুঞ্জয় ও বিলাসীর প্রেম যেন পাথরের মধ্যে ফুল ফোটানোর চেষ্টা। বইটা পড়ার শেষের দিকে চোখ অন্ধকার হয়ে আসবে!
আরও পড়ুনঃ পল্লী সমাজ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৮৭৬ খৃস্টাব্দে, পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এই ঔপন্যাসিকের ছেলেবেলা কাটে অত্যন্ত দারিদ্রতার মধ্যে। তিনি তার জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্রতা ফুটিয়ে তুলেছেন তার অজস্র উপন্যাসে।
তাঁর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে তাকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রী প্রদান করেন। তাঁর বিখ্যাতসব উপন্যাসগুলোর মধ্যে- দেবদাস, শ্রীকান্ত, পল্লীসমাজ, গৃহাদাহ, দেনাপাওনা অন্যতম।
১৯৩৮ সালে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এই ঔপন্যাসিক পরলোকগমন করেন।
লিখেছেনঃ Sanjana Payel
গল্পঃ বিলাসী [ Download PDF ]
লেখকঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা সমগ্র