বইয়ের নাম- নকশী কাঁথার মাঠ
কবি- জসীম উদ্দীন
জনরা-কবিতা
পৃষ্ঠা-১২০
মূল্য-১২০
জসীম উদ্দীন একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি। তিনি বাংলাদেশে পল্লী কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর লেখা কবর কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় অবদান। নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট কবির শ্রেষ্ঠ দুইটি রচনা।
নকশী কাঁথার মাঠ ১৯২৯ সালে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের একটি অনবদ্য কাহিনীকাব্য। প্রকাশিত হবার পড় ই. এম. মিলফোর্ড কতৃক কাব্যগ্রন্থটি ইংরেজিতে The Field of Embroidered Quit নামে অনুদিত হয়।
আরও পড়ুনঃ অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ PDF রিভিউ কাজী নজরুল ইসলাম
বাস্তব চরিত্রঃ
গল্পের মূল নায়ক রূপাই। নাম তার “রূপা” হলেও কবির ভাষায় সে রূপার চেয়েও দামী। গ্রামের সহজ-সরল ছেলে রূপাই এর হাজারো গুণ। সে একজন পরিশ্রমী কৃষক। কৃষ্ণবর্ণের এই ছেলেটি যেমন ফসল ফলাতে পারে, তেমনি ঘর বাঁধতে পারে, আর পারে বাঁশির সুরে পুরো গ্রামের মানুষকে বিমোহিত করে রাখতে। অনেক গুণের অধিকারী এই ছেলেটি একসময় পাশের গ্রামের রূপবতী কন্যা “সাজু”র প্রেমে পরে।
নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যোপন্যাসটির রূপাই ও সাজু দুজনই ছিলেন বাস্তব চরিত্র। বাস্তব রূপাই চরিত্রের নাম ছিলো রূপা। আর সাজুর নাম ছিলো ললিতা। ললিতা রূপার বাড়ির পাশের গ্রামের ছিলেন। রূপা তাকে ভালোবাসতেন। রূপার বাড়ি ছিলো ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার শিলাসী গ্রামে৷ ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের কথায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকজ সঙ্গীত সংগ্রহ করতে জসীমউদ্দীন গফরগাঁওয়ে এসেছিলেন৷
এখানে অবস্থানকালে বনগাঁও গ্রামে জমির ধান কাটা নিয়ে একদিন বড় ধরনের এক দাঙ্গা (স্থানীয় ভাষায় কাইজ্জা) হয়৷ সেই দাঙ্গায় গফরগাঁওয়ের লাঠিয়াল দলের নেতৃত্ব দেন শিলাসী গ্রামের কৃষ্ণবর্ণের হালকা-পাতলা ছোটখাটো গড়নের যুবক রূপা৷ পল্লীকবি সেই দাঙ্গা দেখেন; দেখেন গ্রামাঞ্চলে জমি দখলের এক নারকীয় দৃশ্য৷ লাঠিয়াল দলের নেতৃত্বদানকারী রূপার তেজোদীপ্ত এক ভয়ঙ্কর বীরত্ব৷ ওই দাঙ্গাই কবির মনে রেখাপাত করে৷ নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে সেই দাঙ্গার ঘটনা৷
আরও পড়ুনঃ রূপসী বাংলা জীবনানন্দ দাশ PDF রিভিউ
কাহিনীঃ
“বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী,
উইড়া যাওয়ার সাধ ছিলো, পাঙখা দেয় নাই বিধি”
এই রাখালী গানটির মাধ্যমে বইটির শুরু। এরকম যেসব অসাধারণ কবিতার লাইন বইটিতে রয়েছে, সেগুলো না লিখলে আসলে রিভিউটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
“এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,
কালো মুখে কালো ভ্রমর, কিসের রঙ্গিন ফুল।
কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া,
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।”
গল্পের নায়ক রূপাই এর বর্ননা কবি এভাবে দিয়েছেন। পাঠকদের পড়ার সময় মুখে ছন্দের আবির্ভাব ঘটবে। ময়মনসিংহের গীতের জাদুকরী ছোঁয়া। কাঁচা ধানের পাতার মতো কচি মুখের মায়ার এই যুবকটির অনেক গুন। তার লাঠির শক্তি, কাজের দক্ষতা, বাঁশিতে সুর তোলার ক্ষমতা, বিভিন্ন খেলার দক্ষতা সবকিছুতে পিছু ফেলবার কেউ নেই।
আরও পড়ুনঃ সাম্যবাদী কবিতার মূল ভাব PDF কাজী নজরুল ইসলাম
অন্যদিকে মায়ের আদরে বেড়ে ওঠা পিতৃহীন সাজু এ কাব্যের অন্যতম চরিত্র। তার আসল নাম সোনা। সেজে বলে তাকে সাজু বলে ডাকা হতো।
“পড়শীরা কয় মেয়েত নয় হলদে পাখি ছা
ডানা পেলেই পালিয়ে যেত ছেড়ে তাদের গাঁ।”
অসম্ভব রূপবতী এই সাজুকে বদনা বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখে রূপাই। প্রথম দেখাতেই তার সমস্ত কিছু সাজুকে নিবেদন করেছে। বাঁশ কাটতে গিয়ে তার সাথে রূপাইয়ের সখ্যতা বাড়ে। তারপর ভাব ভালোবাসা। শেষ পর্যন্ত বিয়েতে গড়ায়। সাজু কে রূপাই এতদিন মন প্রান দিয়ে চেয়েছিলো। এবং আজ সে তার ঘরে। এর মাঝে গ্রামের প্রতিটা বিষয় ছন্দের সহিত এতো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে না পড়লে কোনভাবেই উপলব্ধি করা যাবেনা।
দিন গড়িয়ে যেতে লাগলো সুখে। আচমকা দুঃখের ছায়া এসে পরে তাদের ওপর। এমন সময় হঠাৎ খবর আসে, বনগেঁয়োরা তাদের গাজনা-চরের পাকা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। রূপাই ছুটে যায় লড়কি-সড়কি হাতে বনগেঁয়োদের প্রতিরোধ করতে। সেখানে লড়াই হয়, কয়েকটি খুন হয়। এক সময় হারিয়ে যায় রূপাই সাজুর জীবন থেকে। তবে যাবার আগে সাজুকে আল্লাহরে কাছে সপে দিয়ে যায়।
“সখী দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই
সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই।
মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে
তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণতলে।”
আরও পড়ুনঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনচরিত
এরি মাঝে সাজু নকশী কাঁথা বুনতে নেয়। তাতে বুনতে থাকে তাদের ভালবাসার শুরু থেকে শেষ বিদায়। সাজু মারা যাবার আগে তার মাকে বলে গিয়েছে, তার কবরের উপরে যেন বিছায়ে দেয় যেন নকশী কাঁথা। পাঠক ১৩/১৪ স্তবক পড়ে ব্যাথার বুনন ঠিকিই বুঝতে পারবে।
শেষটা করুন। বইয়ের নাম পুরোপুরি সার্থক। মুহব্বত বরাবরই নকশী কাঁথা। কাব্যউপন্যাস টা না পড়লে একটি বইয়ের নাম কিভাবে গল্প বহন করে তা বুঝতে পারতাম না….
বাংলা কাব্যের প্রকৃতি যখন পল্লীজীবনের ঐতিহ্য থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছিলো তখন পল্লীকবি পল্লীর মাধুর্যময় রূপের উপাদান দিনে আবারো পল্লীর দিকে টেনে নিয়েছেন।
“আমি হিন্দু, বেদ আমার নিকট পবিত্র। কিন্তু জসীমউদদীনের কবিতা বেদের থেকেও আমার কাছে পবিত্র। কারণ জসীমউদদীন আমার স্বর্গাদপী গীরয়সী পল্লী গ্রামের কথা তার কাব্যে লিখেছেন।”
-দীনেশচন্দ্র সেন।
বস্তুত ‘নক্সী কাথার মাঠ’ কাব্যে পল্লীর প্রকৃতি, এর নানা উপকরণ, ধর্মবিশ্বাস, সংস্কার, আচার-সংস্কৃতি ইত্যাদি বর্ণনা ফুটে উঠেছে সহজ ভাবে।
লিখেছেনঃ ফেরদৌসি রুমী
বইঃ নকশী কাঁথার মাঠ [ Download PDF ]
লেখকঃ জসীম উদ্দিন
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
জসীমউদ্দীন এর কবিতা এবং অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ সমূহ PDF ডাউনলোড করুন