বই- বোবা কাহিনী
লেখক- জসিম উদ্দিন
প্রকাশক- পলাশ প্রকাশনী
প্রকাশকাল- ১৯৬৪
পাতার সংখ্যা- ১৬৫
ধরন- সামাজিক লোকগাথা
আগে জানতাম পল্লী কবি জসিম উদ্দিন এর একমাত্র উপন্যাস বোবা কাহিনী। কিন্তু কিছুদিন আগে জানলাম ‘বোবা কাহিনী’ উনার একমাত্র উপন্যাস না। উনার আরেকটি উপন্যাস আছে। তাঁর জীবদ্দশায় সেটা প্রকাশিত হয়নি। খুরশীদ আনোয়ার জসীমউদদীন (পল্লীকবির পুত্র) তার বাবার মৃত্যুর ১৪ বছর পর সেটির পান্ডুলিপি খুঁজে পান, ও প্রকাশ করেন। উপন্যাসটির নাম ‘বউ টুবানীর ফুল’। সেটাও একটা গ্রামীণ উপন্যাস।
যাইহোক এবারের বইমেলায় গিয়ে খুঁজছিলাম কোন প্রকাশনীতে পাওয়া যায়। পলাশ প্রকাশনী নামে অখ্যাত এক প্রকাশনীতে গিয়ে পেলাম অবশেষে। বলাবাহুল্য এই প্রকাশনীতে সব জসীম উদদীনের লেখা বই-ই পাওয়া যায়। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম কবির ছেলেরাই এই প্রকাশনীটির মালিক।
যা-ই হোক বোবা কাহিনীর কথায় আসি। বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৬৫ এবং গায়ের দাম ২৫০ টাকা। এতো নিম্ন মানের কাগজ, ছাপা এবং বাইন্ডিং বাংলাবাজারের শস্তা বইগুলোরও হয়না। প্রকাশনার মান অনুযায়ী বইটির মূল্য ১৫০ টাকা হলেও বেশি।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত
“শিশিরের গয়না দিলো গায়- না দেখতেই সে গয়না উইবা যায়
কুয়াশার শাড়ী আইন্যা পরাইলো, গায়ে না জরাইতেই তা বাতাসে উরায়া নিল।
শুধু সিন্তার সিইন্দুরখানিই কপাল ভইরা আগুন জ্বাইলা রইল”
বোবা কাহিনী বইটার রিভিউ লিখতে গিয়ে আমার মাথায় একটা চিন্তা কাজ করছিলো, বইটার কাহিনী এত সরল এটার রিভিউ লিখবো কিভাবে। তারপরেই এই কথাটা চিন্তা করলাম বোবা কাহিনী বইটা বাঙালী গ্রামীন সমাজ, সংস্কৃতির একটা জাদুঘর। এই বইটার রিভিউ না লিখা গেলে কোন বইয়ের রিভিউ লিখা সম্ভব নয়।
প্রায় সময়েই অনেক বইপোকারা বাংলাদেশের গ্রামীন সমাজ সম্পর্কে জানার জন্য কোন বই ভালো হবে জানতে চান। আমি বলবো নিঃসন্দেহে বোবা কাহিনী বইটা পড়ুন। একেবারে শতভাগ বাঙালিদের গ্রামীন জীবন যাত্রার কথা তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে।
আরও পড়ুনঃ হাজার বছর ধরে উপন্যাস জহির রায়হান PDF রিভিউ
কাহিনীঃ
আজাহের অনাথ, সহায়সম্বলহীন এক যুবক, মা-বাবার কথা যার মনেও নেই। গ্রামের মাতব্বর দয়া করে থাকার জায়গা দেন, বিয়েও করিয়ে দেন। নতুন বউ নিয়ে সংসার শুরু করে আজাহের। কিছুদিনের মধ্যেই পরিশ্রমী আজাহের তার শ্রমের দ্বারা বেশ কয়েক বিঘা জমি, হালের গরু, গোলায় ধান তুলে ফেলে।
এরই মধ্যে আজাহের এর দুটি ছেলেমেয়ে হয় বছির ও বাড়ু। আজাহের এর যেনো স্বপ্নের দিন কাটছিলো। এক সুদখোর মহাজনের চক্করে পরে স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি খুইয়ে একেবারে পথে এসে দাড়ায় আজাহের। হঠাৎ করেই যেনো আবার আগের অবস্থানে চলে আসে আজাহের।
স্ত্রী পুত্র, কন্যা নিয়ে আবার জীবন যুদ্ধ শুরু করতে পারি জমায় গহীন অরন্য ঘেরা অপরিচিত এক গ্রামে, যেখানে ম্যালেরিয়া, কলেরা সহ নানান ব্যাধি লেগেই থাকে। আশ্চর্য এই গ্রামে কপর্দকশুন্য আজাহের কে গ্রামবাসী স্বাদরে গ্রহন করে এবং গ্রামবাসীরা মিলে আজাহেরকে ঘর তুলে দেয় চাষবাস এর জমি দেয় আপন করে নেয় তাদের মতন করে। আজাহের এর দুই ছেলেমেয়ে সারাদিন বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, নানান ফুল তুলে, ফল পাড়ে। এ যেন এক অন্য ভুবন।
আরও পড়ুনঃ নকশী কাঁথার মাঠ রিভিউ PDF জসিম উদ্দিন
এবারেও আজাহের এর কপালে সুখ সইলোনা, কলেরা হয়ে চিকিৎসার অভাবে তার মেয়ে মারা যায়। বোনের কবরের সামনে দাড়িয়ে ভাই বছির প্রতিজ্ঞা করে ডাক্তার হবার।
গরীবের ছেলে বছির এর ধারনা ছিলোনা যে পড়ালেখা করতেও অর্থের প্রয়োজন। শুরু হয় আজাহের এর পুত্র বছিরের জীবন যুদ্ধ। প্রথমে এক উকিলের বাড়িতে থেকে পড়ালেখা শুরু করে বছির, উকিলের কার্যাবলীর সাথে সহমত না হওয়ায় উকিলের আশ্রয় হতে বিতারিত হতে হয়। নানান জায়গায় ঘুরতে থাকে শুধু আশ্রয় আবার খাবারের জন্য, উকিল সাহেবের শত্রুকে কেও আশ্রয় ও দিয়ে, নিজের বিপদ ডেকে আনতে চায় না। চলতে থাকে টিকে থাকার সংগ্রাম।
বছির কি পারবে তার মৃত বোনের কাছে করা প্রতুশ্রুতি রক্ষা করতে???? যেখানে আজাহের এর পুত্র দেশেই পড়ালেখার করার কোন আশ্রয় পাচ্ছেনা, সে কিভাবে বিলেত যাবে উচ্চশিক্ষার জন্য?????? উত্তর জানতে বইটি পড়তে হবে।
আরও পড়ুনঃ সোজন বাদিয়ার ঘাট PDF রিভিউ | জসিম উদ্দিন
পাঠ প্রতিক্রিয়া-
প্রথমেই আমার বুবুর প্রতি ক্ষোভ জানাচ্ছি এত সুন্দর একটা বই এতদিন পরে পড়তে দেওয়ার জন্য। আমি ঢাকার ছেলে হলেও বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুড়ার সুযোগ হয়েছে আমার।
বইটি পড়ে আমি যেনো বারবার নিজের শৈশবে ফিরে যাচ্ছিলাম, বনের মধ্যে নাম নাজানা ফুল কুড়ানো, নদীতে গোসল, শীতের রাতে খেজুরের রস চুরি, প্রতিবেশীদের ডাব নারিকেল চুরি, কলা গাছের ভেলায় ঘুরে বেরানো, চাদের আলোয় গ্রামের মেঠো পথে সাইকেল চালানো, পালকীতে বউ আনা দেখা। এইসব অভিজ্ঞতাই হয়েছে আমার। ঢাকার ছেলে হিসেবে যা খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জুটে। বইটার একেক পাতা পড়ছিলাম আর স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম।
বাংলাদেশের গ্রামীন সমাজের মানুষের প্রতি মানুষের দরদ, পুরানো প্রবাদ, জারিগান, শারিগান, গ্রামের বিয়ে, তাদের সমাজ সংস্কৃতির সবই ফুটে উঠেছে বইটাতে। জসিম উদ্দিন কত গভীরভাবে এইদেশ এই মাটিকে ভালোবেসেছেন সেটা বইটা পড়লেই বুঝা যায়।
পাঠকদের যদি হাজার বছর ধরে, পদ্মা নদীর মাঝি, পদ্মার পলিদ্বীপ, উপন্যাসগুলো পড়া থাকে তাহলে এই বইটা কোনভাবেই মিস করবেন না। নিশ্চয়ই সেগুলো পড়ার পর যেমন অনুভূতি হয়েছিলো, এইটাতেও সেরকমই পাবেন।
আরও পড়ুনঃ জীবন কথা PDF রিভিউ | কবি জসিম উদ্দিনের আত্মজীবনী
প্রিয় উক্তি:
“সুন্দর ওহে শ্যামল সুন্দর। “
“ওপারেতে লঙ্কা গাছটি রাঙা টুকটুক করে,
গুনবতি ভাই! আমার মন কেমন করে
হাড় হৈলো ভাজা ভাজা মাংস হৈল দড়ি,
আয়রে কারিন্দার পানি ডুব দিয়া মরি।”
“নাইকা মাতা, নাইকা পিতা, নাইকা সোদ্দের ভাই,
সোতের শেহলা হইয়া ভাসিয়া বেড়াই।”
উড়িয়া যায় হংস পক্ষী পড়িয়া রয় ছায়া।
দেশের মানুষ দেশে যায়, পড়িয়া থাকে মায়া।
লিখেছেনঃ Saiful Islam Nadim
বইঃ বোবা কাহিনী [ Download PDF ]
লেখকঃ জসীম উদ্দিন
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
জসীমউদ্দীন এর কবিতা এবং অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ সমূহ PDF ডাউনলোড করুন