বই: ঝরা পালক
ধরণ: কাব্যগ্রন্থ
কবি: জীবনানন্দ দাশ
প্রকাশকাল: ১৯২৭ খৃষ্টাব্দ
গাত্রমূল্য: এক টাকা (তৎকালীন)
গাহি মানবের জয়!
কোটি কোটি বুকে কোটি ভগবান আঁখি মেলে জেগে রয়!
সবার প্রাণের অশ্রু-বেদনা মোদের বক্ষে লাগে,
কোটি বুকে কোটি দেউটি জ্বলিছেকোটি কোটি শিখা জাগে,
প্রদীপ নিভায়ে মানবদেবের দেউল যাহারা ভাঙে,
আমরা তাদের শস্ত্র, শাসন, আসন করিব ক্ষয়!
জয় মানবের জয়!
কি? নজরুল? না। জীবনানন্দ। পাক্কা।
প্রথমত, ঐতিহ্য প্রকাশিত ‘ জীবনানন্দ রচনাবলী ‘র প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। প্রতিটি খন্ডে আছে আলাদা করে কাব্যগ্রন্থ, কিছু গল্প, একটা বা দুটো উপন্যাস, প্রবন্ধ, গ্রন্থের বাইরের কবিতা, আর সবশেষে সবচে দরকারি জিনিস- গ্রন্থপরিচয়, পরিশিষ্ট।
শাহাদুজ্জামানের ‘একজন কমলালেবু‘ পড়ছিলাম, যেটা উপন্যাসচ্ছলে জীবনানন্দ দাশের জীবনী । লেখক যতখান থেকে তথ্য পেয়েছেন, গুছিয়ে উপস্থাপন করেছেন কাহিনী আকারে।
পেছনের গল্প
এই যে ‘ ঝরা পালক ‘, কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ, তার পেছনের গল্পটা কবির জীবনে যথেষ্টই গুরুত্ববহ। দুই বইয়ের তুলনা করে দেখলাম, জীবনানন্দ রচনাবলী -তে পেছনের ঘটনা যতটা জানা সম্ভব, আলোচিত হয়েছে। বিশেষত জীবনানন্দের ক্ষেত্রে এইটুকু বেশ দরকারি ছিল। কেন? শুনুন তবে।
জীবনানন্দ দাশ, এই বিষন্ন বাজিকর মানুষটা যত ভেল্কি রেখে গেছেন, দেখিয়েছেন তার সামান্যই। মূলত কবি পরিচয়ের মানুষটার মৃত্যুর পর তার গুপ্তধনসম কয়েকটা ট্রাঙ্ক থেকে যা বের হয়েছিল, তার মর্মোদ্ধারে লেগে ছিলেন কবির বোন সুচরিতা, ভাই অশোকানন্দ, পরে এসে দেবেশ রায়, শঙ্খ ঘোষ, আফসার আহমেদ, আর সর্বাগ্রে ডাক্তার ভূমেন্দ্র গুহ যিনি শেষ বয়েসটা পুরো জীবনানন্দের পান্ডুলিপির ওপর আতশকাঁচ এঁটে বসে থেকে আমাদের এনে দিয়েছিলেন প্রায় আড়াই হাজার কবিতা, শতাধিক গল্প, গোটা বিশেক উপন্যাস, পঞ্চাশটির ওপর প্রবন্ধ। এজন্যই হয়তো, জীবনানন্দ রচনাবলী প্রতি খন্ডে কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও সংযোজিত ‘অন্যান্য কবিতা’র পরিধি সব মিলিয়ে সব কাব্যগ্রন্থের চেয়েও অনেক বেশিই।
আবিষ্কারে আরও ছিল প্রায় চার হাজার পৃষ্ঠার ডায়েরী, যাকে তিনি বলেছেন ‘Literary Notes’ (কেবল এই বস্তুটাই রচনাবলিতে নাই! আফসোস!)। ১৯১৯ সালে প্রথম কবিতা ছাপা হলো তাঁর, মায়ের পছন্দের ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায় তাঁরই অনুরোধে…সেই কবিতার পর গেল দীর্ঘ, দীর্ঘ নিরবতা। ওই নিরব সময়ের একান্ত কোমর-বাঁধা প্রস্তুতিরই অংশ ‘লিটেরারি নোটস’। সাহিত্য ধারায় আলোড়ন ফেলে দেওয়া এই কবির প্রথম কবিতাটা প্রকাশিত হয় তাঁর বিএ পাসেরও পরে, আর তার পর ছয় বছরের নিরবতার পর সাহিত্যে আত্নপ্রকাশের দলিল, জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক ।
আরও পড়ুনঃ জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা সমগ্র PDF রিভিউ
তখন ১৯২৭ সাল, নব্য অখ্যাত লেখক জীবনানন্দ পত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা তার কবিতাগুলো নিয়ে বই বের করতে চাইছিলেন। কোনো প্রকাশক না পেয়ে শেষে নিজ খরচেই বই বের করলেন, নাম ” ঝরা পালক “। প্রথম কবিতায়ই লিখেছেন:
“আমি কবি, সেই কবি__
আকাশের পানে আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!”
তো, প্রথম আত্নপ্রকাশে ‘সভা-কবিদে’র রোষেই পড়তে হয়েছিল তাকে। সাময়িক কবি সমালোচকরা বটেই, এক কপি ঝরা পালক আর কবির চিঠি পেয়ে বরাবর সবার প্রশংসা করা শান্ত রবীন্দ্রনাথও জবাব পাঠিয়েছিলেন,
“কল্যাণীয়েষু,
তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নাই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারি নে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহাসিত করে।
বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখাবো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উলটো।
ইতি
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
জীবনানন্দ বরিশালের মানুষ। বরিশালের ভাষায় একটা কথা আছে, “ক্যান, ঠেকলাম কিসে, আমি কারো মাহা(মাখা) তামাক খাই?” জীবনানন্দ ঠিক তেমনি ‘ঠেকলাম কিসে’ ভঙ্গিতে শ্রদ্ধাসহ চিঠিতে ভেঙে দিয়েছেন গুরুদেবের যুক্তি।
সে অনেক কথা। না কবির প্রথম বই ছিল আর সব কবিতার মতো, না মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল অনুকূল। চাকরি হারালেন, তীব্র সাহিত্য-সমালোচনা সইলেন। বেরসিক সমালোচকেরা ‘জীবানন্দ’ নামেও ডাকলো কয়দিন। এগিয়ে এসেছিলেন কেবল বুদ্ধদেব বসু। সে কাহিনী কবিতা-পাঠকদেরও অল্পবিস্তর পড়া চাই, তবে আজকে কেবল ঝরা পালকের কথাই বলে যাব।
একে একে বনলতা সেন, সাতটি তারার তিমির, মহাপৃথিবী পড়ার পর ঝরা পালক ধরে মনে হলো- এ নেহায়েত আলাদা। না, সাতটি তারার তিমিরের মতো আলাদা না, বরং প্রথম কবিজীবনের অপরিণতাবস্থার জন্য আলাদা। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উপস্থিতি ছাড়াও নজরুলের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল।
আরও পড়ুনঃ জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী লাবণ্য দাশ এর লেখা বই “মানুষ জীবনানন্দ”
কাজী নজরুল ইসলাম vs জীবনানন্দ দাশ
এই যে, কাজী নজরুল ইসলাম আর জীবনানন্দ দাশের তুলনাটা মজারই দেখাবে। দুজনে একই সময়ের কবি, জন্ম ১৮৯৯ সালেই। একই সমাজের পরিবর্তনে দুজনের প্রতিক্রিয়া হলো বিপরীত। নজরুল হয়ে উঠলেন উদ্দাম, বিপ্লবী, উচ্চকণ্ঠ আর জীবনানন্দ হয়ে গেলেন নির্জন, নিভৃতচারী, নিম্নকন্ঠ। নজরুল যেখানে ময়দান কাঁপাচ্ছেন, নিরবে জীবনানন্দ স্নায়ুতাড়িত হয়ে নিজের ভান্ডার সাজাচ্ছেন। পূর্ব বঙ্গে বেড়ে ওঠা জীবনানন্দ মৃত্যুর আগে স্থানান্তরিত হন পশ্চিমবঙ্গে, আর পশ্চিমের নজরুলের শেষ ঠাঁই এই বাংলাদেশ।
এই যে, নজরুল হয়ে গেলেন আমাদের জাতীয় কবি, এই সবই রাজনীতির খাতিরে, তাতে দুই কবির ওপর দুই বাংলার দাবি কমে না। সম বয়সী কবিদ্বয়ের কখনো দেখা হয় নি, বহির্মুখী ব্যক্তিত্বের নজরুলের সাথে জীবনানন্দ ঘেঁষতেও চান নি, কিন্তু ঝরা পালকের জীবনানন্দকে ভালোমতোই নজরুল-প্রভাবিত মনে হয়েছিল আমার।
একাকী রয়েছি বসি,
নিরালা গগনে কখন নিভেছে শশী
পাইনি যে তাহা টের!
দূর দিগন্তে চলে গেছে কোথা খুশরোজী মুসাফের!
কোন সুদূরের তুরানী প্রিয়ার তরে
বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে!
দীর্ঘ দিবস বয়ে গেছে যারা হাসি-অশ্রুর বোঝা
চাঁদের আলোকে ভেঙেছে তাদের ‘রোজা’,
আমার গগনে ঈদরাত কভু দেয়নি যে হায় দেখা,
পরানে কখনো জাগেনি ‘রোজা’র ঠেকা
নজরুল বলে ভুলটা যে কেউ করবেই।
সমবয়সী দুই কবির যোগাযোগটা কেবল এখানেই না, আরো ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে, পুজোর আগে ‘দৈনিক স্বরাজ’ পত্রিকা নজরুল-সংখ্যা প্রকাশ করেছিল, যার রবিবারের পাতার সম্পাদক ছিলেন জীবনানন্দ। নজরুল তখন স্মৃতিশক্তিরহিত, আর জীবনানন্দ খ্যাতিতে তাঁর কাছে না পৌঁছালেও কবি, তাই তাকে সম্পাদক হিসেবে নজরুলকে নিয়ে লিখতেই হতো। ‘নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক সে রচনাটি প্রকাশিত আর হয়নি, প্রুফই রয়ে গিয়েছিল; এবং এই প্রবন্ধটিই শেষ বিচারে অন্যান্য কারণের সাথে যুক্ত হয়ে ‘স্বরাজ’এর চাকরি থেকে জীবনানন্দের বরখাস্ত হওয়ার উপলক্ষ্য হয়ে ওঠে।
আর নজরুল?
কবি আবুল হোসেন একবার কথায় কথায় নজরুলকে বলেছিলেন,
“জীবনানন্দ দাশ তো বলেন উপমাই কবিতা। আপনার কি মত?” নজরুল হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, “তোমাদের এখন আর ‘মা’তে হচ্ছে না, ‘উপ’মা দরকার?”
কখনো দেখা না পাওয়া জীবনানন্দকে নজরুল কখনোই গুরুত্বের সাথে নেন নি।
আরও পড়ুনঃ রূপসী বাংলা জীবনানন্দ দাশ PDF রিভিউ
কিছু ভিন্ন কথায় যাই। আচ্ছা, আপনার পছন্দের মানুষটির জন্যে উপহার কিনে, পাঠানোর ঠিক আগের মূহুর্তটায় আপনার কেমন লাগে? কি লিখে দেবেন, ভেবে দ্বিধায় থাকেন কিছুক্ষণ? শূন্যতা, অন্ধকার- এই সব বিষয়গুলো জীবনানন্দের অনুষঙ্গ ছিল সবসময়ই। ঝরা পালকের উৎসর্গাংশে কেবল লেখা ছিল, ‘কল্যাণীয়াসুকে’। ধারণা করা যায়, অবিবাহিত কবির জীবনে তখন যাকে নিয়ে দোলাচাল ছিল, আত্নীয়া শোভনা দাশ, তিনিই এই কল্যাণীয়াসু, প্রথম কাব্যগ্রন্থ কবি দিয়েছেন তাকেই। ‘কল্যাণীয়াসু’র আগে যে ‘ড্যাশ ()’ টি দেওয়া হয়েছে, তার মাঝে যেন লুকোনো আছে শোভার সাথে দূরত্বের আর অপ্রাপ্তির ব্যাঞ্জনা! ড্যাশ চিহ্নের ব্যাবহার কবির নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য তৈরী করেছে কবিতায়। দুঃখজনকভাবে, আমাদের ব্যবহার্য বাংলা কিবোর্ড থেকে ড্যাশ উধাও হয়ে যাওয়ায় আমরাও বাংলা সাহিত্যে ‘ড্যাশ’ এর এক্সপ্রেশনটা হারাচ্ছি দিন দিন।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত
শেষ কথা
চেনা জীবনানন্দের চেয়ে তুলনামূলক সহজ, ভিন্ন জীবনানন্দকে পাওয়া যাবে ঝরা পালকে। লাইনে লাইনে ছন্দ ঠিক রাখা কবিতা তার অন্য কাব্যগ্রন্থে দেখি না। উপমার ব্যবহার মূল অস্ত্র হিসেবেই ছিল, কিন্তু উপমা আর ভাব নিয়ে কবি পরবর্তীতে যেভাবে খেলেছেন, অবাক করা ভাবালুতায় ভুলিয়েছেন আমাদের, প্রথম কাব্যগ্রন্থে কিন্তু তেমনটি তিনি করতে পারেননি।
পেছনের কথা ঘাঁটতে গিয়ে নিজের মিল আমি খুঁজতে চেয়েছি, স্বাভাবিকভাবে আপনিও চাইবেন। প্রথম একটা প্রকাশিত কবিতা, তার পর বছর বছরের গ্যাপ, কিছু দোনামোনা- এই সবই নব্য সাহিত্যিকের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আদতে নিজের প্রস্তুতি গুছিয়ে আনা, বই প্রকাশ করা, সমালোচকদের ‘মুগুরের বাড়ি’ আর জীবনযুদ্ধ ঠেলে এরপরের জীবনানন্দ দাশের বের হয়ে আসাটাই হলো আসল কথা। এখানে এসেই নব্য সাহিত্যিক আর প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের পার্থক্যটা তৈরী হয়!
ধন্যবাদ শাহাদুজ্জামানের ‘একজন কমলালেবু’কে। ধন্যবাদ ঐতিহ্যকেও, জীবনানন্দ রচনাবলী ‘র মতো উপযোগী উদ্যোগটি গ্রহণ করার জন্য।
সবার পঠন-পাঠন সুখের হোক।
লিখেছেনঃ মুসাইয়্যিব বিন মুজিব
বইঃ ঝরা পালক [ Download PDF ]
লেখকঃ জীবনানন্দ দাশ
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
জীবনানন্দ দাশ রচনাবলী PDF ডাউনলোড করুন