হাজার বছর ধরে উপন্যাস জহির রায়হান pdf রিভিউ| Hajar Bochor Dhore Zahir
বইঃ হাজার বছর ধরে
লেখকঃ জহির রায়হান
কথায় আছে , “বউ আর ঢোল এই দুই জিনিস সারাক্ষণ মাইরের উপর রাখতে হয়”। আবুলের ঢোল নেই তবে বউ আছে। তাও একটা না, তিন তিনটা! প্রথম দুইটা আবুলের এমন স্বর্গীয় আদর-সোহাগে অক্কা পেয়েছে। তৃতীয়টার নাম হালিমা। সেও যে আর কতদিন টিকবে, খুব শক্ত করে তা বলা যাচ্ছে না! পৃথিবীতে বউ পেটানোর এই একটা কাজেই কেবল আবুল পৈশাচিক আনন্দ পায়। এইটাকে সে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অবশ্য আগের দুই বউকে মারা আর বর্তমান বউকে মারার পেছনে কারণ ভিন্ন। কি সেই কারণটা?
ছোটছোট অনেকগুলো ঘর একসাথে মিলে শিকদার বাড়িটা। এই বাড়ির কর্তা হচ্ছে মকবুল। তার বর্তমানে বউয়ের সংখ্যা তিন। আমেনা বিবি, ফাতেমা বিবি আর টুনি বিবি। সেও বউ পিটায়, তবে এক্ষেত্রে তার দর্শণটা আবুলের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। তার হিসাবে চার চারটা টাকা খরচ করে বিয়ে করে বউ তো আর শিকায় তুলে রাখার জন্য আনা হয়নি! মাইর দিতে হবে তবে, তবে … কি সেই মহান দর্শণটা ?
মন্তু মিয়া মকবুলের চাচাতো ভাই। ছোটবেলায় বাপ-মা মরার পর সে মকবুলের সংসারেই থাকে, খায়, আয় রোজগার যা করে সব এই সংসারেই দেয়। মকবুলের ছোটো বউ টুনি সম্পর্কে মন্তুর ভাবি হয়। অবশ্য মন্তু টুনিকে ভাবি বলে ডাকে না। টুনির সাথে তার অন্যরকম ভাব-ভালবাসা আছে। একটা অন্যরকম সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কের সঙ্গা কিংবা পরিনতি কি, তা তাদের দুইজনের কেউই জানেনা। অবশ্য কিছু সম্পর্কের কোন নাম হয় না। টুনির বয়স আর কতই বা হবে, এই বার কি তেরো। মকবুলের মেয়ে হিরণের সমান।
আরও পড়ুনঃ জহির রায়হানকে নিখোঁজ করলো কারা?
শিকদার বাড়ি সহ পুরো গ্রামটা যখন ঘুমিয়ে পড়ে, ধল প্রহর যখন নামি নামি করে, পুব আকাশে শুকতারা যখন উঠে যায় তখন টুনি আর মন্তু চুপেচুপে বেরিয়ে পড়ে রোজ। মকবুল তার কিছুই জানে না। কোনদিন জানতে পারলে মেরেই ফেলবে নিশ্চিত। কোন কোন রাতে তারা বিলে শাপলা তোলে, মালা গাঁথে, মাঝেমধ্যে আবার অন্যের পুকুরের মাছ চুরি করে। এতে দুজনই খুব মজা পায়। এরকম একরাতে তারা মাছ চুরি করতে গেল জমির মুন্সির পুকুরে। যেইনা মন্তু জাল ফেলেছে অমনি জমির মুন্সি এসে হাজির! এবার? কি হয়েছিল সে রাতে ?
নন্তু শেখের মা মরা ষোড়শী মেয়ে আম্বিয়া। ঢেকিতে ধান বানার সময় যখন সে “স্বপ্নে আইল রাজার কুমার, স্বপ্নে গেল চইলা। দুধের মত সুন্দর কুমার কিছু না গেল বইলা।” গানে টান দেয়, মনে হয় পুরো গ্রামটা আনন্দে নেচে ওঠে। তার মায়াকাড়া চোখ দুটোর দ্যুতি ছড়িয়ে আছে সারা মুখ জুড়ে। আঁটসাঁট দেহের খাঁজে খাঁজে তার দুরন্ত যৌবন, আট হাত শাড়ির বাঁধন ছিড়ে ফেটে পড়তে চায়। সে দিকে মন্তু মিয়ার চোখ আঠার মতো লেগে থাকে। আবার মন্তুকে দেখলেই আম্বিয়ার মধ্যে কি যেন কি হয়ে যায়! সে নিজেও বুঝতে পারেনা! কেন এমন হয়?
আরও পড়ুনঃ মন্তু-টুনি, ফটিক, হৈমন্তী, বিলাসী বিহীন একটি হাহাকার প্রজন্ম ও আমাদের পাঠ্যবই
নৌকা বাইতে বাইতে মন্তুর মনটা বড্ড উদাস হয়ে ওঠে! আপনা আপনি গান ধরে-
“আশা ছিল মনে মনে…
প্রেম করিব তোমার সনে।
তোমায় নিয়া ঘর বান্ধিমু…
গহীন বালুর চরে গো,
গহীন বালুর চলে ….”
কার সাথে প্রেম করার আশা মন্তুর? টুনির সাথে? গহীন বালুর চরে কাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চায় মন্তু? আম্বিয়াকে নিয়ে?
মকবুলের এগারো বছরের মেয়ে হিরণের বিয়ে, বিয়ের মোহরানা, আম্বিয়ার সাথে মন্তুর বিয়ে নিয়ে টুনির অস্বাভাবিক আচরণ, গ্রামে ওলা বিবির আক্রমণ, মকবুলের ভিমরতি, টুনি বিবির ক্রমাগত ষড়যন্ত্র নিয়ে গল্প এগিয়ে চলছে। চলছে তো চলছেই। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! শেষপর্যন্ত কি হয়, তা জানার জন্য বইটা আপনাকে পড়তে হবে।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত
বই বৃত্তান্তঃ
জহির রায়হানের ” হাজার বছর ধরে ” বইটি অনুপম প্রকাশনী প্রথম ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়। ৬৪ পৃষ্ঠার এই বইটার দাম ৪০ টাকা।
নিজস্ব রেটিংঃ ৯|১০
মতামতঃ বাংলা সাহিত্যের অল্পকিছু বিখ্যাত উপন্যাসের একটি হল হাজার বছর ধরে । আমার কাছে মনে হয় জসীম উদ্দীনের পর গ্রাম আর প্রকৃতির বর্ণনায় জহির রায়হানের কলমই বেশি মজবুত। এই বইটা তারই প্রমাণ।
বইটাতে মকবুলের চরিত্র আমাদের এককালেরর হাজার বছরের পুরুষের চরিত্রটিই ফুটে উঠেছে। এর বাইরে মন্তু, টুনি আর আম্বিয়ার চরিত্রগুলা অসাধারণ! তবে টুনির শেষটা আরেকটু সুন্দর হলেও পারতো। এছাড়া সব ঠিকাছে।
লিখেছেনঃ S Tarik Bappy
পর্যালোচনা
উপন্যাসের শেষের দিকে একটি উক্তি পাওয়া যায়, যেখানে টুনি মন্তু মিয়াকে বলে-
“তা আর অয়না মিয়া, তা আর অয়না…”। কিন্ত কেন হয়না? সে প্রশ্ন অনেকের মনে থেকেই যায়। আর সেটার গভীর বিশ্লেষণে পাওয়া যায়ঃ
(নিচের অংশটিতে গল্পের স্পইলার থাকতে পারে, তাই পুরু উপন্যাসটি পড়ার পর এই অংশটি পড়ার অনুরোধ করছি, তাহলে সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করতে পারবেন।)
মন্তু হয়তো টুনিকে মনে মনে চাইতো কিন্তু সে এটা কখনোই সেভাবে টুনিকে বুঝতে দেয়নাই।। টুনি যদিও কিছুটা বুঝতে পারে।। তাই টুনি প্রায়ই এই ব্যপারে মন্তুকে পরোক্ষভাবে পিঞ্চ মারে।। কিন্তু মন্তু ব্যপারটাতে সায় দেয়না সমাজের কথা এবং মকবুলের কথা ভেবে।
কিন্তু মকবুলের মৃত্যুর পরে মন্তু টুনিকে বিয়ের কথা বললে টুনি রাজি হয়না। কারন তখন টুনি সমাজে একজন নারীর স্থান বিশেষত একজন বিধবা নারীর অবস্থান উপলব্ধি করতে পারে।। সে বুঝে যে এই বিয়ে হলে তাকে এবং মন্তুকে অনেক কথা সহ্য করতে হবে এমনকি সমাজচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনাও আছে।।
আসলে লেখক ‘হাজার বছর ধরে‘ নামকরনের কারন হল, এই বাংলায় (মুঘল) নবাব, জমিদার, ইংরেজ শাসন ছিল এবং সব শেষ পাকিস্তান শাসন এলো কিন্তু গ্রামীন সমাজের কোনো পরিবর্তনই হয়নি।। এই গ্রামীণ সমাজ আধুনিতা, শিক্ষা থেকে অনেক দূরে। এই সমাজ ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন।। যা হাজার বছর ধরেই অপরিবর্তিত রয়েছে।। কিন্তু কেউ এই দিকে নজর দেয়না।।
আর টুনির, মন্তুকে বিয়ে না করার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে যে আজও গ্রাম বাংলায় একজন নারীর অবস্থান কতটা ঠুনকো।। আর একজন যৌবনা বিধবার আরেকটা বিয়ে করে সংসার করা কতটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এই সমাজে।।
বইঃ হাজার বছর ধরে [ Download PDF ]
লেখকঃ জহির রায়হান
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
জহির রায়হানের অন্যান্য বইসমূহ