সাতকাহন সমরেশ মজুমদার PDF রিভিউ | Satkahon by Samaresh Majumdar
পঞ্চাশের দশকের ছোট্ট দস্যি মেয়ে দীপাবলি। বয়স মাত্র ১০। চা বাগানের কোয়াটার্সে দীপা তার পরিবারের সাথে বসবাস করে। তার বাবা অমরনাথ চা বাগানে চাকরী করেন। মা অঞ্জলি সংসার দেখাশোনা করেন। সাথে সামলায় দীপার ছোট দুই ভাইকে। তার ঠাকুমা মনোরমা ধর্মকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। বাড়ির কাজে সাহায্য করে বুধুয়া নামের এক লোক। এভাবেই শুরু সাতকাহন উপন্যাস।
দীপাকে নিয়মের মধ্যে বেধে রাখা দায়। দুই সহপাঠী খোকন আর বিশুর সাথে বনে বাদাড়ে ঘুরে ফিরে সময় কাটায় যখন তখন। বাড়ন্ত বয়সের মেয়ে এভাবে ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ানোটা কেউ ঠিক চোখে দেখে না। এজন্য মা আর ঠাকুমার বকুনি খেতে হয় তাকে প্রতিদিন। কিন্তু বাবার আদর সব ভুলিয়ে দেয়।
দীপা তখনো জানতো না যাদের এতকাল বাবা মা বলে জেনে এসেছে তারা তার আপন বাবা মা না। দীপার মা তার জন্মের সময় মারা যায়। সেই শোক সহ্য করতে না পেরে তার জন্মদাতা তাকে ফেলে রেখে যায় তার শ্যালিকা ও শ্যালিকার স্বামীর কাছে। অর্থাৎ, দীপা জানে যাদের মা বাবা জেনে বড় হয়েছে সে তার মাসিমা আর মেসো। যাকে ঠাকুমা বলে জানে তার সাথে দীপার রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। অথচ কোনদিন সে তার ভিন্ন কিছু ভাবার কারন পায়নি।
দিনকাল ভালোই চলছিলো। হঠাৎ একদিন দীপার বিয়ের জন্য প্রস্তাব পায় অমরনাথ। কিন্তু মেয়েকে এখন বিয়ে দিতে রাজি না সে। তার ইচ্ছা মেয়ে লেখাপড়া করবে। কিন্তু পরিবারের অন্যদের ও সমাজের লোকজনের নানান কথায় অবশেষে রাজি হয় সে। দীপাকে জানানো হয় তার আসল পরিচয়। মুহূর্তেই যেন বদলে যায় সবকিছু। কিন্ত তখনো কেউ বুঝেনি এসব এক বিশাল ঝড়ের শুরু মাত্র…..
প্রতুল বন্দোপাধ্যায়ের রোগা ছেলে অতুল বন্দোপাধ্যায়ের সাথে বিয়ে পাকা হয়ে যায় দীপার। বিয়েও হয়। কিন্তু বিয়ের ৩য় মাথায় বিধবা হতে হয় দীপাকে।
এ ধাক্কা সামলে উঠে আবারো সামনে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে দীপা। যদিও বিধবাদের মতো নিয়ম অনুযায়ী জীবন যাপন তার পছন্দ না। তবুও ঠাকুমার জন্য মেনে নেয়। তার প্রিয় শিক্ষক সত্যসাধন মাস্টারের অনুপ্রেরনায় শুরু করে লেখাপড়া। এভাবেই শুরু হয় মূল গল্প।
কিন্তু যতই দিন যায় কাছের মানুষগুলো যেন ততই অপরিচিত হয়ে যেতে থাকে। প্রতিটি পদে পদে তার সামনে বাধা আসতে শুরু করে। তবে সে হার মেনে যাওয়ার পাত্রী না। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে সে।
আরও পড়ুনঃ গর্ভধারিনী PDF রিভিউ । সমরেশ মজুমদার
সাতকাহন বইটি প্রায় ৩ বছর ধরে পড়ি পড়ি করেও পড়া হচ্ছিলো না। কারন নিয়মিত বাংলা পড়ে অভ্যাস না থাকায় বাংলা বইয়ের লেখা ও গল্পের ধরনের সাথে একটু বেগ পেতে হয় আমার। তার উপর ক্লাসিক বই। ফেব্রুয়ারিতে শুরু করে একটু একটু করে পড়তে পড়তে ৪ মাস পর আজ শেষ হলো ১ম খন্ড। তবুও এই অপেক্ষা সময় নষ্ট মনে হয়নি।
লেখায় ছিলো গ্রাম বাংলার জীবনের ও পরিবেশের চমৎকার বর্ননা। চা বাগান, হাট, নদ নদী, পূজা পার্বনসহ সব যেন চোখের সামনে ঘটতে দেখছিলাম। আবার কলকাতার বৃষ্টিভেজা রাস্তা, কফি হাউজ, কলেজের হোস্টেল, হৈ-হুল্লোর ইত্যাদি দৃশ্যগুলোর বর্ননাও ছিলো একেবারে জীবন্ত।
গল্পের প্রতিটি চরিত্রের বর্ননা ও ভুমিকা ছিলো চমৎকার। প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে অবদান রেখেছে। কিছু কিছু আবেগঘন দৃশ্যের বর্ননা ছিলো একেবারেই বাস্তব যা অনুভব করার মতো।
সাতকাহন এ গল্পের মূল থিম ছিলো প্রশংসনীয়। এতো বছর আগের সময়কাল নিয়ে লেখা গল্প হলেও বর্তমানের সাথে খুব একটা অমিল নেই। আমাদের সমাজ ও সমাজ ব্যবস্থার কাছে নারীরা চিরকালই বন্দী। যতই আমরা মুখে বলিনা কেন সমাজ ব্যবস্থা বদলেছে বা বদলাচ্ছে, এতো বছর পরে এখনো খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। এখনো বাল্যবিবাহ হচ্ছে, যৌতুক প্রথাও বন্ধ হয়নি, মনগড়া কিছু সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়ম দেখিয়ে নারীদের ইচ্ছা বা স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রন করা হচ্ছে, এখনো ছেলে মেয়ে একসাথে চলাফেরা বা বন্ধুত্ব লোকজন আড় চোখে দেখে। একা মেয়েদের রাতে চলাফেরা এখনো অনিরাপদ ও সমাজের চোখে খারাপ। আগামী ১০০ বছরেও এসব পরিবর্তন সম্ভব হবে বলে মনে হয়না।
দীপাবলির ব্যাপারে আমার অনুভূতি মিশ্র। প্রথম দিকে এমনকি গল্পের মাঝ পর্যন্ত তার প্রতি আমার অনুভূতি ছিলো ইতিবাচক। কিন্তু যতই গল্প এগুতে থাকে ততই যেনো দীপাবলির আচরন রুঢ় হতে থাকে। কারনে অকারনেও এ ধরনের আচরন করে সে। সার্কাজম বা ব্যঙ্গ করা ছাড়া সে যেনো কারো সাথে কথা বলতেই পারেনা। তাই এক পর্যায়ে বিরক্তই লেগে গিয়েছিলো।
দ্বিতীয় বইটি সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য শুনেছি অনেকের কাছে। তবুও শেষ পর্যন্ত কি হয় তা জানতে পড়বো। এ বইটি আরো ১০ বছর আগে পড়লে হয়তো বেশি উপভোগ করতে পারতাম। বইটি সকলের জন্যই শিক্ষনীয়, বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। তবে সাতকাহন বইটি সবারই পড়া উচিত বলে মনে করি।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত
কিছু উক্তিঃ
আমাদের এখানে মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়, তারা বিয়ে করে না #দীপা
তার মানে তোমারা মন থেকে শরীরে পৌছাও না, একটা অজানা অচেনা লোকের সঙ্গে প্রথমেই শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করে মনে পৌছাতে চাও। তাও সম্ভব?
সারাজীবন পাশাপাশি থেকেও হয়তো হুকুম মেনে চলাটাই এদেশের বিবাহিত মেয়েরা দাম্পত্য জীবনযাপন বলে মনে করে।
ক্রোধ আছে অথচ তার প্রকাশ নেই
দুঃখ আছে অথচ সেটা রয়েছে চাপা
স্নেহ আছে অথচ সেটা বুকের ভেতর #অনন্ত
এক ফোটা চোখের জল, একশ ফোটা রক্তের সমান।।
পুরুষ মানুশ চিতায় উঠলেও যদি চোখ মেলার সুযোগ পায় তবে সেটা মেলবে মেয়েদের দিকে #বীনা
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পেলে কোন জাতীর মেরুদন্ড সোজা হতে পারে না #কবিগুরু
কোন মেয়ের রুচি বোঝা যায় পায়ের গোরালী দেখে আর কোন বাড়ির রুচি বোঝা যায় তাদের ওয়াসরুম দেখে।। #দীপা
কলেজ পলিটিক্স হল শরতের মতো হেমন্ত, শীত, বসন্তে কোন দাম নেই #রমলাসেন
রবীন্দ্রনাথ এর কবিতা সারাজীবন অক্সিজেন দিবে #রমলাসেন
রাস্তায় হাটতে গেলে শুধু সবুজ ঘাস ই থাকে না, পাথরের টুকরা ও কাচের কুচিও থাকে #অধ্যপক
বেনামী পত্রের লেখকরা মেরুদণ্ডহীন #দীপা
শরীরের জন্য জীবন নয় জীবনের জন্য শরীর পথ পরে থাকে পথে পথিক এগিয়ে যায় সামনে। #দাদু
পথ তুমি কার?? পথিকের #দীপা
ইউ মাস্ট রিমেম্বর You are fitting against Destiny #মাস্টারমশাই
শিশু যখন মায়ের কোলে থাকে তখনই তার স্তনদুগ্ধের প্রয়োজন পরে কিন্তু অন্য খাদ্য গ্রহন করলে মায়ের দুধ শুকায় যায়।এটাই প্রকৃতির নিয়ম। #সত্যসাধন
তুমি যতক্ষন নিজে মনে না কর যে তুমি অন্যায় করছ ততোক্ষন যে যায় বলুক কানে নিবানা।তোমার বিচারক তুমি নিজেই #সত্যসাধন
চুক্তিবদ্ধ ভদ্রতায় আমি বিশ্বাস করি না #দীপা
মানুষের কোন সম্পর্কই শেকর ধরে উঠে আসা নয় শেকর গুলা সময় বুঝে আলগা হয়ে যায় #দিপা
আজ যা আসল কাল তা উপলক্ষ হয়ে যেতে পারে বাঙালীর হৃদয় রবীন্দ্রনাথ হলে মস্তিষ্ক বিবেকানন্দ হওয়া উচিত #দীপা
আমি বেচে আছি কেন?? বেচে থাকার জন্য #অমরনাথ
মৃত্যু কি সহজ, নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ সারাজীবন এই জীবন নিয়েই গর্ব করে #দীপা
তরুন বয়সে যা সহনীয়, যৌবন পেরিয়ে তা হয়ে ওঠে পিড়াদায়ক #দীপা
ভালবাসা এক জিনিস আর পরস্পর কে বুঝতে পারা অন্য জিনিস #দীপা
জীবন মানে সুখের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো আর বেচে থাকা মানে অজান্তেই দুঃখের সাথে সহবাস করা #দীপা
যেকোন ঘটনায় কোন না কোন ইতিহাস কে নকল করে #দীপা
শাষন যতই খারাপ লাগুকনা কেন, শাষন করার মানুষ না থাকলে অভাগী মনে হয় নিজেকে #দীপা
পাতায় পাতায় আবেগের বন্যা বইছে এবং যুক্তি গুলা চাপা পরে যাচ্ছে #শমিত
পুরুষেরা গল্প বানায় আর মহিলারা তার ডালপালা তৈরি করে #ললিতাদি এ
ক ফোটা ভালবাসা পেলে যে লক্ষ মাইল পথ হেটে যেতে পারে, সে এক সুমুদ্র ভালবাসা পেল কি করবে #দীপা
টেনশন আবার কি?? যা হবার তাই হিবে যা হবার না তা হবে না #ডাক্তারবাবু
ক্ষত সেরে যাওয়ার পর ব্যান্ডেজ তোলার সময় ও অস্বস্থি লাগে #দীপা
দুদিনের সুখ দিয়ে ৩৬৩ দিনের দুঃখ ভোলা যায় না #দীপা
ভবিষ্যৎ এর পাতা উল্টানোর সময় অতিতের অভিজ্ঞতা অনেক্ষানি ভুমিকা রাখে #দীপা
নর্দমা থেকে উঠতে গেছিলাম বলেই গায়ে মুখে কাদা লেগে গেছিল, তাই আবার নর্দমায় ঢুকে গেলাম। অতঃএব সেগুলা ঢাকা পরে গেল #দীপা
অর্থনৈতিক বৈষম্য যেখানে চূড়ান্ত সেখানে সমান অধিকারের স্লোগান হায়নার মত শোনায় #দীপাসুদিপ
মানুষ দুঃখের সঙ্গি চায় কিন্তু অপমান সহ্য করতে চাই একা একা..নিজের মত করে #দীপা
যারা স্বাধিনতার জন্যে প্রান দেয় তারা স্বাধিনতা ভোগ করে না #মায়া
মাটির সঙ্গে আকাশের দারুন বন্ধুত্ব
মাটি যেখানে দিগন্ত ছড়ানো সবুজ
আকাশও সেখানে ঝকমকে #দিপা
অতিতকে নিয়ে পুনরায় আলোচনা করা মানে নিজের মনের ক্ষত স্থানে পোস্টমর্টেম করা #দীপা
মেয়েরা হল জমির মতো, এদের চারদিকে নদীর স্রোত
ভাল বাধ না দিলে নদী সেই জমি গ্রাস করে নিবে #
এই রকম সম্পর্কের কোন ব্যাক্ষা নেই, আছে বললে ভুল হবে আর না বললে মিথ্যা বলা হবে #দিপা
একটি পিঁপড়ের কামর কখনো বেদনা হতে পারে না কিন্তু নিত্য যদি একই জায়গায় কামড় দেয়া হয় তাহলে সেই বিষ চিকিৎসার বাইরে চলে যায় #দীপা_অলক
পৃথিবীতে এমন ২জন মানুষ খুজে পাবেন না যারা পরস্পর সমপর্কে একই কথা বলে।।
লিখেছেনঃ Rima Sarmin Radcliffe
বইঃ সাতকাহন [ Download PDF ]
লেখকঃ সমরেশ মজুমদার
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
সমরেশ মজুমদার ত্রয়ী বা ট্রিলজি