সপ্তপদী – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নেয়া ঈশ্বরে বিশ্বাসহীন প্রাণপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র কৃষ্ণেন্দু। ঘটনাক্রমে সে প্রেমে পড়ে খ্রিস্টান ধর্মানুরাগী রিনা ব্রাউনের। কিন্তু রিনা ব্রাউনের বাবা শর্ত দেয় যে কৃষ্ণেন্দু যদি ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হয় তবে রিনার সাথে তার বিয়ে দেবে। ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকার পরও এ কথায় কৃষ্ণেন্দু ধাক্কা খায়। সেই ধাক্কা সামলে উঠে নিজের বাবার কাছে মৃত বলে গৃহীত হবেন জেনেও রিনা ব্রাউনের প্রতি তার প্রচণ্ড ভালোবাসা তাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার পথেই চালনা করে।
কিন্তু খ্রিস্টান হয়ে যখন সে রিনার সামনে যায় রিনা তার ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা শুনে আঁতকে ওঠে,রিনার মনে হয়, কৃষ্ণেন্দু ভয়ঙ্কর। সে একটা নারীর জন্য নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে পেরেছে, কাজেই ভবিষ্যতে অন্য সুন্দরী নারীর জন্য রিনাকেও সে ত্যাগ করতে পারবে।। এমন সব চিন্তা রিনার মাথায় জেঁকে বসে এবং সে কৃষ্ণেন্দুকে ভালোবাসলেও তাকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে কৃষ্ণেন্দুকে ফিরিয়ে দেয়….
সবকিছু হারিয়ে কৃষ্ণেন্দু স্তব্ধ হয়ে যায়…. উপন্যাসের কাহিনির প্রধান টুইস্টটা এরপরে পাওয়া যায় এবং এখানে এসে কাহিনি নতুন দিকে মোড় নেয়।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার
রিনার কথা কৃষ্ণেন্দুর জীবনবোধে নাড়া দেয়,গৃহত্যাগী হয়ে সে ঈশ্বরকে খুঁজতে বের হয় এবং নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে খুঁজে পায়ও-মানুষের মধ্যে।কিন্তু রিনা? এমন কি ঘটে যার জন্য রিনার মনে হয় যে মৃত ঈশ্বর তার নিজের মধ্যে পঁচছে,সেটার গন্ধ উঠছে!
কাহিনির এই অংশটায় বই রেখে ওঠা যায় না,লেখক রেভারেন্ড কৃষ্ণস্বামী (কৃষ্ণেন্দু) এবং রিনা ব্রাউনের কথপোকথনের মধ্য দিয়ে এমনভাবে তাদের জীবনদর্শনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন যা পাঠককে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে নিজের জীবনবোধ নিয়ে ভাবানোর উপযোগী।
প্রাথমিকভাবে এটাকে প্রেমের উপন্যাস মনে হলেও এর মধ্য দিয়ে দৃঢ় জীবনদর্শনের পরিচয় দিয়েছেন লেখক।ধর্মবোধের ব্যাপারটাকে অন্যভাবে তুলে ধরেছেন।
এছাড়াও এই উপন্যাসের শুরুর দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব বাংলার মানুষদের জন্য কতোটা ভয়াবহ ছিল তার চিত্র এঁকেছেন। প্রাচীন আমলের মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার বসবাসরত জনগোষ্ঠীদের বিশেষ করে ছত্রীদের জীবনযাপনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন।
রিনা এবং কৃষ্ণেন্দু ছাড়াও উপন্যাসের দুইটা চরিত্র আমার কাছে চমৎকার লেগেছে, সেসব হচ্ছে কৃষ্ণেন্দুর বাবা এবং কুন্তী।কেন এই চরিত্র দুটো আলাদা করে ভালো লেগেছে,শক্তিশালী লেগেছে তা আলাদা করে বলছি না।।টুইস্ট থাকবে না তাহলে আর।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা আমার বরাবরই পছন্দ। এই উপন্যাসের আরেকটা সুন্দর দিক হচ্ছে ওথেলো ট্রাজেডির কিছু লাইন রিনা এবং কৃষ্ণেন্দু চরিত্রের মুখ দিয়ে লেখক জীবন্ত করে তুলেছেন।
“It is the cause.. It is the cause, my soul!”, “Let me look at your eyes, look in my face..”
সপ্তপদী নাম দেয়ার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। শাস্ত্রে বলা হয়, উপনয়নের সময় তিন পায়ের বেশি অগ্রসর হতে নেই,তাতে আর ফেরার উপায় থাকে না। আর সাত পা একসঙ্গে হাঁটলে অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব তৈরি হয়। তো, পরোক্ষভাবে দুইটি ভিন্ন জীবনবোধের মধ্য দিয়ে রিনা আর কৃষ্ণেন্দুর পাশাপাশি সপ্তপদ হাঁটা হয়ে গিয়েছিল, ফলে না চাইতেও এরা পরস্পরের জীবন বদল করে নিয়েছিল এবং আজীবনের জন্য একটা অদৃশ্য বন্ধনে একে অপরের সাথে থেকে গিয়েছিল যা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে গিয়ে তারা উপলব্ধি করতে পারে।
এই উপন্যাসের একটা উক্তি হচ্ছে-
“মানুষের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ তার আত্ন-প্রবঞ্চনায়। নিজেকে সে যত বঞ্চনা করেছে তার চেয়ে বেশি বঞ্চনা আর কেউ করেনি।”
আরেকটা পছন্দের উক্তি আছে-
“উরা বলে মাঝি, জাত আমার নাই।তবে মানুষ তো বটি।তুইও মানুষ, আমিও মানুষ,ওই মেয়েটাও মানুষ।”
বইঃ সপ্তপদী Download (PDF)
লেখকঃ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
লিখেছেনঃ Mahmuda Monika
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন