তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় – বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে নিখুঁততম সাহিত্যিক
বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে নিখুঁততম সাহিত্যিক বলা যায় একমাত্র তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় -কেই। অথচ এই কিংবদন্তি সাহিত্যিক ও খেই হারিয়েছিলেন হঠাৎ। আচমকাই লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। টানা তিন বছর কিছুই লিখলেন না। অথচ সাহিত্যিক হিসেবে তিনি তখন গগণচুম্বী উচ্চতায়।
আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন তিনি,
‘‘লিখতে ইচ্ছে হয় না। লিখি না। লেখা ছেড়েই দিলাম। বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করলাম। বসে বসে ভাবি। আর কাঁদি। একলা কাঁদি। পূজার সময় কাঁদি। রবীন্দ্রনাথের গান শুনে কাঁদি।’’
শাক্ত-পরিবারের ছেলে। বাড়ির বিশ্বাস, মা তারার দয়ায় তার জন্ম হয়েছে, তাই তাঁর নাম রাখা হয়েছিলো তারাশঙ্কর।
সে সময় এক সাধুকে মনে ধরলো তারাশঙ্করের। রক্তে আধ্যাত্মিকতা। মন অশান্ত, কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছেন না। কীসের অতৃপ্তি বুঝতে পারছেন না। অথচএরই মধ্যে রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমির মতো বিখ্যাত পুরস্কার ও পেলেন কিন্তু পুরস্কার পাবার আনন্দ কোথায়? কিছুই যেন স্পর্শ করছে না। ছটফট করছে ভেতরটা।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার
কলকাতার রাস্তায় এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে গেল এক সন্ন্যাসীর। সারাদিন সে সন্ন্যাসী আগুন ছুঁয়ে সাধনা করেন। মনে ধরল সেই সাধুকে। জানলেন তাঁর বাস কাশীতে। সংসার ছেড়ে দিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব নেবেন ঠিক করে যেদিন আবার দেখা করতে গেলেন শুনলেন সন্ন্যাসী ফিরে গেছেন। তাঁর সন্ধানে তারাশঙ্করও রওনা দিলেন কাশী। দেখা হয়ে গেল সেই সময়ের আনন্দসুন্দর ঠাকুরের সঙ্গে।
কথায় কথায় তারাশঙ্কর তাঁকে বললেন, ‘‘একটা কিছু ধরতে চেয়ে যেন ধরতে পারছি না। তার জন্য আমার মনে অশান্তির শেষ নেই।’’
তা শুনে আনন্দসুন্দর বললেন, ‘‘আপনার সাধনার পথ হল সাহিত্য। তাকেই জীবনের সাধনা করুন, শান্তি পাবেন।’’
ফিরে এলেন কলকাতায়। নিজের মা-কে গুরু করে দীক্ষা নিলেন। নিত্যপুজো, চণ্ডী, গীতা-পাঠ চলতে থাকল। তাও যেন শান্তি মিলছে না, কী যেন জীবন ছেড়ে চলেই গেছে চিরকালের মতো। এমনই এক সময়ে বর্ধমানে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা। হাওড়া-স্টেশন পৌঁছেও তিনি ট্রেনে না চেপে বসে রইলেন প্ল্যাটফর্মে।
দেখা হল বহুদিনের বন্ধু ভ্রাতৃপ্রতিম জগদীশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ধমকই দিয়ে বসলেন তিনি। জগদীশ ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘এসব কী করছেন দাদা! আপনার এমন আচরণে গোটা বাংলার মানুষ ছি ছি করছে! আপনার নিন্দুকদের কথাই তা’হলে সত্যি হলো?’’
‘‘কী সত্যি হলো?’’
‘‘তাঁরা বলে আপনি শেষ। আর কখনও লিখতে পারবেন না।’’
এমন কথায় যেন যেন কেঁপে উঠলেন তারাশঙ্কর। এবার সাহিত্যিকের অহংকারে ধাক্কা লাগলো বহুকাল পর। পূজার আর তখন মাত্র আড়াই-মাস বাকি। ভেবেছিলেন কিছুই লিখবেন না, আর সেই বছরই ওই অল্প সময়ে চারটা পূজা সংখ্যায় লিখলেন গল্প। দেশ পত্রিকায় ‘রাধা’, আনন্দবাজার-এ ‘বিচারক’ , শনিবারের চিঠি-তে একটি একাঙ্কিকা আর তরুণের স্বপ্ন-য় ‘পঞ্চপুত্তলী’। প্রকাশিত হওয়ার পরে আবার রহই- হই পড়ে গেল পাঠক মহলে। ফিরে এলেন, তারাশঙ্কর আবার ফিরে এসেছেন! আর গণদেবতা’র লেখক ফিরে পেলেন তার হারিয়ে যাওয়া শান্তি।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো জীবনের শেষভাগে যেখানে সাহিত্যিকেরা নিজেদের সাহিত্যকর্ম আরো বাড়িয়েছেন, রচনাসম্ভার বিস্তৃত করেছেন সেখানে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের লেখা সাহিত্যের পরিমার্জন, পরিবর্তন পরিবর্ধন করেছেন। এই খুঁতখুঁতে ভাব তাঁর তো আজীবনই ছিলো। আবার শেষভাগে এসে যেন আরো খুঁতখুঁতে হয়ে পড়লেন। একটা লেখা লিখতে বসলে দেখা যেত তার লেখা হয়েছে ঠিকই কিন্তু কাটাছেঁড়ার কারনেই সময় বেশী লাগছে।
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে নিখুঁততম এবং মৌলিক সাহিত্যিক বলা যায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে তৎকালীন সময় যখন শহুরে আর গ্রাম্য; একজন একধারা নিয়ে কাজ করছেন যেখানে সেখানে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ই একমাত্র ব্যতিক্রম। বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো সমাজ সচেতন সাহিত্যিক আর নেই। তিনি কাজ করলেন; তাঁর সাহিত্যে তুলে আনলেন বীরভূমের লালমাটির নিম্নবর্গ, নিম্নজ মানুষদের। সাঁওতাল, বাগদি, বোষ্টম, বাউরি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল সম্প্রদায়ের মানুষেরা উঠে এলো তাঁর সাহিত্যে।
সবচেয়ে দারুণ বিষয় হলো বাংলা সাহিত্যে একমাত্র তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যই বিদেশী কোন সাহিত্যিক তো দূরে থাক দেশী কোন সাহিত্যিক দ্বারাও অনুপ্রাণিত নন। অনুসরণ অনুকরণ তো দূর অস্ত। সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাষ্য তাঁর।
দিনের মধ্যে ১৪- ১৫ ঘন্টা লিখতেন তিনি। কখনো কখনো ১৮ ঘন্টাও হতো। তাঁর সৃষ্টি সম্ভার বিস্তৃত মনে হলেও তাঁর লেখার তুলনায় একবারেই কম। বিশেষ করে ৬৫টা উপন্যাস, ৫৩টা গল্পগ্রন্থ, ১২টা নাটক, ৪টা প্রবন্ধের বই, ৪টা আত্মজীবনী, ২টা ভ্রমণ কাহিনী, ১টা কাব্যগ্রন্থ। হয়তো তিনি যদি অতো খুঁতখুঁতে না হতেন রবীন্দ্রনাথের চেয়েও সৃষ্টিসম্ভার তাঁর বেশী হতো। তারাশঙ্কর সৃষ্টির উপর নির্মিত হলো ৪০টির বেশী চলচ্চিত্র। বাংলা সাহিত্যে এমন একজন ও আর খুঁজে পাওয়া যায়না।
এতো বিখ্যাত সাহিত্যিক হওয়ার পরেও শেষ জীবনে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিতে হয়েছিলো তাঁকে। অনেকটা দায়ে পড়েই। তাঁর জামাতা শান্তিশঙ্কর মারা গেলেন হঠাৎ; শান্তিশঙ্করের বিধবা স্ত্রী তথা তারাশঙ্করের বড় মেয়ে গঙ্গা দেবী, তারাশঙ্করের চার সন্তান সকলের দায় তখন তারাশঙ্করের কাঁধে।
অসহায় নাতি-নাতনিদের খাওয়াতে হবে। এই অবস্থায় তারাশঙ্কর যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ নিলেন। তাঁর আত্মজীবনীর শেষ পর্ব ‘আমার কথা’য় তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমাকে এগিয়ে যেতে হয়নি আমার দুর্দিনে, তুষারবাবুই ঘটনাটি জানতে পেরে নিজেই এগিয়ে এসে সমাদর করে আহ্বান জানালেন।’’ অথচ এই কাজ নেওয়ার জন্যও তারাশঙ্করকে বহু সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিলো।
১৯৬৩ সালের ২৭ জুলাই থেকে ১৯৬৭ সালের জুন পর্যন্ত চার বছর ধরে প্রতি শনিবার যুগান্তরের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় তিনি গ্রাম বাংলার সংবাদ লিখতেন ‘গ্রামের চিঠি’ নামে। সেই লেখাটি অবশ্য ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।.বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অজস্র অবদান ছিলো তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রবাসী সরকারের জন্য ফান্ড কালেকশান তো ছিলোই, এছাড়া সভা সমিতি, সব জায়গাতেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সাহায্যের আবেদন করেছিলেন, নিজেও নিজের সাধ্যের থেকেও বেশী সাহায্য করেছিলেন। বলতেন, “বাংলার নাড়ি পোতা তো ঐ দেশে। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয় তবে বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি জাতি টিকে থাকবে সমুজ্জ্বল হয়ে।”
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু মাত্র ৩ মাসের জন্য দেখে যেতে পারলেন না তিনি। ৭১ এর সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন চিরতরে।
লিখেছেনঃ Ahmad Istiak
বইয়ের ফেরিওয়ালায় আপনার লেখা প্রকাশ করতে চাইলে এইখানে লেখা জমা দিন।
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন