শহীদুল্লাহ কায়সারের জীবনী | Shahidullah Kaiser What Happened to Him
ঢাকা জেলে বসে চারকোনা ডায়েরির পাতায় দিন রাত লিখতেন। জেল থেকে বের হওয়ার পরে ছাপা হলো বিখ্যাত উপন্যাস ‘সারেং বউ’। লিখেছিলেন-
“আইয়ুব আমাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন, আর আমি হয়ে উঠেছি সাহিত্যিক”।
কেবল সারেং বউ-ই নয়, বিখ্যাত উপন্যাস সংশপ্তক, রাজবন্দীর রোজনামচা এগুলোও রচনা করেছেন কারাগারে বসে। শহীদুল্লাহ কায়সারের জীবনে যৌবনের বেশির ভাগ সময় নিঃসঙ্গে কাটিয়েছেন কারাগারে।
তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস সংশপ্তক রচনা করেছিলেন বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষিতে। তাঁর ছোট মামা (মিয়ার বেটা) মামা বাড়ির কাজের মেয়ে, রমজান সহ যেসব চরিত্র পাওয়া যায় সবই তাঁর মামা বাড়ির লোকেরা। এই উপন্যাস লেখার কারনে মামার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল শহীদুল্লাহ্ কায়সারের।
শহীদুল্লাহ কায়সারের কাছে সাহিত্য আপোষের জায়গা ছিলোনা। বারবার দৃঢ় হয়ে সত্য প্রকাশ করেছেন নিঃসঙ্কোচে।
৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বহু শিল্পী, বুদ্ধিজীবি সাহিত্যিক দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন তখন শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন দৈনিক সংবাদ এর সাংবাদিক। সংবাদ অফিস পুড়িয়ে দিলো হানাদার বাহিনী। তখন ভারতের কমিউনিস্ট বাহিনী তাঁকে ভারতে আশ্রয় নিতে বলে। রাশিয়া তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তিনি যেন চলে আসেন রাশিয়াতে। অথচ তিনি সুস্পষ্ট ভাবে বলেছিলেন সবাই যদি চলে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করবে কে? পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিলেন মুক্তি সংগ্রামে।
১৩ ডিসেম্বর তিনি পরিবারের চাপে নিরাপত্তার জন্য বাসা ছাড়তে বাধ্য হলেন। তবে ঢাকাতেই কোথাও আত্নগোপণে থাকবেন। কিন্তু বাসা ছাড়ার আধঘন্টা পর আবার ফিরে এলেন। মাকে বললেন, “আমি একা থাকবোনা। তোমাদের নিয়ে একসাথে থাকবো!”
রাতে খাওয়ার পর সিগারেটের কাগজের উল্টো পিঠে বউকে একটা চিঠি লিখলেন- ‘প্রিয়তমাসু পান্না কায়সার, আমার ছেলে-মেয়েগুলোকে তুমি যত্নে রেখো। আমি জানি, তুমি পারবে। তুমি ভালো থেকো। আমি কখনো কোথাও তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবো না।’
আরও পড়ুনঃ জহির রায়হানকে নিখোঁজ করলো কারা?
১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা। পুরান ঢাকার কায়েতটুলির বাসায় শহীদুল্লা কায়সার মোমবাতি জ্বালিয়ে বিবিসি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। স্ত্রী পান্না কায়সার মেঝেতে বসে মেয়েকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছেন। এমন সময় দরজায় ঠক ঠক করে কড়া নাড়ার শব্দ হল। তাঁর ছোট ভাই ওবায়দুল্লা এসে শহীদুল্লাহ কায়সারকে বললেন, ‘বড়দা দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে খুলে দিব?’
তিনি উত্ফুল্লভাবে বলে উঠলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দাও।’ একথা বলে তিনি আলমারি খুলে টাকা বের করলেন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেওয়ার জন্য।
কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর মুক্তিযোদ্ধারা নয় চার-পাঁচজন লোক কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে ঘরে প্রবেশ করল। তারা ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘শহীদুল্লা কায়সার কে?’ শহীদুল্লাহ কায়সার এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমিই শহীদুল্লা কায়সার।’ সেই কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা লোকগুলি তাঁর হাত ধরে তাঁকে নিয়ে যেতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে পান্না কায়সার মেয়ের দুধের ফিডার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বামীর হাত চেপে ধরলেন, অন্য ঘর থেকে শহীদুল্লা কায়সারের বোন ছুটে এসে ভাইয়ের হাতটি চেপে ধরলেন।
কিন্তু তাঁরা শত শক্তি প্রয়োগ করেও ধরে রাখতে পারলেন না স্বামী ও ভাইকে। আল-বদররা স্ত্রী ও বোনের হাতের বাঁধন ছিন্ন করে ধরে নিয়ে গেল তাঁকে। শহীদুল্লা কায়সার যাবার সময় স্ত্রী ও বোনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলেছিলেন, ‘ভাল থেকো’। কারফিউ-এর অন্ধকারে তিনি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেন। তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর মৃতদেহও পাওয়া যায়নি! বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই কিংবদন্তি সাহিত্যিক শহীদ বুদ্ধিজীবি শহীদুল্লাহ কায়সারের প্রতি।
লিখেছেনঃ আহমেদ ইশতিয়াক
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
শহীদুল্লাহ কায়সারের বইসমূহ ডাউনলোড করুন