“পৃথিবী থেকে সাপ এবং শকুনের বিশেষ প্রজাতি বিলুপ্ত হলে কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। একেক টাইপের মানুষের মধ্যে এ সাপ-শকুনেরা নতুন জীবনলাভ করে বেঁচে থাকবে।”
বইয়ের একটি উক্তি দিয়েই লিখা শুরু করলাম। এ বইয়ের ভূমিকাতে লেখক নিজেই বলেছেন, এটি তার আত্মজিবনীমূলক উপন্যাস। তাই উপন্যাসের সিংহভাগ চরিত্রই যে লেখকের নিজের মধ্যে বিদ্যমান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পুরো উপন্যাসটি এখানে উত্তম পুরুষে রচিত হওয়ার লেখক ‘জাহিদ’ নামের এক কথকের মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।
জাহিদ তার অতীতের স্মৃতিগুলো এক নবাগত প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে ব্যক্ত করেছেন। জাহিদ এখানে তার প্রিয়তমাকে ‘সোহিনী’ নামে সম্বোধন করেন। সোহিনীর বিশেষত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে জাহিদ বেশকিছু আবেগময় শব্দের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি বলেন, সোহিনী তুমি আমার কাছে অর্ধেক আনন্দ অর্ধেক বেদনা, অর্ধেক কষ্ট অর্ধেক সুখ, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী। জাহিদ তার ব্যক্তি জীবনে যেসকল নারীর সঙ্গ লাভ করেছেন তাদের মধ্যে থেকে দুইজন নারীর চরিত্র সম্পর্কে বয়ান করেছেন সোহিনীর কাছে। যার একজন দুরদানা এবং অন্যজন শামারোখ।
এই দুজন জাহিদের খুব ঘনিষ্ঠ হলেও দুজনের চরিত্রের মধ্যে বিস্তর ফারাক। একজন উত্তর মেরুর হলে আরেকজন যেন দক্ষিণ মেরুর! এরমধ্যে দুরদানা এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী ইউসুফ জোয়ারদারের বোন। যার মধ্যে ছিল অত্যন্ত দুরন্তপনার ছড়াছড়ি। যার বেশভুষা অদ্ভুত প্রকৃতির! নারী হিসেবে তাকে চেনা দায়। নারীত্ব নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। শার্ট-প্যান্ট পড়ে সাইকেল চালানো, পকেটে চাকু নিয়ে ঘুরে বেড়ানো কিংবা হঠাৎ হঠাৎ যেখানে সেখানে সিগারেটের ধোয়া উড়ানো ছিল তার অনন্য বৈশিষ্ট্য।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার
দুরদানার পরে জাহিদ জড়িয়ে পড়ে শামারোখে। তার ভাষ্যমতে শামারোখ ছিল অসম্ভব রূপবতী একজন নারী। তার রূপে মোহগ্রস্ত সকলেই। প্রায় আট বছর আগে স্বামী-সন্তান ছেড়ে আসা এ নারীকে জাহিদ কন্যা বলেই সম্বোধন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরী পেয়েও বিভাগীয় প্রধানের চক্রান্তে সেই চাকুরী হারাতে বসা শামারোখের সাথে জাহিদের তখনই পরিচয়।
সমাজের চোখে শামারোখ নিন্দনীয় হলেও, জাহিদ সেসবের ধার ধারেন না। বরং তারা একে অপরের সাথে চলাফেরা, একসঙ্গে উঠাবসা কিংবা সময়ে অসময়ে একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি কর্মকান্ডের জন্ম দিয়েছেন। ফলে জাহিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানুষদের কাছে চোখের কাঁটায় রূপান্তরিত হয়েছে। তারপরেও বরঞ্চ জাহিদ বলেছে, সে এই নারীর জন্য মৃত্যুকে পর্যন্ত আলিঙ্গন করতে রাজি আছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে শামারোখের মধ্যে নানা পরিবর্তন আসতে খাকে। এবং একসময়ে গিয়ে তাদের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে। আর সেই সাথে জাহিদ দেখে ফেলতে থাকে শামারোখের এই রূপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভিন্ন এক চেহারা।
এমনই এক প্রেমময়ী উপন্যাসের মাধ্যমে লেখক যেন নিজেকে আরও একবারের মতো নতুন করে উপস্থাপন করলেন। লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন যথেষ্ট আবেগ অনুভূতি থাকা সত্তেও কিভাবে একজন নারীকে তার সর্বোচ্চ সম্মানটুকু দিতে জানতে হয়।
লেখকের মতে, “প্রতিটি পুরুষই একজন নারীসত্ত্বাকে কল্পনা করে তাকে ভালবাসতে চায়।” কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে ওঠে না.. কেননা কোন নারীর পক্ষেই একজন পুরুষের আকাঙ্খিত সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করা সম্ভব হয় না।
লেখক দ্বিতীয় খন্ড লিখে যেতে পারেননি বিধায় জাহিদের সাথে সোহিনীর বাকি কথোপকথন আমাদের অজানা। মানুষের চরিত্রের নানামুখ দিক লেখক অত্যন্ত সরল ও সাবলীল ভাষায় ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করেছেন। ভিন্ন ধাচের দুজন নারীর মধ্যেও একটি মিল রয়েছে। আর তা হচ্ছে দুজনেই যথেষ্ট আলোচিত এবং সমালোচিত ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রহসনের রূপটাও লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন বিভিন্নভাবে। যাই হোক সবমিলিয়ে লেখক এ বইতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে পুরো গল্পটা পাঠকদের জন্য বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরেছেন এটুকু বলতেই হয়।
লিখেছেনঃ আবদুল্লাহ
বইঃ অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী [ Download PDF ]
লেখকঃ আহমদ ছফা