হ্যাজাক লাইট কিভাবে জ্বলে কি কোথায় পাওয়া যায়

হ্যাজাক লাইট ও নব্বই দশকের শৈশব | হেজাক বাতি কি ? কিভাবে জ্বলে

Redirect Ads

কেরোসিনে চালিত এই জিনিসটার নাম হ্যাজাক লাইট / হ্যাজাক বাতি। অনেকে আবার পাম লাইট / ফামলাইটও বলে থাকে কেননা এই লাইটে কেরোসিনকে পাম্প দিতে হয়। এর আলো এতটাই স্বচ্ছ যে দূর থেকে দেখে মনে হয় এইটা ইলেকট্রনিক কোনো লাইট!
৮০/৯০এর দশকে এই হ্যাজাক লাইট ছাড়া কোন সামাজিক অনুষ্ঠান কল্পনা করা যেতোনা। কালের পরিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে এই হ্যাজাক। চলুন জেনে নেয়া যাক হ্যাজাক লাইট কি, কিভাবে কাজ করতো, কখন কোথায় ব্যাবহার করা হতো।

হেজাক বাতি কি ?

হ্যাজাক বাতি দেখতে অনেকটা হারিকেনের মতোই তবে একটু ভিন্ন ছিলো। হ্যাজাকের স্ট্রাকচারটাকে আমরা ৩ ভাগে ভাগ করতে পারি যেখানে ভিত্তিতে (বেসমেন্ট) ছিল একটি চেম্বার যাতে তেল ভরে তা পাম্প করা হতো। তার উপরের অংশে ছিলো হারিকেনের মতোই একটি চিমনি যেটা সাধারণত এলুমিনিয়াম এর নেটের হয়ে থাকে। তারপর বেসমেন্ট থেকে একটি সরু নল উপরের দিকে গিয়ে বড়শির মত বাঁকা হয়ে থাকে। এই চিকন নল বেয়ে কেরোসিন তেল উপরে উঠে যেত। এবং আলো ছড়াতো। এই বাতির আলোর প্রখারতা ছিল অনেক তীব্র। বলা হয়ে থাকে ৪০০ ওয়াটের সাধারণ বৈদ্যুতিক বাতির সমপরিমাণ আলো দিতে সক্ষম এই বাতি।

Download

হ্যাজাক লাইট কিভাবে জ্বলে

হ্যাজাক লাইটে আগুন ধরানোর সিস্টেমটা ছিলো অন্যরকম। কেরোসিন পাম্প করে উচ্চচাপ সৃষ্টি করা হত যাতে মেনথেল (নরম সিনথেটিক নেটের মত) ভিজে যায়। এরপর মেনথেলে আগুন দেওয়া হত। সেই বিশেষ এক ধরনের সুতোর তৈরী ম্যান্টেলে তেলের পাম্প স্প্রে আকারে চলে যেত এবং তা জ্বলে প্রচুর আলো দিত। যে আলো ছিলো বিদ্যুতের চেয়েও দামী। উজ্জ্বল আলো নিস্তেজ হতে থাকলে কেরোসিনে আবার পাম্প করতে হত। প্রথমে অনেকক্ষন পাম্প করার পর ধীরে ধীরে একদম টিউব লাইটের মত ধবধবে সাদা আলো হতো যা এক নাগারে ৪-৬ ঘন্টা জ্বলতো। তারপর আবার পাম্প দিলে ১/২ ঘন্টা জ্বলতো। একটি হ্যাজাক বাতিতে ৩কেজি তেল ভড়লে চলতো সারারাত। অনেক সময় বেশি পাম্প দিলে তেল উপচে পড়ে যেতো।

মেন্টেল বা ফিল্টার

এই হ্যাজাকের মেন্টেল বা ফিল্টার লাগানো সবাই পারতো না। খুব সূক্ষ্মভাবে সতর্কতার সাথে লাগাতে হতো। মেন্টেল ফুটো হয়ে গেলে আবার নতুন মেন্টেল দিয়ে ট্রাই করতে হতো। তাই যারা পারতো তাদেরকে বড় কারিগর বলে মনে করা হতো তখন। প্রথম দিকে শুধু কেরোসিন চালিত হ্যাজাক দেখা যেতো। যদিও পরবর্তীতে গ্যাস চালিত হ্যাজাক ল্যাম্প বের হয়। কেরোসিনের হ্যাজাকে পাম্প দেওয়া লাগতো কিন্তু গ্যাসের হ্যাজাক লাইটে পাম্প লাগতো না।

আরও পড়ুনঃ নব্বই দশকের শৈশব স্মৃতি ও এক প্রজন্মের কথা

হ্যাজাক লাইট ছিল তখনকার বনেদী বাড়ির অহংকারের প্রতীক। উঠোনের মাঝখানে উঁচু টেবিলের উপরে জ্বলতো হ্যাচাক বাতি আর গোল হয়ে চারপাশে বসতো মজলিশি জনতা। তখন এমন একটা যুগ ছিল, যখন রাতের বড় আয়োজনে ২-৪ টা হ্যাচাক বাতি ছাড়া জমতোও না। বাতি জ্বলানোর সময় ছোট বাচ্চারা উৎসুক চোখে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে মজা দেখত। মেলায় দোকানীরা, বড় বড় হাটে, হকার বা ক্যানভাসাররা হ্যাজাক সব সময় রেডি রাখতো। হ্যাজাকের আলোতে যাত্রা+নাটক (থিয়েটার) করা হতো। বিয়ে শাদীতে হ্যাজাক খুবই কাজে লাগতো। সবাই তো আর হ্যাজাক কিনতে পারতো না। তখন বাজারে হ্যাজাক লাইট ভাড়া দেয়া হতো। যারা মাইক ভাড়া দিত, ডেকরেশন বা ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগেও অনেকে হ্যাজাক লাইট ভাড়া দিতো।

Download

যে হ্যাজাকের আলোয় গ্রামের বাড়িতে আমরা হই হল্লোর করে আনন্দ করতাম নানা ধরনের অনুষ্ঠানে। পশ্চিমা বিশ্বের অত্যাধুনিক অতিযান্ত্রিক শহরে বসে আজও সেই হ্যাজাকের আলোয় খুঁজে বেড়াই আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব আর দুরন্ত কৈশোর। এখন আর হ্যাজাক ব্যবহার করতে দেখা যায় না। হ্যাজাক ব্যবহারকারীদের মতে, হ্যাজাক বাতির ফিল্টার বা মেন্টেল এবং খুচরা যন্ত্রাংশ সচারাচর পাওয়া যায় না। কিছু নির্দিষ্ট দোকানেই মেলে ম্যান্টেলসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ। তাছাড়া আগের মত ব্যবহার না হওয়ায় হ্যাজাক সারানোর মিস্ত্রিও আগের মত নেই। এইভাবেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে নব্বই দশকের প্রিয় হ্যাজাক বাতি।

Facebook Comments

Similar Posts