বইয়ের নামঃ ইন্দুবালা ভাতের হোটেল
লেখকঃ কল্লোল লাহিড়ী
ধরনঃ সামাজিক উপন্যাস
প্রথম প্রকাশঃ ১২ জুলাই, ২০২০
প্রকাশনীঃ সুপ্রকাশ
মোট পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৫৭
ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৪.৫/৫
কিছু উপন্যাসই থাকে মন ভিজিয়ে দেয়া মায়া-আবেগ-ভালবাসার চাদরে মোড়ানো। “ইন্দুবালা ভাতের হোটেল” এর উজ্জ্বল উদাহরণ। এটি শুধু একটি উপন্যাসই নয়, এ যেন দুই বাংলার মধ্যকার একটি সেতুবন্ধনরূপী দলিল, যার সাথে মিলেমিশে একাকার পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম, নকশাল আন্দোলনের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতার মতো সব রক্ত টগবগ করে ওঠা অনুভূতি।
এই গল্প খুলনার কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী কোলাপোতা গাঁয়ের উচ্ছ্বল কিশোরী ইন্দুবালার,
যাকে বিয়ে নামক এক সামাজিক রীতির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যেতে হয়েছিল পশ্চিম বাংলায়, এপার বাংলার নাড়ি ছেঁড়া ধন হয়ে।
এই গল্প কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনের মল্লিক বাড়ির বৌ ইন্দুবালার, যাকে বৌভাতের দিনটি থেকেই স্বামী শ্বাশুড়ির চরিত্রের নিষ্ঠুর দিকটি দেখতে হয়েছিলো নিরুপায় হয়ে।
ইন্দুবালার জীবন আর আট দশটি সাধারণ মেয়ের জীবন থেকে অনেকখানিই আলাদা!
ছোটবেলা থেকেই মেধাবী এই মেয়েটি একসময় বুনেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার স্বপ্নও। কিন্তু সেই স্বপ্নে বাঁধ সাধল বিয়ে। পূর্ববাংলার স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রাক্কালে এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলায় বালিকা বধূ হয়ে গমন, খিটখিটে মেজাজের শ্বাশুড়ির অবিশ্রান্ত মুখঝামটা আর খোঁচা শুনেও মুখবুঁজে সংসারব্রত পালন, সন্তান মানুষ করার পাশাপাশি দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়েন — সবকিছু মিলিয়েই কেটে যাচ্ছিল তার রোজকার দিনগুলো। ছন্দপতন ঘটে স্বামীর নেশাগ্রস্থতার জেরে টাকায় টান পড়ায়, এবং পাওনাদারদের আগমনে।
একসময় বিধবা হন ইন্দুবালা; মদ্যপ নেশাখোর স্বামী অবশ্য ঋণের ভার চাপিয়ে যেতে ভোলেননি তরুণী স্ত্রীর উপরে। অসহায় ইন্দুবালা যখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখছিলো, ঠিক তখনই আশার আলো হয়ে তার পাশে এগিয়ে আসে মাছওয়ালী লছমী। আর সেই থেকেই পথচলা “ইন্দুবালা ভাতের হোটেল” এর।
আরও পড়ুনঃ আদর্শ হিন্দু হোটেল উপন্যাস PDF রিভিউ | বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
পুরনো কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনের এক এঁদো গলির বাড়িতে ১৫ বছরের যে মেয়েটি “রিফিউজি” আখ্যায় আখ্যায়িত হয়ে দোজবরে স্বামীর বউ হয়ে এসেছিলো, আজ সেই মেয়েটিই কালের আবর্তে হয়ে উঠেছেন এক অসাধারণ রাঁধুনী। আর আজকের “ইন্দুবালা ভাতের হোটেল” সেই রন্ধনশৈলীরই ফসল।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এই গল্প একইসাথে বর্তমানের সত্তর ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধা ইন্দুবালারও, যার মাঝেই গড়ে উঠেছিলো কোলাপোতা গাঁয়ের সেই কিশোরী এবং মল্লিক বাড়ির সেই বউয়ের সত্তা; এবং যাকে দুই বাংলার রন্ধনশৈলীর এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন বললেও ভুল হবেনা!
যতই কলকাতার রঙচঙে আধুনিকতার ভীড়ে এসে পড়ুন না কেন, ইন্দুবালার জীবনে খুলনার সেই কলাপোতা গাঁয়ের সাদামাটা সোনালী শৈশব – কৈশোরের আদরমাখা স্মৃতি আজও ভাস্বর। সময় গড়িয়ে গেলেও থেকে যায় সেসব স্মৃতিরা! আর এ স্মৃতির দরজা ভেঙে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে দিদার হাতের অসাধারণ রান্নার সেই স্বাদ, খুলনার কপোতাক্ষ নদ, গাঁয়ের হালদারদের বড় পুকুর, আমড়া মাখা খাওয়া, বাড়ির ধারের একাকী নারকেল গাছ, এমনকি কিশোর বয়সের ভাললাগার নাম করে আসা মনিরুলও!
সময় হয়ত নিয়ন্ত্রণে থাকেনা, কিন্তু সেই স্মৃতিরা থাকে, সেই স্মৃতিকে ঘিরে জন্ম নেয়া মায়া মমতারা আজো উঁকি দিয়ে বেড়ায় মনের আনাচে কানাচে, আমন্ত্রণ জানায় অতীতের সেই মুহূর্তগুলোকে সাদরে রোমন্থন করতে। আর সেই স্মৃতি বুকে আগলে ছেনু মিত্তির লেনের বাড়িটিতে রোজই তার সুস্বাদু রান্নার পসরা সাজিয়ে বসেন অশীতিপর বৃদ্ধা ইন্দুবালা, দিদার রান্নার আদর্শকে উপজীব্য করে।
আরও পড়ুনঃ মানসী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর PDF Download রিভিউ
এতকিছুর মাঝেও ইন্দুবালা কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে ধরে রেখেছিলেন সযত্নে। ছেলেমেয়ে নাতিপুতিরা যে যার মত করে থাকলেও নিজের মনের মণিকোঠায় আদরে পুষে রেখেছিলেন তাদের।
স্বাধীনতা সংগ্রাম, নকশাল আন্দোলনের পাশাপাশি দুই বাংলার সংস্কৃতির অনন্য মেলবন্ধন, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক, অসাম্প্রদায়িকতার মত বিষয়বস্তুগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে উপন্যাসটির প্রতি পরতে পরতে।
লেখক কল্লোল লাহিড়ী তার আপন মায়ার শব্দজালে বুনেছেন উপন্যাসের প্রতিটি কাহিনীবিন্যাস। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে বর্তমানকে উপজীব্য করে ইন্দুবালার অতীতে ফ্ল্যাশব্যাক করার বিষয়টি। এত সুনিপুণতার সাথে লেখক বর্তমানের ইন্দুবালা আর অতীতের ইন্দুবালাকে স্মৃতির বন্ধনে জুড়েছেন যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে যেতে হয়েছে গোটা উপন্যাসটি।
আর রান্নার বর্ণনা? সহজ সাবলীল শব্দচয়নে এত মায়া, আদর আর অনন্যতা মিশে ছিলো প্রতিটি রান্নার নামের সাথে, মনে হচ্ছিল ইন্দুবালা দেবী যেন খুব কাছেই আছেন, আর তার অসাধারণ সেসব রান্নার ঘ্রাণ যেন ভেসে আসছে সেই ওপার বাংলা থেকেই।
লিখেছেনঃ নাদিয়া আফরোজ
বইঃ ইন্দুবালা ভাতের হোটেল [ Download PDF ]
লেখকঃ কল্লোল লাহিড়ী
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
জনপ্রিয় ও সেরা কিছু বই PDF রিভিউ