লিও তলস্তয় জীবনী বাংলা টলস্টয় এর বই pdf download বুক রিভিউ বিশ্বসাহিত্যের সেরা বই উক্তি শ্রেষ্ঠ গল্প শয়তান leo tolstoy biography books pdf in bengali

বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : লিও টলস্টয় | শেষ পর্ব | Leo Tolstoy in Bengali

Redirect Ads

এ পর্যায়ে আমি একটু তলস্তয়ের রাজনীতিক দর্শন আলোচনা করতে চাই। কারণ, তাঁর অধিকাংশ লেখায়ই রাজনীতিক দর্শন প্রাধান্য পেয়েছে। আমি আগেই বলেছি তলস্তয় ছিলেন খ্রিস্টান, এবং এনার্কিস্ট। এনার্কিজম কী, তার কিছু ইঙ্গিতও আমি ইতোমধ্যে দিয়েছি। কিন্তু কেন তলস্তয় এনার্কিজমে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তার প্রেক্ষাপটটি আমাদের একটু অনুধাবন করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : লিও তলস্তয় | প্রথম পর্ব

Download

তলস্তয় একবার ফ্রান্সে, একটি প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড প্রত্যক্ষ করেছিলেন। রাষ্ট্রা কর্তৃক মানুষ খুনের এ দৃশ্যটি তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তিনি অনুধাবন করেন যে, রাষ্ট্র মূলত একটি গুন্ডাসংঘ। এটি ডাকাতদলের চেয়েও খারাপ। ডাকাতেরা অস্ত্র হিশেবে ব্যবহার করে ছুরিকা ও বন্দুককে, আর রাষ্ট্র অস্ত্র হিশেবে ব্যবহার করে আইনকে। তলস্তয় তাঁর ‘দি কিংডম অব গড ইজ উইদিন ইয়ু’ বইয়ে, রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইন, ও খ্রিস্টান চার্চের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তলস্তয়ের মতে, রাষ্ট্রের প্রধান কাজ মানুষকে নষ্ট করা।

তিনি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিজমারও বিরোধী ছিলেন। তাঁর এ বিরোধিতার কারণ, আমার ধারণা হেনরি জর্জ। জিওর্গিজম বা জর্জিজম নামে যে পলিটিক্যাল আইডিওলোজিটি আছে, সেটি হেনরি জর্জের সৃষ্টি। এ আইডিওলোজিটি অনেকের কাছে ‘সিঙ্গেল ট্যাক্স মুভমেন্ট’ নামে পরিচিত। তলস্তয় জিওর্গিজমের অনুসারী ছিলেন, এবং ‘রেজারেকশন’ নামে তাঁর যে-গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসটি আছে, সেটিতে তিনি মূলত জিওর্গিজমের দর্শনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ‘রেজারেকশন’-এ তলস্তয় দেখিয়েছেন যে, ক্ষমতাবান মানুষেরা কীভাবে তাদের নিজেদের সুবিধামতো আইন তৈরি করে মানুষকে শেকলবন্দী করে। এক ছটাক বিচারের সাথে, আইন কীভাবে বিশ ছটাক অবিচার উপহার দেয়, তার একটি অসাধারণ বর্ণনা ‘রেজারেকশন’। খ্রিস্টান চার্চের ভণ্ডামোর ব্যাপারটিও এখানে উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্র, আইন, ও চার্চ, এ তিনটি মিলে মানুষকে যেভাবে পাকড়াও করেছে, তার থেকে মুক্তির একটি ভালো উপায় হতে পারে জিওর্গিজম, তলস্তয় উপন্যাসটিতে এটিই বলতে চেয়েছেন। যদিও জিওর্গিজম, আমি মনে করি না তলস্তয়ের এনার্কিজমের সাথে যায়। অবশ্য তাঁর কিছু কিছু লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি জিওর্গিজমের একটি এনার্কিস্ট রূপও প্রস্তাব করেছিলেন।

আমি যে হাল আমলের বাংলা সাহিত্যকে খুব তুচ্ছ বলি, এবং এজন্য যে অনেকে আমার উপর রাগ করেন, তারা কি বলবেন, কেন আমরা এরকম একটি ‘রেজারেকশন’ বা তার ধারেকাছের কোনো লেখাও গত পঞ্চাশ বছরে পাই নি? কেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের সাহিত্য আবর্তিত হচ্ছে আমাদের দারিদ্র্য, দুঃখকষ্ট, প্রেম, আর পরকীয়াকে ঘিরে? কেন পলিটিক্যাল ও মোরাল ফিলোসোফির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমাদের সাহিত্যে অনুপস্থিত থেকেছে?
এর একটি কারণ হতে পারে, আমরা দর্শন বিষয়টিকে বুঝি না। আমি বহু মানুষকে দেখেছি, যাকে তাকে দার্শনিক ডাকতে। এমন কি যারা কবিতা, ছড়া, পদ্য, গল্প, ইতিহাস, রাজনীতিক কলাম ইত্যাদি লিখে থাকেন, তাদেরও আমি দার্শনিক ডাকতে দেখেছি। কাহলিল জিবরান বড় কবি ছিলেন। তাকে অনেকে বাঙালি-স্টাইলে দার্শনিক ডাকতো। কিন্তু জিবরান এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি কবিতা লিখেছি, দর্শন নয়। দর্শন অনেক উঁচু কাজ। দর্শন, মানুষ ও তার সমাজকে পথ দেখায়। কিছুদিন আগে একটি মেয়ে, নাম সম্ভবত জান্নাত প্রতিতি, আমাকে জিগ্যেস করেছিলো, আপনি কি মনে করেন জিবরান তাঁর ‘প্রফেট’-এ, জার্মান দার্শনিক নিটশার ‘দাজ স্পেইক জারাথুস্ট্রা’-কে অনুকরণ করেছেন? আমার উত্তর ছিলো—

দেখুন, There is a fundamental difference between philosophy and poetic emotion (অর্থাৎ দর্শন ও কাব্যিক আবেগের মধ্যে গুরুতর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে)।
হ্যাঁ, বড় বড় দার্শনিক কাজকে উপজিব্য করে প্রচুর সাহিত্য রচিত হয়েছে, যা ইতোমধ্যে আমি দস্তয়েভস্কি এবং তলস্তয় ভাষণে দেখিয়েছি। কিন্তু জিবরান, নিটশার দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, না কি তিনি নিটশার লিটারারি স্টাইলকে তাঁর কবিতায় অনুসরণ করেছিলেন, তা আলোচনা করতে হবে অন্য কোনো ভাষণে।

Download

আরও পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : লিও টলস্টয় | দ্বিতীয় পর্ব

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। বাংলা ভাষায় কোনো প্রকৃত দার্শনিক কখনোই ছিলো না। আমাদের শিক্ষা, আইন, রাজনীতি, ও সমাজ, এ চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র পুরোপুরি দর্শন ও দার্শনিকবঞ্চিত। কেউ কেউ এখানে গোবিন্দ্র চন্দ্র দেবের নাম করতে পারেন, কিন্তু তাঁর কোনো কাজ মৌলিক দর্শন ছিলো না। ওগুলো ছিলো অন্যের দর্শন নিয়ে আলোচনা। তিনি দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন, ডিগ্রি অর্জনের খাতিরে, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পদোন্নতি প্রক্রিয়ায়, এ একাডেমিক কাজগুলো তিনি করেছেন, কিন্তু এরকম কাজ আরও হাজার হাজার শিক্ষক, তাঁর আগে ও পরে অনেক করেছেন। তবে গুণগত মান আমলে নিলে, তাঁর মানের কাজ আমি এখন আর বাংলাদেশে কাউকে করতে দেখি না। বিশেষ করে তাঁর ‘Idealism: A New Defence and A New Application’, ‘Buddha: the Humanist’, এবং ‘আমার জীবনদর্শন’, এ তিনটির মানের সাথে তুলনা করলে, বাংলাদেশে এখন যারা দর্শন পড়ান তাদের আমার খুবই দরিদ্র মনে হয়।

এ দার্শনিকশূন্যতাই আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করছে, নানা ইঁদুর বিড়ালকে দার্শনিক ডাকতে। আমি যখন কলেজে ছিলাম, তখন আমাদের ইংরেজির এক শিক্ষক, আরজ আলি মাতুব্বরকে দার্শনিক বলে মন্তব্য করেছিলেন! আরেকজন বলেছিলেন, লালন ফকির দার্শনিক! আমরা যেহেতু দর্শন ও দার্শনিক কী তা জানতাম না, তাই আমরা মাননীয় শিক্ষকদের কথা বিশ্বাস করেছিলাম। এ বিশ্বাস নিশ্চয়ই অনেকের হৃদয়ে এখনও টিকে আছে। মিথ্যে, সত্য হিশেবে এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়। বহু পত্রিকায় দেখি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে দার্শনিক হিশেবে সম্বোধন করা হচ্ছে! আবার এ অঞ্চলে, অনেক মৃত ব্যক্তিকে মহান হিশেবে উপস্থাপন করতেও ‘দার্শনিক’ শব্দটির ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো হলো পাগলামো। লেজ যাদের ভেতরে, তারা এসব কাজ করে থাকতে পারে (ছাগলের লেজ বাহিরে থাকে বলে দেখা যায়, কিন্তু মানুষের লেজ চিরকাল ভেতরে থাকে)।

দর্শনের প্রসঙ্গ যখন উঠেছে, তখন এটিকে সামান্য লম্বা করা যাক। আগে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকেই দর্শন ডাকা হতো। নিউটন এবং লিবনিজ দার্শনিক ছিলেন, কারণ তাঁরা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, যেটি এখন পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত, নিয়ে মৌলিক কাজ করেছিলেন। এরিস্টোটল কাজ করেছিলেন জীববিজ্ঞান, মহাবিশ্ব, সমাজ, রাজনীতি, ও শিক্ষা নিয়ে। পিথাগোরাস, ইউক্লিড, তাঁরা কাজ করেছিলেন জ্যামিতি নিয়ে। কিন্তু এখন আর ওরকমটি নেই। এখন বিজ্ঞান আবির্ভূত হয়েছে জ্ঞানের আলাদা শাখা হিশেবে। তবে দর্শন রয়ে গেছে তার আগের জায়গাটিতেই। প্রশ্ন আসতে পারে, দর্শন কী? এর উত্তরে আমি বার্ট্রান্ড রাসেলের সাহায্য নিতে পারি। রাসেল তাঁর ‘দি হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসোফি’-র ভূমিকায় দর্শনের একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। সংজ্ঞাটি আমার পছন্দ হয়েছে (যদিও দর্শনের ব্যাপারে আমার নিজস্ব সংজ্ঞা আছে)। রাসেল লিখেছেন (আমি উদ্ধৃত করছি George Allen and Unwin, 1947, Hardcover এডিশনের ১০ নাম্বার পৃষ্ঠা থেকে):

Download

“All definite knowledge— so I should contend— belongs to science; all dogma as to what surpasses definite knowledge belongs to theology. But between theology and science there is a No Man’s Land, exposed to attack from both sides; this No Man’s Land is philosophy.”

অর্থাৎ যতো নিশ্চিত জ্ঞান আছে, তা বিজ্ঞানের; এবং যতো বিশ্বাসভিত্তিক ধারণা আছে, তা ধর্মতত্বের। কিন্তু বিজ্ঞান ও ধর্মতত্বের মাঝখানে একটি এলাকা আছে, যেটি বিজ্ঞান ও ধর্মতত্ব উভয়ের শত্রু। এ এলাকাটিই দর্শন। এ এলাকাটি মাঝে মাঝে বিজ্ঞানকে পথ দেখায়, মাঝে মাঝে ধর্মকে। ইমানুয়েল কান্ট এ এলাকা থেকে আইনস্টাইনকে পথ দেখিয়েছিলেন, আবার সেইন্ট থমাস একুইনাস এ এলাকা থেকে ধর্মকে পথ দেখিয়েছিলেন। মহাবিশ্ব, ঈশ্বর, মানুষ, সমাজ, কল্পনা, বাস্তবতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, নৈতিকতা, আইন, সবই এ এলাকার বিষয়বস্তু। আমি ধান ভানতে শিবের গীত আর গাইবো না। শুধু আহ্বান জানাবো, যাকে তাকে দার্শনিক ডাকাটা আপনাদের বন্ধ করতে হবে। কারণ, এতে প্রকৃত দার্শনিকদের অপমান করা হয়।
অনেকের কৌতূহল জাগতে পারে, কেন তলস্তয় জিওর্গিজমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। জিওর্গিজম মানুষের শ্রমের উপর (অর্থাৎ পরিশ্রম করে আয় করা টাকার উপর) ট্যাক্স আরোপ করতে নিষেধ করে থাকে। জিওর্গিজম বলে যে, রাষ্ট্রকে শুধুমাত্র জমির মূল্যের উপর ট্যাক্স বসাতে হবে, এবং এ ট্যাক্স দিয়েই তাকে চলতে হবে। এটিকে বলা হয় ‘ল্যান্ড-ভ্যালু-ট্যাক্স’।

এডাম স্মিথও এরকম ট্যাক্স ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছিলেন। তবে জিওর্গিজমের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো— জমিজমার কোনো মালিকানা থাকবে না। জমিজমা হবে সবার। মানুষ যা উৎপাদন করবে, তার মালিকানা সে ভোগ করবে, কিন্তু যা কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন জমিজমা, এবং জমিজমার নিচের খনিজ পদার্থ, সেগুলোর কোনো ব্যক্তিমালিকানা থাকবে না। সেগুলোর মালিক সবাই। জর্জ তাঁর ‘পোভার্টি অ্যান্ড প্রগ্রেস’ বইয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। জর্জের এ ধারণা, তলস্তয়ের খুব মনে ধরেছিলো। কারণ জর্জের মতো, তলস্তয়ও দেখেছিলেন যে, মানুষের দারিদ্র্য ও দুর্দশার মূলে রয়েছে জমিজমার মালিকানা। কারও থাকবে এক হাজার বিঘা, আর কারও থাকবে এক বিঘা, এটি হতে পারে না। মানুষ তো জমি সৃষ্টি করে নি। তলস্তয় তাঁর ‘রেজারেকশন’ উপন্যাসে দেখান যে, কীভাবে নিখলাইয়োদোভ চরিত্রটি, একসময় তার সমস্ত ব্যক্তিসম্পত্তি, কৃষকদের বিলিয়ে দেন।

আরও পড়ুনঃ জিপিএ ফাইভ পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছিলো জুতোর ফ্যাক্টোরিতে

আরেকটি ব্যাপার মনে পড়ছে। দস্তয়েভস্কি যেখানে তাঁর উপন্যাসগুলোতে নানাভাবে পতিতাদের চরিত্র এঁকেছেন, তলস্তয় সেখানে, বিশেষ করে ‘রেজারেকশন’ উপন্যাসে, দেখিয়েছেন কীভাবে একজন হতভাগ্য নারী ধীরে ধীরে পতিতা হয়ে ওঠেন। নিখলাইয়োদোভ যদি কাতিওশাকে ধর্ষণ না করতো, তাহলে হয়তো কাতিওশা পতিতাবৃত্তিতে যেতো না। কারণ ওই ধর্ষণের ফলেই সে গর্ভবতী হয়, এবং গর্ভবতী হওয়ার ফলে তাকে গৃহচ্যুত হতে হয়, আর গৃহচ্যুত হওয়ার পর তার জীবনে নেমে আসে একের পর এক দুর্দশা, যা তাকে ধীরে ধীরে নিয়ে যায় পতিতাবৃত্তিতে।

Download

সম্পত্তির লোভকে তলস্তয় খুব অপছন্দ করতেন। কতোটা অপছন্দ করতেন, তা সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর ‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ আ ম্যান রিকোয়ার?’ গল্পটিতে। তলস্তয় গল্পটিতে দেখিয়েছেন, কীভাবে গল্পটির নায়ক, পর্যাপ্ত সম্পত্তি থাকার পরও, আরও সম্পত্তির লোভে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। গল্পটিতে পাহোম নামক একজন চাষীকে প্রস্তাব দেয়া হয়, সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত তুমি হেঁটে বা দৌড়ে, যতো জমি পরিভ্রমণ করতে পারবে, তার সব জমি তোমাকে মাত্র এক হাজার টাকায় (টাকা মানে রুবল) দিয়ে দেয়া হবে। শর্ত হলো, যেখান থেকে দৌড় শুরু করবে, সূর্যাস্তের আগে সেখানে ফেরত আসতে হবে। চাষী দেখলো এ তো বিরাট সুযোগ। সে কোদাল দিয়ে মাটিতে একটি কোপ দিলো। এ কোপটি হলো চিহ্ন, যেখানে তাকে সূর্যাস্তের আগে ফেরত আসতে হবে। সে দেখলো, হেঁটে পরিভ্রমণ করলে বেশি জমি পাওয়া যাবে না। তাই সে শুরু করলো দৌড়। দৌড়ে সে অনেক জমি নিজের করে নিলো, কিন্তু যেখান থেকে দৌড় শুরু করেছিলো, সেখানে ফেরত আসতে আসতে, দৌড়ের হাঁপানিতে তার প্রাণ চলে গেলো। দেখা গেলো, তাকে কবর দিতে মাত্র ছয় ফুট জমির প্রয়োজন পড়লো। বাকি জমি তার কোনো কাজে এলো না।

বাংলাদেশে এরকম পাহোমের সংখ্যা কোটি কোটি। রাতদিন তারা কাজ করছে, টাকা উপার্জন করছে, কিন্তু এ উপার্জনের ক্লান্তিতেই একদিন মৃত্যুবরণ করছে।
জেমস জয়েস, তাঁর মেয়েকে লেখা এক চিঠিতে গল্পটির খুব প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীতে মানুষ যতো গল্প লিখেছে, তার মধ্যে এটিই শ্রেষ্ঠ গল্প। আমাদের রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলিতে, তলস্তয় এবং এলান পো, এ দুজনের গল্পের মিশ্র প্রভাব রয়েছে।
আমি ভাষণটি আর বেশি লম্বা করবো না। তবে শেষ করার আগে, তলস্তয়ের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস, ‘দি ডেথ অব ইভান ইলিচ’ নিয়ে সামান্য বলতে চাচ্ছি। কারণ সাহিত্যকর্ম হিশেবে, উপন্যাসটি গুরুত্বপূর্ণ।

উপন্যাসটি, মৃত্যুমুখে পতিত একজন অসুস্থ বিচারপতিকে নিয়ে। এখানে আমি একটি সম্ভাবনার কথা বলতে চাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আহমদ ছফা তাঁর ‘মরণ বিলাস’ উপন্যাসটি তলস্তয়ের ‘দি ডেথ অব ইভান ইলিচ’-কে নকল করে লিখেছেন। মরণ বিলাসের মন্ত্রীর উচ্চাভিলাষ, আর বিচারপতি ইভান ইলিচের উচ্চাভিলাষ একই ধরণের। আহমদ ছফা শুধু, বিচারপতির জায়গায় একজন বাঙালি মন্ত্রীকে বসিয়ে দিয়েছেন। ইভান ইলিচ, তাঁর মৃত্যশয্যায় সান্নিধ্য পায় জিরাসিম নামে একজন চাকরের, আর মরণ বিলাসের মন্ত্রী, তাঁর মৃত্যুশয্যায় সান্নিধ্য পায় মাওলা বক্স নামের এক দলকানা দাসের। ইভান ইলিচের মতে, তিনি জীবনে কোনো খারাপ কাজ করেন নি। তিনি যতো কাজই করেছেন, তার সবগুলোকেই তিনি, মনে মনে নানা অজুহাত দিয়ে, বৈধতা দিয়েছেন।

একই চিত্র দেখা যায় মরণ বিলাসের মন্ত্রীর ক্ষেত্রে। চাচাতো ভাইয়ের বউকে গর্ভবতী করা (যিনি পরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন), ইশকুলের হেডমাস্টারের ঘর পুড়িয়ে দেয়া, নিজের আপন ভাইকে হত্যা, এবং আরও নানা কাজকে মন্ত্রী, কোনো না কোনো অজুহাতে বৈধতা দিয়েছিলেন। স্ত্রী-সন্তানদের ইভানের সম্পর্ক, আর মরণ বিলাসের মন্ত্রীর সাথে মন্ত্রীর স্ত্রী-পুত্রদের সম্পর্ক, বলা যায় হুবহু এক। আমার ধারণা, যার ‘দি ডেথ অব ইভান ইলিচ’ পড়া আছে, তিনি সহজেই আমার মতের সাথে একমত পোষণ করবেন।

আহমদ ছফা তাঁর এক সাক্ষাৎকারে, রবীন্দ্রনাথকে ‘তালি মারা’ বিদ্যায় অভিযুক্ত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, এর লেখা ওর লেখা থেকে নিজের লেখায় জোড়াতালি মেরেছেন, এটি বলে হয়তো এক ধরণের তাচ্ছিল্যসুখ পাওয়া যায়, কিন্তু আহমদ ছফা যে তলস্তয় থেকে অত্যন্ত ব্যর্থভাবে এ তালিটি মারলেন, এ প্রশংসা আমি কীভাবে করবো?

তলস্তয় যেখানে মৃত্যু ও জীবন নিয়ে তাঁর নিজের দর্শনকে বর্ণনা করেছেন, আহমদ ছফা সেখানে এক মন্ত্রীকে দিয়ে, অত্যন্ত খাপছাড়াভাবে, উত্তেজনামিশ্রিত কয়েকটি নাটকীয় ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

Download

আরও পড়ুনঃ ছাগল ও তার পিএইচডি ডিগ্রি : ডক্টরেট ডিগ্রির আদ্যোপান্ত

তলস্তয়, ইভান চরিত্রটির মাধ্যমে, মূলত জীবনের সাথে মৃত্যুর যে-সংঘাত ও জটিলতা, সে-চিত্রই এঁকেছেন। জীবনকে যাপন করার আয়োজন, সে যে-রকমই হোক না কেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হলে যে সে-আয়োজন অর্থহীন হয়ে পড়ে, সে-দর্শনটিকেই তলস্তয়, এ উপন্যাসে বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসটির দার্শনিক মূল্য আছে। হেইডেগার তাঁর ‘বিং অ্যান্ড টাইম’-এ, এ উপন্যাসটির কথা উল্লেখ করেছিলেন।

অবশ্য শুধু এ উপন্যাসটিতে নয়, তলস্তয় তাঁর শেষ জীবনের সব লেখাতেই তাঁর ব্যক্তিগত দর্শনকে উপজীব্য করেছেন। তাঁর ‘ক্রিয়েতজোরোভা সানাতা’, এবং ‘দি ডেভিল’-ও এ ঘরানার উপন্যাস।

‘ক্রিয়েতজোরোভা সানাতা’-য় তাঁর যৌনতাবিরোধ ফুটে উঠেছে, যদিও তিনি নিজে ১৪টি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন! এটিকে আমার ভণ্ডামো মনে হয়েছে। সারাজীবন সঙ্গম করে এসে, বুড়ো বয়সে তাঁর এ সঙ্গমবিরোধিতার কারণ আমার বোধগম্য নয়।

যাইহোক, আমি আর আলোচনা বাড়াচ্ছি না। ভাষণটিকে ছোট রাখতে, আমি তলস্তয়ের সব লেখা এখানে আলোচনা করি নি। যেগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, সেগুলো নিয়েই কথা বলেছি। কিন্তু আমার আলোচনার বাইরেও, তলস্তয়ের বহু গুরুত্বপূর্ণ রচনা রয়েছে। বিশেষ করে, তাঁর প্রবন্ধের কথা পাঠক তেমন জানেনই না। তাঁর প্রবন্ধ অত্যন্ত শক্তিশালী। অনেক উপন্যাসের চেয়ে, তাঁর এ প্রবন্ধগুলোকে আমার অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। ওয়ার অ্যান্ড পিস বা আন্না কারিনিনা পড়ার পাশাপাশি, তাঁর ‘হোয়াই ডু মেন ইনটোক্সিকেইট দেমসেলভস’ বা ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ পড়াও সমান জরুরি। অন্যথায় তলস্তয়ের চিন্তা ও দর্শনের সাথে, আমরা অপরিচিতই থেকে যাবো।

তলস্তয়ের জীবনী আমি ইচ্ছা করেই আলোচনা করি নি। কারণ এসব জীবনী টিবনী অনেকেই আলোচনা করেন। তিনি কতোটা জমিদার ছিলেন, কতো বছর বেঁচে ছিলেন, কখন কাকে বিয়ে করেছিলেন, তাঁর বংশ পরিচয় কী, এসব আমার আলোচনার বিষয় ছিলো না। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলতে আমি ভুলে গেছি। তলস্তয় শুধু লেখক ছিলেন না, তিনি ছিলেন অনেকটা নবীর মতো। বহু রুশ তরুণ তাঁর কিছু মতবাদ দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলো। এ তরুণদের বলা হতো তলস্তয়বাদী। একসময় এরা বলশেভিক পার্টির রোষানলে পড়েছিলো, এবং লেনিন-স্তালিন জুটি, তাদের অনেককেই হত্যা করেছিলো। লেনিন তাঁর নিজ দলের লোক ছাড়া, বাকি সবাইকে পোকামাকড় ডাকতো। তাঁর পোকামাকড়ের সংজ্ঞায়, তলস্তয়বাদীরাও ছিলো। তাদের অপরাধ ছিলো, তারা মানুষ খুন করতে বন্দুক হাতে নিতে পারবে না। শোলঝিনিতসিনের ভাষায় (আমি উদ্ধৃত করছি ‘দি গুলাগ আর্কিপেলাগু’, হার্পার পেরেনিয়াল সংস্করণ ২০০৭, প্রথম খন্ড, ২৮ পৃষ্ঠা থেকে) :

Download

“And all those Tolstoyans who, when they undertook to serve the Soviet government on, for example, the railroads, refused to sign the required oath to defend the Soviet government with gun in hand thereby showed themselves to be insects too.”

আরও পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : ফিওদর দস্তয়েভস্কি | প্রথম পর্ব

লেনিনের মতো বন্দুকবাদীরা, তলস্তয়ের নির্বন্দুকবাদকে শত্রুজ্ঞান করবেন, এটিই স্বাভাবিক। আমি আগ্রহী পাঠকদের জন্য, তলস্তয়ের লেখাগুলোর একটি তালিকা দিয়ে দিচ্ছি—
বড় উপন্যাস:
১। War and Peace (1869)
২। Anna Karenina (1877)
৩। Resurrection (1899)
ছোট উপন্যাস:
১। Childhood (1852)
২। Boyhood (1854)
৩। Youth (1856)
(এ তিনটি তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস)
৪। Family Happiness (1859)
৫। The Cossacks (1863)
৬। The Death of Ivan Ilyich (1886)
৭। The Kreutzer Sonata (1889)
৮। The Devil (1889)
৯। The Forged Coupon (1911)
১০। Hadji Murat (1912, 1917)
ছোট গল্প:
১। The Raid (1852)
২। The Wood-Felling (1855)
৩। Sevastopol Sketches (1855–1856)
৪। Sevastopol in December 1854 (1855)
৫। Sevastopol in May 1855 (1855)
৬। Sevastopol in August 1855 (1856)
৭। A Billiard-Marker’s Notes (1855)
৮। The Snowstorm (1856)
৯। Two Hussars (1856)
১০। A Landlord’s Morning (1856)
১১। Lucerne (1857)
১২। Albert (1858)
১৩। Three Deaths (1859)
১৪। The Porcelain Doll (1863) – এটি মূলত একটি চিঠি। চিঠিটি তলস্তয়, লিখেছিলেন তাঁর শালীকে। অনেকের মতে, চিঠিটি ছোট গল্প।
১৫। Polikúshka (1863)
১৬। God Sees the Truth, But Waits (872)
১৭। The Prisoner in the Caucasus (1872)
১৮। The Bear-Hunt (1872)
১৯। Memoirs of a Madman (1884)
২০। Croesus and Fate (1886)
২১। An Old Acquaintance (1887)
২২। Kholstomer or Strider (1888)
২৩। A Lost Opportunity (1889)
২৪। Françoise (1891) – এ গল্পটি মোঁপাসার ‘পোর্ট’ বা ‘বন্দর’ গল্পটিকে অবলম্বন করে রচিত।
২৫। A Talk Among Leisured People (1893)
২৬। Walk in the Light While There is Light (1893)
২৭। The Coffee-House of Surrat (1893)
২৮। The Young Tsar (1894)
২৯। Master and Man (1895)
৩০। Too Dear! (1897)
৩১। Father Sergius (1898)
৩২। The Long Exile (1899)
৩৩। Work, Death, and Sickness” (1903)
৩৪। Three Questions (1903)
৩৫। After the Ball (1903)
৩৬। The Posthumous Notes of the Starets Feodor Kuzmich (Unfinished, 1905, published in 1912)
৩৭। Alyosha the Pot (1905)
৩৮। Divine and Human (1906)
৩৯। What For? (1906)
৪০। There Are No Guilty People (1909)
৪১। Three Days in the Village (1910)
৪২। Singing In The Village (1910)
৪৩। A Talk With A Wayfarer (1910)
৪৪। Traveller and Peasant (1917)
৪৫। Khodynka: An Incident of the Coronation of Nicholas II (1910)
৪৬। My Dream (1911)
বিশেষায়িত গল্পসমূহ:
১। The Two Horses (1880)
২। What Men Live By (1881)
৩। Karma (1894)
৪। Ilyás (1885)
৫। Where Love Is, God Is (1885)
৬। Evil Allures, But Good Endures (1885)
৭। Wisdom of Children (1885)
৮। Quench the Spark (1885)
৯। Two Old Men (1885)
১০। The Candle (1886)
১১। Ivan the Fool (1885)
১২। The Three Hermits (1886)
১৩। Promoting a Devil (1886)
১৪। Repentance (1886)
১৫। The Grain (1886)
১৬। How Much Land Does a Man Need?” (“Много ли человеку земли нужно”, 1886)
১৭। The Godson (1886)
১৮। Three Sons (1889)
১৯। The Empty Drum (1891)
২০। The Restoration of Hell (1903)
২১। Esarhaddon, King of Assyria (1903)

এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন। এ তালিকার বাইরেও তলস্তয়ের কিছু গল্প আছে, যেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ বের হয় নি। ওই গল্পগুলি আমি এখানে উল্লেখ করি নি।
নাটক:
১। The Power of Darkness (1886)
২। The First Distiller (1886)
৩। The Light Shines in Darkness (1890)
৪। The Fruits of Enlightenment (1891)
৫। The Living Corpse (1900)
৬। The Cause of it All (1910)
দার্শনিক রচনাবলী:
১। A Confession (1879)
২। A Criticism of Dogmatic Theology (1880)
৩। The Gospel in Brief, or A Short Exposition of the Gospel (1881)
৪। The Four Gospel Unified and Translated (1881)
৫। Church and State (1882)
৬। What I Believe (এটি ‘My Religion’ নামেও পরিচিত) (1884)
৭। What Is to Be Done? (also translated as What Then Must We Do?) (1886)
৮। On Life (1887)
৯। Supplementary essay for Timofei Bondarev’s The Triumph of the Farmer or Industry and ১০। Parasitism (1888)
১১। Why Do Men Intoxicate Themselves? (1890)
১২। The First Step: on vegetarianism (1892)[2]
১৩। The Kingdom of God Is Within You (1893)
১৪। Non-Activity (1893)
১৫। Reason and Religion (1894)
১৬। Religion and Morality (1894)
১৭। Christianity and Patriotism (1894)
১৮। Non-Resistance: letter to Ernest H. Crospy (1896)
১৯। How to Read the Gospels (1896)
২০। The Deception of the Church (1896)
২১। Letter to the Liberals3
২২। Christian Teaching (1898)
২৩। On Suicide (1900)
২৪। The Slavery of Our Times (1900)
২৫। Thou Shalt Not Kill (1900)
২৬। Reply to the Holy Synod (1901)
২৭। The Only Way (1901)
২৮। On Religious Toleration (1901)
২৯। What Is Religion and What is its Essence? (1902)
৩০। To the Orthodox Clergy (1903)
৩১। Bethink Yourselves! (1904)
৩২। The Only Need (1905)
৩৩। The Great Sin (1905)
৩৪। Do Not Kill (1906)
৩৫। Love Each Other (1906)
৩৬। An Appeal to Youth (1907)
৩৭। The Law of Love and the Law of Violence (1908)
৩৮। A Letter to a Hindu (1908)
৩৯। The Only Command (1909)
৪০। A Calendar of Wisdom (1909)
শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ:
১। The Works of Guy de Maupassant (1894)
২। What Is Art? (1897)
৩। Shakespeare and the Drama (1909)
শিক্ষা বিষয়ক কাজ:
১। Articles from Tolstoy’s Journal on Education, Yasnaya Polyana (1861–1862)
২। A Primer (1872)
৩। On Popular Instruction (1874)
৪। A New Primer (1875)
অন্যান্য প্রবন্ধ:
১। Meaningless aspirations (1895)
২। I can’t be silent (1908)
অসমাপ্ত কাজ:
১। The Decembrists (এটি তলস্তয়, ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর পরবর্তী সিকুয়েল হিশেবে লেখা শুরু করেছিলেন)
২। Prince Fyodor Shchetinin
এর বাইরে তাঁর একটি অসমাপ্ত উপন্যাস আছে। উপন্যাসটি ছিলো সম্রাট পিটার দ্য গ্রেটকে নিয়ে। উপন্যাসটির নাম, তলস্তয় কী ঠিক করেছিলেন, তা জানা যায় নি।

লিখেছেনঃ মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার

Download
Facebook Comments

Similar Posts