Skip to content
Home » পথের পাঁচালীর দিনগুলি | ইমতিয়াজ তন্ময়|Pather Panchali

পথের পাঁচালীর দিনগুলি | ইমতিয়াজ তন্ময়|Pather Panchali

    পথের পাঁচালী সত্যজিৎ রায় Pather Panchali story analysis satyjit ray pdf
    Redirect Ads

    সময়টা প্রায়ই ৪৪-৪৫, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনও চলছিল। যুদ্ধের সুবাদে মার্কিন সেনারা কলকাতায় ছিলেন। বিশ্বযুদ্ধের নানান ঘটনা কলকাতার সংস্কৃতি জগতে প্রভাব ফেলে। আমেরিকান সৈন্যদের জন্য প্রায়ই গান-বাজনার আয়োজন করা হতো, কনসার্টও হতো মাঝেমাঝে। সত্যজিৎ রায় মাঝেমধ্যে শুনে আসতেন এসব গান। তখন তিনি একটা বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখাপথের পাঁচালী র কিশোর সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’র প্রচ্ছদের কাজও করে ফেলেছেন ততদিনে।

    মার্কিন সৈন্যরা তখন শুধু গান-বাজনাই করত না, সিনেমা দেখারও আয়োজন করত। সেই সুবাদে সত্যজিতও এসব সিনেমা দেখতেন। মুক্তি না পাওয়া অনেক সিনেমাও দেখার সুযোগ হতো এখানে। হলিউডের এসব চলচ্চিত্রে গল্প বলার ধরণ, নির্মাণের স্টাইল ইত্যাদি আকৃষ্ট করে তাঁকে। এভাবেই চলচ্চিত্র জ্ঞান সমৃদ্ধ হয় তাঁর। এরপর একাএকা চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করতেন, সিনেমা দেখতেন আর বিভিন্ন নোট টুকে রাখতেন। ডজনখানেক চিত্রনাট্যও লিখলেন আগ্রহ থেকে। মাঝে অবশ্য হরিসাধন দাশগুপ্তর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে বাইরে’র চিত্রনাট্য লেখার সুযোগ এসেছিল। যদিও সেই কাজ থেমে যায় কিছুদিনের মধ্যে। এর কয়েক বছর পরই গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিতি পেলেন। আজ সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্রে অভিষেকের ঘটনাটা উপস্থাপন করছি।

    Download

    আরও পড়ুনঃ সত্যজিৎ রায় : বাংলা চলচ্চিত্রের এক মহারাজা | Biography

    প্রযোজকদের দরজায় সত্যজিৎ রায়

    চলচ্চিত্র নির্মাণে মনঃস্থির করলেন সত্যজিৎ রায়। প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে কিছু করবেন তেমনটাই ইচ্ছে ছিল। বেছে নিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী। প্রথমে স্ক্রিপ্টেই হাত দিয়েছিলেন। তবে পথের পাঁচালীর পূর্ণাঙ্গ চিত্রনাট্য কখনোই তৈরি করা হয়নি। পুরো গল্পটা এমনভাবে গেঁথে গেছিল সত্যজিৎ রায়ের তাতে আলাদাভাবে চিত্রনাট্য আর লেখা হয়নি। ছিল কিছু স্কেচ আর নোট। সত্যজিতের মতে লিখিত চিত্রনাট্যের থেকে এই স্কেচগুলো দিয়ে সবাইকে কাজ বোঝানো সহজ। বিস্তারিত সব স্কেচ করার পর টাকা জোগাড়ের আগে স্বত্বটা পাওয়া প্রয়োজন মনে করলেন। চিত্রসত্বের জন্য গেলেন বিভূতিপত্নী রমা বন্দ্যোপাধ্যায় এর কাছে। চিত্রগুলো দেখে রমাদেবীর খুবই ভালো লাগে। এই সত্বে তিনি কোন টাকা নিতে রাজি হননি। চুক্তিটা নামেমাত্র হয়ে গেলো।

    এখন প্রয়োজন টাকার, প্রযোজকের। বেশ কয়েকজন প্রযোজকের সাথে যোগাযোগ করা হলে সরাসরি নাকচ করে দেওয়া হয়। যে সিনেমায় প্রেম, নাচ-গান, একশন থাকবে না, থাকবে না বড় কোন স্টার তাতে টাকা ঢেলে কেউ ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিলো না। এরপর আগ্রহ দেখালেন কল্পনা মুভিজের মিঃ ভট্টাচার্য। দশ দিন সময় চাইলেন। তবে তিনদিনের মাথায় সত্যজিৎ খবর পেলেন মিঃ ভট্টাচার্য নামকরা ডিরেক্টর দেবকী বসুকে দিয়ে এই সিনেমাটি করতে চান। এই স্বত্বের জন্য রমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ৩০ হাজার টাকার অফার করলেও রমাদেবী সরাসরি নাকচ করেন। তিনি বলেছিলেন, এই ছবি সত্যজিৎ রায়ই তুলবেন। আর কেউ তুলুক, এটা তিনি চান না। ভালো আর খারাপ দুটো খবরই পাওয়া গেলো। স্বত্বটা রায় হারাচ্ছেন না, আবার আরেকটা প্রযোজক হাতছাড়া হলো।

    পথের পাঁচালী র বাজেট ধরা হয়েছিল ৭০ হাজার টাকা। একে তো মারামারি ও প্রচলিত অন্যান্য উপাদানগুলো নেই; আবার নির্মাতা, ক্যামেরাম্যান ও অভিনয়শিল্পীদের অনেকেরই পূর্বে সিনেমায় কাজ করার কোন অভিজ্ঞতা নেই। এসব নিয়েই মূলত কেউই যেন আগ্রহী না। আর বিজ্ঞাপনী কোম্পানি থেকে মাসে ১৮০০ টাকা মাইনে পান। সম্পূর্ণ নিজের অর্থ দিয়ে একটা সিনেমা বানানো অসম্ভব বটে। তবুও ইচ্ছে একটুও দমে যায়নি সত্যজিতের। অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন মিলিমিটারে কিছু কমবেশি করে বাজেট কমানোতে। তবে সে চেষ্টা খুব একটা কার্যকরী হয়নি। এখন একমাত্র উপায় হচ্ছে নিজের পয়সা খরচ করা।

    Download

    ইনসিওরেন্স পলিসি থেকে সাত হাজার টাকা পেলেন। মাঝে স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। কিছু দুষ্প্রাপ্য বই ও রেকর্ডও বিক্রি করতে হয়েছিল তাঁকে। কাজ শুরুর সময় তাঁদের হাতে তখন ১৭ হাজার টাকা ছিল। সেই দিয়ে কিছুদিন কাজ চললো। এরপর রানা দত্ত নামে এক প্রযোজকের দেখা মিললো। প্রথম কিস্তিতে তিনি ৪০ হাজার দিলেন, বাকিটা পরে দিবেন সেই কথা হলো। প্রথম কিস্তির টাকা দিয়ে সিনেমার এক তৃতীয়াংশ নির্মাণ করা গেছে। এরপর রানা দত্তের একটা সিনেমা বাজেভাবে ফ্লপ হওয়ায় এই ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়ালেন। ফলে নতুন প্রযোজক খোঁজার সাথে সাথে রানাবাবুর টাকা ফেরত দেওয়ার আরেকটা চাপ বাড়লো।

    এরপর আশার আলো দেখা গেলো পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের থেকে। তিনি আগ্রহী ছিলেন এই প্রজেক্টে। তবে বললেন শেষটা পরিবর্তন আনতে হবে। এমন ট্র্যাজেডি দিয়ে শেষ হোক তিনি তা চাননি। রাজি হননি সত্যজিৎ রায়। তবে বিধান চন্দ্র শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিলেন। তারজন্য অবশ্য ডাঃ রায়ের দুইজন কর্মীকে নির্মিত অংশটা দেখাতে হয়েছিল। এরমধ্যে একজন ইতিবাচক রিপোর্ট করে, আরেকজন নেতিবাচক। ডাঃ রায় ইতিবাচকটাই গ্রহণ করেছিলেন। আর এভাবেই হয়ে গেলো অর্থ সংগ্রহের কাজ।

    আরও পড়ুনঃ বিষয় চলচ্চিত্র সত্যজিৎ রায় পিডিএফ রিভিউ

    অভিনয়শিল্পী বাছাই

    বই থেকে অনেক কিছুর পরিবর্তন করেছিলেন সত্যজিৎ। সিনেমায় রূপান্তরে কিছু চরিত্র বাদ দিয়েছেন। আবার কিছু চরিত্রকে বইয়ের থেকে বেশি সময় দিয়েছেন। অভিনয়শিল্পীদের কীভাবে বাছাই করলেন এবার সেই ঘটনা জানা যাক।

    Download

    সত্যজিৎ রায় এমন সব অভিনয়শিল্পী চাচ্ছিলেন যাদের পূর্বে তেমন অভিনয়ের অভিজ্ঞতা নেই। তবে বাবা-মা, পিশি এই চরিত্রগুলো জন্য পেশাদার অভিনয়ের প্রয়োজন ছিল। এক বন্ধুর পত্মী যিনি থিয়েটারে অভিনয় করেন, তাঁকেই সর্বজয়ার চরিত্রটা দিবেন বলে ঠিক করেন। তবে ইনি আবার শহরের গ্র্যাজুয়েট মহিলা, গ্রামের বউয়ে কতটুকু মানিয়ে নিতে পারবেন সেটা নিয়েও সংশয়। নেওয়া হলো করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

    বাবার চরিত্রে নিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ইনার বেশকিছু নাটক, ছবিতে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আছে। হরিহর চরিত্রে ভালোভাবেই মানিয়ে নিবেন। তবে কানু একটু বিরক্তই হয়েছিলেন যখন শুনলেন তেমন কোন মেকআপ ব্যবহার করা হচ্ছে না। আবার বিভূতির লেখা এমন বড় সংলাপ বলতেও তাঁর কিঞ্চিৎ অসন্তোষ ছিল। যাইহোক, পাওয়া যাচ্ছিলো না অপুকে।

    বেশ কিছু স্কুলে অভিযান চালানো হলো, বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। নাহ, কিছুতেই পাওয়া গেলো না অপুর জন্য কোন শিশু অভিনেতা। বিজ্ঞাপন দেখে তো একবার এক কন্যাশিশুকে চুল কেটে অডিশন দিতে নিয়ে আসা হয়েছিল। যদিও সেটা কাজে লাগেনি। অবশেষে অপুকে পাওয়া গেলো, সেটাও বাড়ির কাছেই। একদিন তাঁর স্ত্রী বাড়ির পাশের একটা ছেলেকে তার দাদুর সাথে খেলা করতে দেখলেন। তখনই সত্যজিৎকে দেখান সেই ছেলেকে। অনুমান ভুল হয়নি বিজয়াদেবীর, এভাবেই পাওয়া গেলো অপুকে। ছেলেটার নাম সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়।

    পথের-পাঁচালী-সিনেমার-শুটিং-এ-অপু-1
    পথের পাঁচালী সিনেমার শুটিং এ অপু

    আরও পড়ুনঃ জানা অজানায় পথের পাঁচালী উপন্যাস | অপু ট্রিলজি

    Download

    প্রাথমিক কাজ শুরুর জন্য রইলো দূর্গার অভিনেত্রী। দূর্গার খোঁজ পাওয়া গেলো পরিচিত এক শিক্ষিকার থেকে, তাঁরই ছাত্রী। যোগাযোগ করা হলো সেই বাড়িতে। উমা দাশুগুপ্ত নামের এই মেয়েটি আবার একটু লাজুক প্রকৃতির, একেবারে দূর্গার বিপরীত। সত্যজিৎ উমার কিছু ছবি তুলতে চাইলেন। তখনই একটা ভেংচি দিতে বলেন। যেভাবে নিঃসংকোচে উমা কাজটা করলো তাতে দূর্গা চরিত্র নিয়ে আর কোন সংশয় থাকলো না।

    প্রধান চারটা চরিত্রের অভিনয়শিল্পী ঠিক হয়ে গেছে। কাউকে নিয়ে তেমন সমস্যা হবে না, শুধু শিশু সুবীরকে নিয়েই একটু সংশয়। সংশয় সত্যিই হয়েছিল বটে। সেকথায় পরে আসছি। আগে বাকি কয়েকটা চরিত্রের অভিনয়শিল্পী কীভাবে ঠিক হলো সেটা শেষ করি। প্রতিবেশী চরিত্রদুটোর জন্য থিয়েটারের দুই অভিনেত্রী রেবা দেবী ও অর্পণা দেবীকে ঠিক করা হলো। বাকি থাকলো হরিহরের দুঃসম্পর্কের পিশি ইন্দির ঠাকুরন চরিত্রের।

    রেবা, অর্পণা দেবীই এমন একজনের খোঁজ দিলেন যিনি এই চরিত্রে সহজে মানিয়ে নিবেন। বৃদ্ধ মহিলার নাম চুনীবালা দেবী। ৩০ বছর থিয়েটারে অভিনয় করেছেন, কেউ মনে রাখেনি বলে অভিমান তাঁর। সত্যজিৎ ও তাঁর টিম গেলেন চুনীবালা দেবীর গ্রামে। দেখা হলো চুনীবালার সাথে। সাদা থান, বয়সের ভারে ন্যুব্জ দেহ, গাল বসে গেছে, সাদা চুল ছোট করে ছাঁটা। “দাঁড়াবেন না, বসুন আপনারা, বসুন” বলেই গড়গড় করে নানান কথা বলতে লাগলেন চুনীবালা। সত্যজিৎও কথা না বলে চুপচাপ তাঁকে দেখে যেতে লাগলেন। চেহারায় তো মানিয়ে যাবেন নিঃসন্দেহে, তবে ৮০ বছরের এই বুড়ি কী সংলাপ মনে রাখতে পারবেন? সেই সন্দেহে গুড়েবালি দিয়ে বুড়ি একটা ছড়ার ২০ লাইনেরও বেশি গানের মতো করে শুনিয়ে ফেললেন। ফলে তাঁর গায়কী নিয়েও নতুন একটা ধারণা পাওয়া গেলো। চুনীবালা অবশ্য প্রতিদিনের জন্য ১০টাকা করে চেয়েছিলেন। তবে তাঁকে ২০ টাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ওহ হ্যাঁ, শিশু দূর্গার চরিত্রে অভিনয় করেছে করুণাকন্যা রুঙ্কি বন্দ্যোপাধ্যায়।

    এই ছিল অভিনয়শিল্পীদের যুক্ত হওয়ার সব ঘটনা। একেবারে নতুন অথবা থিয়েটারে কাজ করা, সিনেমায় তেমন অভিজ্ঞতা না থাকারও পরও অভিনয়শিল্পীদের খুব কম দৃশ্যে দুইটার বেশি শট নিতে হয়েছিল। সবাই তাঁদের চরিত্রে মিশে গিয়েছিলেন। তবে স্বয়ং সত্যজিতের মতে অভিনয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে উপরে ছিলেন বুড়ি চুনীবালা দেবী।

    আরও পড়ুনঃ যখন ছোট ছিলাম সত্যজিৎ রায় PDF রিভিউ

    শ্যুটিং শুরু

    “দিদিকে খুঁজতে অপু গ্রাম থেকে বেরিয়ে কাশবনে পৌঁছেছে। একটুপর ঝিকঝিক শব্দ শোনা যায়। এরপর ভাইবোন অবাক দৃষ্টিতে ট্রেন দেখতে থাকে।” এই দৃশ্যটা দিয়েই অপু-দূর্গার প্রথম শ্যুটিং শুরু হয়। যেমনটা আগেই বলেছিলাম, ছোট্ট সুবীরকে নিয়ে কিছুটা সংশয় ছিল সত্যজিতের। প্রথম শটে স্বাভাবিকভাবে না হেঁটে সুবীর এমনভাবে এগুচ্ছিল মনে হচ্ছিল অন্ধকারে পা ফেলছে। একটু পর তার থামার কথা ছিল, সেটাও করলো না। ফলাফল, দামি নেগেটিভ নষ্ট। সাথে সত্যজিৎ এও বুঝলেন একটা শিশুর সামান্য হাটার দৃশ্য বাস্তবিক করা অনেক কঠিন একটা কাজ। পরেরবার তিনি অবশ্য একটা কৌশল খাটান। সহকারীদের তিনজন তিনদিক থেকে সুবীরকে ডাকবে, সুবীর সেই ডাক অনুসরণ করে এগিয়ে যাবে। সাথে কিছু ডাল ফেলা হলো, যেন দিদিকে খুঁজতে গিয়ে অনিশ্চিতভাবে লাফাতে হয়।

    Download

    পরিকল্পনা অনুযায়ী তাই করা হলো। সুনিপুণ দৃশ্যধারণ করতে পেরে সত্যজিৎ চিৎকার করে উঠেন “ইউরেকা!” অপুর পরবর্তী শ্যুটিংগুলোতেও নানান ধরণের কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল।

    পরের সপ্তাহে আবার ওই স্পটে যাওয়া হলো। এবার ট্রেনের দৃশ্য নিতে হবে। কিন্তু গিয়ে দেখেন সেই কাশফুলের সমূদ্রে ঘাস ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। জানা গেলো গরুর ভারি দল কাশফুল খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছে তাঁর মহামূল্যবান সেট। আশাহত হয়ে একবার বাদ দিতেও চেয়েছিলেন এই অংশটা। না সেই কাজ না করে অন্যান্য অংশগুলোতে মন দেন। এক বছর পর শরতে আবার আসা হয় সেই যায়গায়। ট্রেনের দৃশ্যটা নিতে তিনবার সময় ধরে ক্যামেরা নিয়ে থাকতে হয়েছিল। তিনটি ট্রেনকে শুট করে একটি ট্রেন হিসেবে দেখানো হয়েছে। সাথে আগে থেকেই তাঁর সহকারী ট্রেনে থাকতেন। এই মাঠে আসার কিছুক্ষণ আগে ট্রেনে কয়লা দেওয়া হতো। সাদা কাশবনের মধ্য দিয়ে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন যাচ্ছে, অবশেষে ধারণে সফল হলেন।

    আরও পড়ুনঃ একেই বলে শুটিং PDF সত্যজিৎ রায়

    এই এক বছরের মাঝে বোড়াল গ্রামে পুরো সেট রেডি করা হয়ে গেছে। অবশ্য প্রথম যখন গ্রামটিতে যান, একটা অংশ ছোট শহরের মতো হওয়ায় পছন্দ হয়নি সত্যজিতের। পরে আবার যখন বিভিন্ন গাছ-গাছালি, ফাঁকা মাঠ, পুকুর দেখেন এর বাইরে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তা করেননি। হরিহরের যে মাটির বাড়িটা দেখানো হয়েছে পুরোটা সময় মাসিক ৫০ টাকা করে দিতে হয়েছে তাঁদের। একটা ঘর দেখানো হয়নি সিনেমায়, যেটাতে তাঁরা সব জিনিসপত্র রাখতেন।

    তখনও নিশ্চিত কোন প্রযোজক পাওয়া যায়নি। এর ফলে যখন টাকা থাকে কিছুদিন শ্যুট করেন, শেষ হলে বন্ধ থাকে। এভাবেই চলছিল নির্মাণ কাজ, এইজন্য প্রায় আড়াই বছর ধরে শুট করতে হয়েছে পথের পাঁচালী সিনেমাটি। এরমধ্যে দুটো মৃত্যু ভাবিয়ে তুললো তাঁদের। প্রথমটা দূর্গাদের কুকুর ভুলো। গ্রাম থেকেই একটা কুকুর পাওয়া গেছিল যেটা বেশ পোষ মেনেছিল। এই কুকুর দিয়ে কিছু দৃশ্যধারণ হয়। মাস ছয়েক পর অবশিষ্ট কাজের জন্য গিয়ে দেখেন কুকুরটা জীবিত নেই। অবিকল আরেকটা কুকুর পাওয়া গেলো। তবে এটাকে নিয়ে কাজ চালাতে বেশ ধকল পার করতে হয়েছিল। কুকুরের একটা দৃশ্য ধারণ করতে ১০টার বেশি শট নিতে হয়েছিল। যদিও পশ্চিমা সিনেমার তুলনায় কমই বলা যায়।

    মনে আছে, এক ময়রার পিছনে ধাওয়া করতে করতে অপু-দূর্গা যায় মুখুজ্যেদের বাড়ীতে? সেই চিনিবাস ময়রার অভিনেতাও গত হয়েছেন। বাকিটা তার মতো কাছাকাছি দেখতে আরেকজনকে দিয়ে করানো হয়। পথের পাঁচালী একাধিকবার দেখলেও কেউই এই চালাকিটা ধরতে পারেনি।

    Download

    আরও পড়ুনঃ প্রফেসর শঙ্কুর গল্প সমগ্র PDF রিভিউ সত্যজিৎ রায়

    ‘ফিলমের লোক এয়েচে – বল্লম নিয়ে লাফিয়ে পড়ো!’

    পথের পাঁচালী নির্মাণে আড়াই বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল। এর মধ্যে নির্মাণে বেশ কিছু মজার ঘটনা ঘটে গেছে। বোড়াল গ্রামের লোকদের সাথে সত্যজিতের টিমের ভালোই সৌজন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। কিছু সাধারণ চরিত্রের অভিনেতা তো গ্রামবাসীদের মধ্য থেকেই নেওয়া হয়। তবে গ্রামে সুবোধদা নামে এক ৬০-৬৫ বছরের লোক ছিল যে তাঁদের দেখেলেই হুঙ্কার দিয়ে উঠতো- “ফিলমের লোক এয়েচে – বল্লম নিয়ে লাফিয়ে পড়ো!” পরে জানা যায় লোকটার মাথায় ‘ছিট’ আছে। এর সাথে আবার সত্যজিতের সখ্যতা জমে উঠেছিল ভালো।

    যে বাড়িতে শ্যুটিং চলতো তার পাশেই এক ধোপা থাকতো, এই লোকও ছিটগ্রস্থ। হঠাৎ হঠাৎ করে ‘হে বন্ধুগণ’ চিৎকার দিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতা শুরু করতেন। শটের সময় এভাবে চিৎকার দিলে তো সাউন্ডের অবস্থা রফাদফা হয়ে যাবে। ধোপার বাড়ির লোকদের সহযোগীতায় এটা নিয়ে অবশ্য তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়নি।

    তবে বিপদজনক অবস্থায় পড়েছিলেন সাউন্ডরেকর্ডিস্ট ভুপেনবাবু। শ্যুটিং চলাকালীন সাউন্ড ঠিক আসছে নাকি অন্যঘর থেকে হ্যা-না এর মাধ্যমে জানিয়ে দিতেন তিনি। একবার কোন শব্দই পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন সত্যজিৎ ঘরের ভেতরে যেয়ে দেখেন বিরাট এক গোখরা সাপ জানালা থেকে মেঝেতে নামছে। এই দৃশ্য দেখেই ভুপেনবাবু কিছুক্ষণের জন্য কথা হারিয়ে ফেলেছিলেন। স্থানীয় লোকরা অবশ্য সাপটাকে মারতে দেয়নি। অনেকদিন থেকেই নাকি এই বাড়িতে আছে গোখরাটা।

    আরও পড়ুনঃ অপরাজিত উপন্যাস PDF রিভিউ বিভূতিভূষণ

    কিছুদিন বিরতির পর আবার যখন শ্যুটিং শুরু হলো, ততদিনে চুনীবালা দেবীর চুল বড় হয়ে গেছে। চুল কাটার জন্য সেটে কোন কাঁচিও ছিল না। তাই ব্লেড দিয়েই কোনরকমে কাজ সারা হলো। চুনীবালা দেবীর শেষ অভিনয় ছিল ইন্দির ঠাকুরণের মৃত্যুর দৃশ্য। বাঁশের খাটে মাদুর বিছিয়ে চুনীবালাকে শুইয়ে দেওয়া হলো। ভিক্ষে করে আনা চাদরখানাতে মুড়ে দেয়া হলো এবং দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হলো। শবযাত্রা শুরু হলো। পুরো শটটা নিতে ঘণ্টাখানেক লাগতে পারে জানানো হয়েছিলো। শট শেষে খাট মাটিতে নামানো হলো, খুলে দেওয়া হলো দড়ির বাঁধন। একি, চুনীবালা দেবী যে আর নড়ছেন না। ভয় পেয়ে গেছিলেন সবাই। হঠাৎ করে চুনীবালা বলে উঠলেন, “শট হয়ে গেছে? কই আমাকে তো কেউ বলেনি! আমি তাই মরা হয়ে পড়ে আছি।”

    Download
    চুনীবালা দেবীকে শট বুঝিয়ে দিচ্ছেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়

    আরও কিছু কথা

    যেমনটা আগেই বলেছি, শ্যুটিং চলেছিল আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে। এর মধ্যে বহুবার অর্থাভাবে কাজ বন্ধ রাখতে হয়। বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানটাই সত্যজিৎ তখনো কাজ করতেন। তবে শ্যুটিং বন্ধ থাকলেও প্রায়ই গ্রামটা দেখে যেতেন। সেটের অবস্থা কেমন আছে সেটা তো দেখতেনই, গ্রামে নিরিবিলি পরিবেশে একা একা বসে কিছু ভাবতেন। এই ভাবনাগুলো পথের পাঁচালীর নানান অলঙ্কার যুক্ত করেছে। নিরিবিলি গ্রামটা দেখতেন, গ্রামের শব্দগুলো শুনতেন আর নোট করতেন। সকাল শুরু হয় কোন শব্দ দিয়ে, সন্ধ্যা হয় কোনটা দিয়ে, ট্রেনের শব্দ বাড়ি থেকে কেমন শোনাবে সব টুকে রাখতেন। আবহসংগীত নিয়ে দারুণ একটা ধারণা পেয়েছিলেন এভাবে।

    সেতার বাদক রবিসঙ্করকে আগেই সত্যজিৎ রায় চিঠি পাঠিয়েছিলেন এই বিষয়ে। রবিসঙ্কর এলেন কলকাতায় দুইদিনের জন্য। করবেন এই সিনেমার কাজ, অপরদিন কনসার্ট আছে। শেষ কিছু দৃশ্য তখনো শ্যুট হয়নি। রবিবাবুকে অর্ধেক দেখানো সম্ভব হয়েছিল। অনুমান করে তো আবার পুরো কাজ সম্ভব না। সত্যজিৎ তখন ঘটনাগুলোর বর্ণনা দিয়ে একেকটা কম্পোজিশন সর্বচ্চ তিন মিনিট করে রাখতে বললেন। বাকি বাদকদের নিয়ে সন্ধ্যা ছয়টাই কাজ শুরু হলো। পথের পাঁচালী র আবহসঙ্গীত রেকর্ডে ১১ ঘণ্টা লেগেছিল। কিছুদিনের মধ্যে অবশিষ্ট শ্যুটিং, এডিটিং, মিক্সিং সব কাজ শেষ হয়।

    আরও পড়ুনঃ আরণ্যক উপন্যাস PDF রিভিউ – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অবশেষে ১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট কলকাতার ৪টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলো সত্যজিৎ রায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী। এমন হইচইহীন সিনেমা দেখে দর্শকরা অবশ্য প্রথমে একটু অবাকই হয়েছিল। তবে কিছুদিনের মধ্যে দক্ষিণ কলকাতায় একটা উৎসবের মতো সৃষ্টি হয়। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে সিনেমাটি। দেশি-বিদেশি নামকরা সব সমালোকরা ভূয়সী প্রশংসা করে এই অসামন্য সৃষ্টিটির।

    বিবিসির সেরা ১০০ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের তালিকায় একমাত্র ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে ১৫ নাম্বারে আছে পথের পাঁচালী। সুব্রত মিত্র, দুলাল দত্ত, অনিলবাবুসহ এই সিনেমায় যুক্ত প্রত্যেকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলাফল ছিল এটি। মনরো হুইলার, জন হাস্টনসহ অনেকেই এই সিনেমা সফলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সাহায্য করেন। তাঁদের কথা তেমন বলা হয়নি লেখা ছোট করতে।

    পথের পাঁচালী নির্মাণে বহুবার অনেক ধরণের বাধা এসেছে। অনেক সময়ই আশাহত হয়েছেন সত্যজিৎ। তবে দমে যাননি। যার ফলাফল চলচ্চিত্র বিশ্বে পথের পাঁচালী, অনন্য এক সংযুক্তি। বিশ্ব চেনে নতুন একটা নাম, ‘সত্যজিৎ রায়’।

    লিখেছেনঃ Emtiaz Tonmoy

    ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

    Download

    সত্যজিৎ রায় রচনা সমগ্র রিভিউ দেখুন / PDF Download করুন

    Facebook Comments
    Tags:
    x
    error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করুন