আদর্শ হিন্দু হোটেল

আদর্শ হিন্দু হোটেল – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

Redirect Ads

‘পেশা’ শব্দটি কি শুধুই মানুষের তাড়নার সাথে যুক্ত? অবশ্যই নয়। এটি মানুষের স্বপ্ন ছোঁয়ার মাধ্যম, মূল চালিকা শক্তি। কারো কারো জীবনে এই স্বপ্ন গুটি পোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে পাখা মেলে । এমনই এক প্রজাপতির ডানা মেলার উপাখ্যান এই ”আদর্শ হিন্দু হোটেল” । হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন , আজ বলবো হাজারী বামুন ঠাকুরের স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প।

উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে । ভাবা যায় ১৯৪০ সালে ঔপন্যাসিক সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে একজন নিপীড়িত মানুষের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার উপাখ্যান সৃষ্টি করেছেন যা এই ২০২০ সালে এসেও আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায় । এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হাজারী ঠাকুর মূলত বিভূতিভূষণের বাস্তব অভিজ্ঞতার মানুষ , যার বুকের গহীনে লালিত স্বপ্ন আর আকাঙ্খাকেই তিনি উপন্যাসের মূল আখ্যান রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন ।

Download

চলুন সবাই একটু দেখে নিই হাজারী ঠাকুরের স্বপ্নের ছকটা :
হাজারী চক্রবর্তীর হিন্দু-হোটেল
রাণাঘাট
ভদ্রলোকের সস্তায় আহার ও বিশ্রামের স্থান
আসুন ! দেখুন ! পরীক্ষা করুন ! ! !

এ প্রসঙ্গে তার বিস্তৃত ভাবনাগুলো ছিল এমন : কর্তা অর্থাৎ বেচু চক্কত্তির মতো সে-ও তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসে খাবারের টিকিট বিক্রি করবে , রাঁধুনি বামুন এবং ঝি তাকে ‘বাবু’ বলে ডাকবে। প্রতিদিনের রান্নার মাছ-তরকারি সে নিজে বাজারে যেয়ে কিনে আনবে, খদ্দেরদের নিম্ন মানের খাবার খাইয়ে সে ব্যবসা করবে না ।তার হোটেলে খদ্দেরদের বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকবে ।খাও-দাও,বিশ্রাম করো,পান-তামাক খাও,চলে যাও —এসব ভাবনায় শান দিতে দিতেই হাজারী ঠাকুরের বিকেলটা কাটে চূর্ণী নদীর ধারে বসে ।

কিনতু এসবই হলো তার লালিত স্বপ্ন , এই স্বপ্ন সত্যি করার জন্য প্রয়োজন প্রচুর টাকার যা তার সঞ্চয়ে নেই । আজ সাত বছর যাবৎ সে এই বেচু চক্কত্তির হোটেলে রাঁধুনির কাজে নিয়োজিত , অথচ এই সাত বছরে তার মাইনে শুরু থেকে যা ছিল আজও তাই আছে , সাত টাকার গণ্ডি থেকে একচুলও বাড়েনি , উল্টো নানা রকম ষড়যন্ত্রে তার পাওনা টাকা কাটা পড়ে নির্মমভাবে । এই যে বেচু চক্কত্তির হোটেলের উপরি সুনাম , তার পুরাটাই হাজারীর রন্ধন শিল্পের গুণে , একবার তার হাতের রান্না মাংস যে খেয়েছে সে বার বার ফিরে আসে এখানে , নিজের খরচে তারা মাংস কিনে নিয়ে এসে রেঁধে দেয়ার অনুরোধ করে ।

এই উপন্যাসের একমাত্র নিকৃষ্ট নারী চরিত্র হিসেবে আমরা পদ্মঝিকে দেখি,হোটেলের মালিক তার কথায় ওঠে-বসে বিধায় পদ্মঝির দেমাগের শেষ নেই । উপন্যাসের একমাত্র ভিলেন সত্তা হিসেবে সে শতভাগ সফল ।এই পদ্ম ঝি হাজারীকে দুচোখে দেখতে পারে না । দেখতে না পারার কারণ সে সৎ ,মিতভাষী, পরিশ্রমী, বিনয়ী এবং সর্বোপরি ভালো রাঁধুনি ।লোকমুখে তার রান্নার সুখ্যাতি পদ্মঝির মনে জ্বালা ধরায় ।দিন-রাত এক করে পদ্মঝির গঞ্জনা , উঠতে বসতে চোর-ঠকবাজের অপবাদ মাথা পেতে নেয়া ; পাছে প্রতিবাদ করলে এই রাঁধুনির চাকরিটাও হারাতে হয় — এই ভীতি হাজারী ঠাকুরকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরত । কারণ এই চাকরিটা হারালে গ্রামে তার পরিবার যে না খেয়ে মরবে ।আদরের কন্যা টেপির বিয়ে নিয়েও তার চিন্তার শেষ নেই ।তবুও তার শেষ রক্ষা হয়না ,ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে বিনা অপরাধে হাজতবাস তার ভাগ্যেরই পরিহাস ছিল বলা যায়৷

Download

পুরো উপন্যাস জুড়ে হাজারী ঠাকুরের বিনয়ী সত্তা অনেকসময় পাঠককে আহত করেছে, মাঝে মাঝে তাকে মনে হয়েছে প্রচন্ড ব্যক্তিত্বহীন চরিত্র । কিনতু ধীরে ধীরে পাঠক বুঝতে পারবেন সহনশীল মানুষ কিভাবে তার কষ্টের পুরস্কার অর্জন করে ।নিজেকে উজাড় এবং নিঃশেষ করে অন্তরের ভেতরকার দহন বাতি জ্বালিয়ে নিজেকে পুড়িয়ে হাজারী ঠাকুর স্বপ্ন পূরণের শক্তি খুঁজে পায় ।এমন চরিত্রকে বোঝা সহজসাধ্য বিষয় নয় বলেই আমি মনে করি ।

উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য কিছু চরিত্র যাদের কথা না বললেই নয় : অতসী ,রতন ঠাকুর , কুসুম , বংশী ,পাড়া গায়ের কায়স্ত ঘরের সেই অল্পবয়সী সরল বধূ ,নরেন ,যদু বাড়ুয্যে , অতসীর পিতা হরিচরণ বাবু —-এদের উপস্থিতিতে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে প্রাচুর্যময় ।উপন্যাসের পরতে পরতে বিচিত্র চরিত্রের সমারোহে গভীর জীবন-দর্শনের চিরাচরিত প্রকাশ না ঘটলেও এর মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে নিষ্ঠাবান মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সৎ ও আদর্শ পন্থাটা ।

জীবনের তুমুল ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে একদিন হাজারী ঠাকুরের স্বপ্নের ফানুস আকাশে ওড়ে । কিনতু কিভাবে সে ব্যাখ্যায় আমি যাব না,পাঠকের জন্য চমকগুলো উহ্য থাকুক ।তবে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পেছনে রয়েছে চিরাচরিত মমতাময়ী নারী শক্তির অবদান , যাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া পিতৃস্নেহে ভরপুর হাজারীর পক্ষে সম্ভব ছিল না । তারই গ্রামের জমিদারের কন্যা অতসী এবং হাজারীর দূর-সম্পর্কের ভাতিজী অভাবী কুসুম তাদের জমিয়ে রাখা সম্পদের পুরোটাই হাজারী ঠাকুরের হাতে তুলে দেয় এবং হাজারী ঠাকুর তার স্বপ্নের হোটেল খুলতে সক্ষম হয় ।

আসলে এই গল্পটা শুন্য থেকে সফলতা ছিনিয়ে আনা একজন মানুষের,১৯৪০ সালে প্রকাশিত একজন উদ্যোক্তার জীবনগাঁথা । ।গুণীর গুণের প্রকাশ কি কখনও দমিয়ে রাখা যায় ,যায় না ! মোটকথা তার এই উন্নতির কারণ তার সহনশীল মনোভাব, দায়িত্ববোধ ,স্বপ্ন লালনের সাহস ,উদার মন-মানসিকতা এবং সঠিক পরিকল্পনার ছক আঁকা ।হাজারী ঠাকুর এমনই একজন রন্ধন-শিল্পী যে কিনা মাংসের ঝোল দেখেই বলে দিতে পারে লবণ কম হয়েছে কিনা ।একসময় রাঁধুনি হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে দিল্লীর সীমানায় ।সেখানকার নামকরা এক পাঁচ তারকা হোটেলে মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে চাকরির প্রস্তাব পায় সে । কিনতু সে কি যাবে এই রাণাঘাটার আজন্ম নেশা ধরানো মায়াময় তৃপ্তির টান উপেক্ষা করে দিল্লিতে ? জানতে হলে হাতে তুলে নিন মসৃণ গতিতে নির্মিত স্বপ্ন জাগানিয়া এই সার্থক উপন্যাসটি ।

Download

উপন্যাস : আদর্শ হিন্দু হোটেল
ঔপন্যাসিক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ধরন :সামাজিক উপন্যাস

রিভিউ লেখক : প্রিয়াংকা বিশ্বাস
সাবেক শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বইয়ের ফেরিওয়ালায় লিখতে চাইলে এইখানে লেখা জমা দিন

বইয়ের ফেরিওয়ালা থেকে বই ধার করতে সদস্য হোন

Download
Facebook Comments

Similar Posts