ভূগোল ও ভগবান | এ. কে. নাজমুল করিম | ধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ PDF
আমার এক মাস্টার মশাই একবার মহামুস্কিলে পড়েন। তার ভাঙ্গা মোটরখানা সারাতে দিয়েছিলেন ঢাকার এক মোটর মেকানিকের কাছে। ভাঙ্গা মোটরখানাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে ড্রাইভার বলল, বাবু, বিশ্বকর্মার পূজার জন্য আজ কারখানা বন্ধ। মোটরখানার জরুরী দরকার, তাই অধ্যাপক বললেন, কেন, তারা যে মুসলমান মোটর মেকানিক। তারা দোকান বন্ধ রাখবে কেন? ড্রাইভার উত্তর দিল, তা হলে কি হয়, বাবু, তারা বিশ্বকর্মার পূজা না করতে পারে, কিন্তু তাই বলে কাজ-কারবার বন্ধ না রাখলে যে তাদের অমঙ্গল হবে। কি আর করা যায়, বিশ্বকর্মার অনুকম্পায় সেদিন আর মোটরে চড়া হল না। তবে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপকের একটা কথা পরিষ্কার হয়ে গেল। মানুষের আর্থিক ও ভৌগোলিক পরিবেশই মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে রূপ দেয়। তাই মুসলমান মোটর মিকানিকেরও বিশ্বাস যে বিশ্বকর্মাকে দোকানপাট বন্ধ রেখে সমমান না দেখালে তার ব্যবসায়ে ক্ষতি হতে পারে।
অনেকে ধর্মীয় চেতনাকে চিরন্তন বা শাশ্বত কিছু বলে ধারণা করেছেন। তারা ধর্মকে সকল পারিপার্শ্বিকতা ও ভৌগোলিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন। কিন্তু আমরা জানি যে মানুষের ধর্মীয় চেতনা নিতান্ত ব্যবহারিক বুদ্ধি থেকেই এসেছে। প্রাচীন যুগে কৃষিকার্যের সুবিধার জন্য জরা, ব্যাধি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে মুক্তির জন্য ভগবানের দরকার হয়ে পড়ে। এ ব্যবহারিক বুদ্ধির সাথে পারলৌকিক বা ঐশ্বরিক প্রেরণার কোন সম্পর্ক নাই। বৃষ্টি দেবতা, জরা ব্যাধির দেবতা প্রভৃতি বিভিন্ন দেবতাকে পূজা উপচার দিয়ে তোষামোদ করার পালা চলল। এ তোষামোদ করা থেকেই প্রাচীন সমাজে ধর্মের উৎপত্তি হল।
এ ধর্ম বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় বিভিন্ন রূপ পেয়েছে। তাই সমাজ-বিজ্ঞানের ছাত্র ধর্মের কোন চিরন্তন স্বরূপের কল্পনায় অপারগ। মোটর মেকানিক যেমন বিশ্বকর্মার পূজা করে সেরূপ মেক্সিকোর আদিম উপজাতিরা হরিণ দেবতাকেই সবচেয়ে সেরা দেবতা মনে করে, কারণ হরিণ শিকারের উপরই তাদের জীবিকা নির্ভর করে। টিপরাদের ভেতর বাঁশপূজা দেখতে পাই, কারণ তাদের জীবনযাত্রার জন্য বাঁশ অন্যতম উপাদান ও তা প্রচুর পরিমাণে পার্বত্য ত্রিপুরার জঙ্গলে পাওয়া যায়। আবার ভৌগোলিক পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে উপাস্য দেবতারও পরিবর্তন হয়। আর্যরা যখন যাযাবর ছিল তখন তাদের একমাত্র উপজীবিকা ছিল মাঠে পশুচারণ। তাদের দিগন্তবিস্তৃত চারণভূমির উপর আকাশই ছিল প্রকৃতির সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি। তাই তাদের কাছে আকাশদেবতা দিয়ায়ুস (Dyaus) ছিল সবচেয়ে বড় দেবতা। বৃষ্টিদেবতা ইন্দ্র ছিল আকাশ দেবতার পুত্র ও নিতানত ছোট দরের দেবতা।
কিন্তু আর্যরা যখন ভারতে এসে যাযাবর জীবন ছেড়ে কৃষিজীবন আরম্ভ করল তখন কৃষিকার্যের জন্য ইন্দ্রদেবতার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ল। তাই ইন্দ্র হয়ে পড়ল বহু যুদ্ধজয়ী জবরদস্ত স্বর্গরাজ অর্থাৎ সবচেয়ে বড় দেবতা। অপর দিকে আকাশদেবতা তার সব প্রাধান্য হারিয়ে ফেলল। বেচারা বুড়ো বাপ দিয়ায়ুসের কথা আর্যরা ক্রমে ভুলেই গেল।
আমরা যাদের অনুন্নত ও অসভ্য বলে থাকি তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশী বাস্তবজ্ঞানী। তাদের কাছে ভগবানের আর্থিক প্রয়োজনীয়তাটাই বেশী ধরা পড়ে। তাই হটেনটটরা তাদের উপাস্য নূতন চাঁদ দেখলে বলে নমস্কার, এবার তোমার দৌলতে আমাদের বেশী করে মধু পাওয়া চাই। আমাদের গরু যেন বেশী খেয়ে দেয়ে বেশী দুধ দিতে পারে।
আরও পড়ুনঃ প্রশংসার নিন্দা : মানুষ তোষামোদ বা দালালি কেন করে?
স্বর্গ নরক বা ভগবানের ধারণার ভেতর কোন পারমার্থিক কিছু নাই। অতি আদিম যুগের মানুষদের ভেতর ভগবান বা স্বর্গনরকের কোন ধারণা দেখি না। আদিম টাসমানীয় সমাজে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে পাদ্রীরা মহামুস্কিলে পড়েন, টাসমানীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে গিয়ে দেখা গেল যে ঐ ভাষায় ঈশ্বর, পরমার্থ শক্তি, স্বর্গ ইত্যাদি ভাববোধক একটিও শব্দ নাই। অবশেষে পাদ্রীরা টাসমানীয় ব্যক্তি বোধক শব্দ না (না)-এর সঙ্গে ইংরেজী শব্দ জুড়ে দিয়ে খৃষ্ট ধর্মতত্ত্বের God (ঈশ্বর)-না, Heaven (স্বর্গ)-না, প্রভৃতি শব্দ রচনা করতে বাধ্য হলেন।
তাই বিভিন্ন দেশের লোকের স্বর্গনরকের ধারণার উপর যে যথেষ্ট ভৌগোলিক প্রভাব থাকবে তাতে আর বিচিত্র কি! মরুভূমির লোকদের ধারণা স্বর্গ বেশ ঠাণ্ডা জায়গা ও নরক বেশ গরম জায়গা। কিন্তু শীতের দেশ নরওয়ের লোকদের ধারণা ঠিক তার উল্টোটি। সেখানে স্বর্গ খুবই গরম জায়গা ও নরক খুবই ঠাণ্ডা জায়গা।
স্বর্গ ও নরকের অবস্থান নিয়েও মরুভূমি ও শীতের দেশের লোকদের ধারণা বিভিন্ন। মরুভূমির দেশের লোকদের ধারণা স্বর্গ উপরের দিকে ও নরক নীচের দিকে কিন্তু নরওয়ের লোকের ধারণা ঠিক উল্টে। স্বর্গ নীচের দিকে ও নরক উপরের দিকে। এর কারণ এই যে শীতের দেশে উপর থেকে তুষারপাত হয় তাই নরক সেখানে উপরের দিকে। কিন্তু মরুভূমিতে পায়ের নীচে উত্তপ্ত বালি তাই তাদের ধারণা নরক নীচের দিকে।
স্বর্গ কি সব উপভোগ্য ও প্রলোভনীয় বস্তুর দ্বারা সজ্জিত হবে তা নিয়েও বিভিন্ন দেশের লোকের ধারণা বিভিন্ন। খৃষ্টান, হিব্রু ধর্মগুলি মরুভূমির ধর্ম, তাই তারা স্বর্গকে ছায়ায় ঢাকা, ফলমূল ও ঠাণ্ডা জলের প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ মরূদ্যান বলে কল্পনা করেছে। কিন্তু এ ধরণের নিতানত নিরামিষ স্বর্গে এস্কিমোদের কোন ভক্তি নাই। খৃষ্টান পাদ্রীদের সঙ্গে বাদানুবাদে এস্কিমোরা বলছে ।তোমাদের স্বর্গে কোন সীল মাছ নাই। যে স্বর্গে সীল মাছ নাই সে স্বর্গ আমাদের মানাবে না।
আবার দেশ ভেদে শয়তান বা দুষ্টদেবতার ধারণাও বিভিন্ন। নরওয়ের লোকে কুয়াশা ও তুষারকেই শয়তান বা দুষ্টদেবতা বলে কল্পনা করে, কারণ কুয়াশা ও তুষারই তাদের দৈনন্দিন কাজে একমাত্র প্রতিবন্ধক। মিশরীয়দের ধারণা যে টাইফুন নামক অসহ্য উত্তপ্ত বায়ু ঝটিকাই হল দুষ্টদেবতা বা শয়তান। ভারতীয় হিন্দুদের ধারণা যে বৃত্রই হল শয়তান। কারণ বৃত্রই বৃষ্টিপাতে বাধা জন্মায় তাই প্রাচীন ভারতীয়দের কৃষিকাজে অসুবিধা হত। তাই বৃত্রসংহারের প্রয়োজন হল। ব্রেজিলে পায়াগুয়ারা তুফানকেই দুষ্টদেবতা বলে ধারণা করে। কিন্তু এ দুষ্টদেবতার ক্রোধে তারা এতটুকুও বিচলিত না হয়ে মশাল জালিয়ে দুষ্টদেবতাকে মারধর করতে যায়।
আরও পড়ুনঃ অধ্যাপক ডঃ নেহাল করিম স্যারের লাইফ চেঞ্জিং কিছু উপদেশ
আন্দামানীরাও তাদের দেবতার অনাচার অবিচারকে নীরবে হজম করে না। আন্দামান সমুদ্রের মাঝে। তাই সেখানে সবসময়ই বৃষ্টি লেগে আছে ও এ বৃষ্টিপাতের কারণ হল প্রবল উত্তর পূর্ব মৌশুমী বায়ু। এ প্রবল উত্তর পূর্ব মৌশুমী বায়ুর বিলিকু দেবতাকেই যে তারা প্রবল পরাক্রানত মনে করবে তাতে আশ্চর্য কিছু নাই। কিন্তু এ হেন প্রবল পরাক্রানত বিলিকু দেবতা যখন অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত করাতে থাকে তখন আন্দামানীরা তার পরাক্রমে এতটুকুও না ঘাবড়িয়ে তার বিরুদ্ধে বাসুকী দেবীকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে তার গায়ে সাপের কামড় বসিয়ে দিবে বলে ভয় দেখায়।
আন্দামানীরা বৃষ্টিপাত না পছন্দ করলে কি হয়! কৃষিপ্রধান দেশে বৃষ্টি দরকার, তাই বৃষ্টিদেবতাকে সন্তুষ্ট করার প্রথাও নানা দেশে বিভিন্ন। আমাদের দেশের মুসলমানেরা বৃষ্টিপাত না হলে নামাজ পড়ে আল্লার দরবারে ফরিয়াদ জানায়। কিন্তু বুসম্যানেরা অত সব প্রার্থনায় বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে মাঠের উপর অতিকায় জলহস্তী বা হিপোপটেমাস চালিয়ে দিলেই বৃষ্টি দেবতাকে আহ্বান করা হল। অর্থাৎ এর পর ঝুর ঝুর করে বৃষ্টি পড়তে থাকবে। নিগ্রোরা জলে কলসী ছুড়ে দিয়ে ও প্রাচীন আর্যরা সোমরস দিয়ে বৃষ্টিদেবতাকে তোষামোদ করার চেষ্টা করত।
দেবতাদের যে সব পূজার উপচার দিয়ে তোষামোদ করা হয় তাও দেশভেদে যথেষ্ট তফাৎ। শীতের দেশ সাইবেরীয়ার লোকেরা তাদের দেবতা যেন শীতে কষ্ট না পায় সেজন্য দেবতার উদ্দেশ্যে পশমী জামা বা fur উৎসর্গ করে। কিন্তু নিগ্রোদের দেবতাদের গরম থাকবার কোন দরকার নাই, তাই তারা তাদের দেবতাদের উপহার দেয় ভোড্কা। রেড ইণ্ডিয়ানেরা দেয় তামাক। নরখাদক পলিনেশিয়ানদের দেবতারা মাংস উপহার পেলে আনন্দে আত্মহারা।
বিভিন্ন দেশের পাহাড় পর্বত নদী নালাও দেবতার উচ্চাসন পেয়েছে। নীল নদের জলের উত্থান পতন প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে কেমন রহস্যময় ঠেকত তাই তারা নীল নদের পূজা আরম্ভ করে। কৃষিজীবী আর্যদের কাছে গঙ্গাদেবী পরম পবিত্র। সাঁওতালেরা তাদের মায়াং-বরু পাহাড়কে দেবতা বলে ধারণা করে। পেনাইন পর্বত হল কেলটিকদের দেবতা। ভারতের হিমালয় কেবল হিমের আলয় নয়, দেবালয়ও বটে। মহামতি যুধিষ্ঠির তো সে পথেই মহাপ্রস্থান করে একেবারে স্বর্গে আরোহণ করেন।
আরও পড়ুনঃ সরদার ফজলুল করিম : আমাদের কালের বাতিঘর
অনেকে অনুকম্পা দেখিয়ে বলবেন, আহা যাদের কথা বলা হল, তারা যে সব অনুন্নত ও অর্ধসভ্য জাতি। তারা কি করে একেশ্বরবাদের ধারণা করবে? তাই তারা প্রকৃতির পূজাই করে। তাদের মতে একেশ্বরবাদের ধারণা ভগবানের প্রেরিত পুরুষের মারফতে দৈববাণীর ফলেই হয়েছে ও তার উপর কোন ভৌগোলিক প্রভাব নাই। কিন্তু তারা ভুলে যান যে একেশ্বরবাদের মূলেও রয়েছে ভূগোল। উহা পারমার্থিক বা চিরন্তন কিছু নয়।
ভারতবর্ষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ; প্রকৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে প্রাচীন হিন্দুরা বিভিন্ন দেবতার রূপ দিয়েছে। ভারতীয় হিন্দুরা তাই বহু দেবতায় বিশ্বাসী। কিন্তু মরুভূমিতে বৃষ্টি না হওয়ার ফলে প্রকৃতির কোন বৈশিষ্ট্য প্রধান হয়ে নাই। কেবল বালি ধূ ধূ করছে ও সূর্য প্রচণ্ড তাপ ছড়াচ্ছে। মরুভূমিতে সূর্যই হল প্রকৃতির প্রধান ও প্রচণ্ডতম প্রতিনিধি। এ সূর্যদেবতার পূজা থেকেই যে তারা এক প্রবল পরাক্রানত ভগবানে বিশ্বাসী হয়েছে, তাতে আর বিচিত্র কি?
খৃষ্টান বা হিব্রু ধর্মের প্রচলনের আগে এশিরিয়া ও বেবিলোনীয়াতে এ ধরণের একেশ্বরবাদ চালু ছিল। এশিরিয়ানদের নগরদেবতা অসুর, বেবিলোনীয়ানদের দেবতা মারডুক সবই সূর্যদেবতার বিভিন্ন রূপ। যখনই অসুর বা মারডুক সূর্যদেবতার রূপানতর লাভ করেছে, তখনই তারা জোরদার ও সর্বশক্তিমান এক ভগবানের পর্যায়ে উঠে এসেছে। মিশরের ফেরাও আখিনাটন এক সূর্যদেবতার এত ভক্ত হয়ে পড়েন যে তিনি মিশরের অন্যান্য দেবতার উপাসনা বন্ধ করে এক ভগবান অর্থাৎ সূর্যদেবতা Re (রি)-র উপাসনা চালু করেন। কিন্তু মিশরীয়েরা তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার একেশ্বরবাদ ছেড়ে দেয়।
হিব্রুদের এক ভগবানের বিশ্বাসও কোন অলৌকিক কিছু নয়। তারা প্রথমে বহু দেবতাতেই বিশ্বাসী ছিল। তাদের গোষ্ঠীদেবতা জেহোভা ঐ সব বহু দেবতারই একজন। কিন্তু যখন এ গোষ্ঠীদেবতা জেহোভা রূপ বদলিয়ে সূর্যদেবতার রূপ গ্রহণ করল, তখনই বলব যে তারা এক ভগবানে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। বেবিলোনীয়ায় কারাবাসেব সময় (Babylonish captivity) জেহোভার প্রতি বিশ্বাস তাদের আরও বদ্ধমুল হয়। পরবর্তী একেশ্বরবাদী খৃষ্টধর্ম হিব্রুধর্মেরই উন্নত সংস্করণ মাত্র। তাই খৃষ্টান পাদ্রীরা অনুন্নত আদিম অধিবাসীদের ভেতর ধর্মপ্রচার করতে গিয়ে নিজেদের একেশ্বরবাদ সম্পর্কে যে গালভরা কথা বলে ও অনুন্নত সমাজের প্রকৃতিপূজার নিন্দা করে এর মূলে কিছুই নাই। এসন-এর উচ্চধারণাও প্রকৃতিপূজারই রূপানতর মাত্র ও ভৌগোলিক কারণে মরুভূমিতেই তা প্রথম সম্ভব হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ প্রশ্নের শক্তিতে শক্তিমান একজন আরজ আলী মাতুব্বর
ইজরাইলদের প্রেরিত পুরুষেরা প্রচার করে যে তারা তাদের জেহোভা থেকে খোদার খাছ বান্দা (Chosen people) হিসাবে স্বর্গীয় কেতাবগুলি পেয়েছে। কিন্তু আমরা জানি যে ঐ সব কেতাবগুলিতে যে সব সৃষ্টিরহস্য, পরলোকতত্ত্ব বা নীতিধর্মের কথা বলা হয়েছে, তা হামমুরাবীর সনদ, Epic of Flood, Epic of Creation বা Book of the Dead-এর ভিতর পাওয়া যায়। বাইবেলের নুহনবীর জলপ্লাবনের অনুরূপ কাহিনী বহু যুগ আগেই বেবিলোনীয়াতে ঊহমধ সফ ঋলসসন-এ দেখতে পাই। বস্তুত বাইবেল বা অন্য সব সেমেটিক ধর্মপুস্তকে যে সব নীতিবাদ বা সৃষ্টিরহস্যের কেচ্ছাকাহিনী লেখা আছে সে সব অনেক যুগ আগেই বেবিলোনিয়া, এশিরিয়া ও প্রাচীন মিশরে চালু ছিল।
পণ্ডিতেরা বলেন সৃষ্টির প্রথমেই আদিম মানুষ পারমার্থিক ও ঐশ্বরিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এক ভগবানের সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু আমরা দেখেছি আদিম সমাজে পরিবেশ ও আর্থিক প্রয়োজনবুদ্ধিই ধর্মের মূলে। আজকাল যে উন্নত ধরণের ধর্মজ্ঞান দেখতে পাই তা অনেক পরের কথা। বস্তু বা পরিবেশ যেমন ধর্মকে রূপ দেয়, সেরূপ মানুষের দার্শনিক চিনতাও ধর্মকে রূপ দিয়েছে। হিন্দুদের এক পরমব্রহ্মের কল্পনা এরূপ দার্শনিক চিনতাধারারই ফল। তাই বলে মান্ধাতার আমল থেকে আদিম মানুষ সৃষ্টিরহস্য জানবার জন্য ব্যাকুলিত হয়ে এক ও অদ্বিতীয় ভগবানের তত্ত্বকথায় মেতে গেছে এ বলার কোন অর্থ হয় না।
[পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী, ১৯৪৬]
প্রবন্ধটির পিডিএফ ডাউনলোড করুন