পথের পাঁচালী

জানা অজানায় পথের পাঁচালী উপন্যাস | অপু ট্রিলজি

Redirect Ads

বই: পথের পাঁচালী
লেখক: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
(১৮৯৪-১৯৫০)
ধরণ: উপন্যাস
প্রথম প্রকাশ : ১৯২৯ খ্রি:

প্রাক কথা:

বিভূতিভূষণের কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী‘ পড়ে সিনেমাটি দেখতে গেলাম ইউটিউবে৷ পড়ার মজা এবং দেখার মজা আলাদা হলেও উভয় ক্ষেত্রেই ‘পথের পাঁচালী‘ সেরাদের সেরা৷ থুরথুরে বৃদ্ধা ‘ইন্দির ঠাকরুন’ এর চরিত্রে অভিনয়কারী ‘চুনীবালা দেবী’ সম্পর্কে জানতে গিয়ে কিছু অসাধারণ তথ্য পেলাম৷ তারপর অন্যান্য চরিত্র সম্পর্কে, সিনেমাটি তৈরি সম্পর্কে, এর পরিচালক সত্যজিৎ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা হলো৷ এরপর ঘাটাঘাটিতে উপন্যাসটি সম্পর্কেও অনেক কিছু জানলাম৷ গল্পের পেছনের এসব গল্প লিখতে গিয়ে কলেবর অনেক বড় হয়ে গেলো৷ পাঠকের ধৈর্যচ্যুতির ভয়ে লেখাটিকে দুই ভাগে ভাগ করলাম৷ আজকে লিখলাম উপন্যাস সম্পর্কে৷ পরে আরেক পর্বে মুভিটি সম্পর্কে লিখবো ইনশাল্লাহ৷

Download

উপন্যাসটি লিখার প্রেক্ষাপট:

লেখক বিভূতিভূষণ তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্নঘটনাই এ উপন্যাস লেখার পেছনে মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে৷ এ উপন্যাসের ঘটনাবলীর সাথে লেখকের জীবনের অনেক মিল রয়েছে৷ সুতরাং এটিকে একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলা অত্যুক্তি হবে না৷ বিভূতিভূষণের লিখিত আত্মজীবনীমূলক বইয়ের নাম ‘স্মৃতি রেখা’৷ উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী‘ আর বই ‘স্মৃতি রেখা’ উভয়টিতেই শৈশব আর প্রকৃতি স্থান পেয়েছে৷ অনেকে মনে করেন উপন্যাসের অপু লেখক নিজেই৷ তাই ‘স্মৃতি রেখা’ আর ‘পথের পাঁচালী‘ একই মনের দুই প্রকাশ৷ বইটার ছাপা হলে এক বন্ধুকে যখন বিভূতিভূষণ বইটা উপহার দেন তখন ‘অপু’ নামে স্বাক্ষর করেন।

কাহিনীর ধরণ:

এ উপন্যাসের কাহিনী কোন সরল পথে প্রবাহিত হয়নাই৷ এমনকি এর আখ্যান রসে কোন গাল্পিক বিন্যাসও দেখা যায় না৷ এ উপন্যাসের কাহিনী খণ্ড খণ্ড চিত্রের একক সমষ্টি৷ বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ের দুই ভাইবোনের বেড়ে ওঠা নিয়েই বিখ্যাত এই উপন্যাস। অপুর পরিবারের জীবন সংগ্রামের নানান খণ্ডচিত্র আমাদের গ্রামীন সমাজের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন সংগ্রামেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি৷

বিভাজন:

লেখক সমগ্র উপন্যাসটিকে পঁয়ত্রিশটি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন৷ আর এ পঁয়ত্রিশটি অধ্যায়কে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন৷

১ থেকে ৬ অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন – ‘বল্লালী বালাই’৷ রাজা বল্লাল সেন কৌলিন্য প্রথা চালু করেন৷ তার সময়ে নামজাদা কূলীনরা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে বহু বিবাহ করতেন৷ আর সারা বছর এ শ্বশুরবাড়ি হতে সে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ভালোরকম খেতো এবং মোটা দাগে অর্থকড়ি নিতো। অর্থকড়ি নিয়ে জামাইরা এক শ্বশুর বাড়ি থেকে অন্য শ্বশুর বাড়িতে গমন করতো৷ সেখানেও একই কাজ করতো৷ এভাবেই তাদের দিন যেতো৷ আর স্ত্রীরা যার যার বাপের বাড়িতে পড়ে থাকতো৷ মা বাবার মৃত্যুর পর এসর মেয়েদের কপালে দুঃখ আর দুর্দশার অন্ত থাকতো না৷ এই উপন্যাসের এ অংশের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ অপুর পিসি ইন্দির ঠাকরুন এরূপ এক হতাভাগিনী নারী ছিলেন। তাই এ অংশের নামকরণ করা হয় ‘বল্লালী বালাই’৷

Download

৭ থেকে ২৯ অধ্যায় এ ২৩টি অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন – আম আঁটি ভেঁপু‘৷ আমের আঁটি মাটিতে ফেলে রাখলে চারা হয়। এই চারাটা ছিড়ে দুটো বীজপত্র নিয়ে মাঝখানে আমের কচি পাতা রেখে মুখে পুরে ফু দিলে বাশি বা ভেঁপু বাজে। গ্রামের ছেলেরা এভাবে বাজায়। তাই এ অংশের নাম ‘আম আঁটির ভেঁপু’ রাখা হয়েছে। এই পর্বটাই পথের পাচালীর প্রাণ। এ পর্বে অপু দুর্গা দুই ভাই বোনের আম আঁটি ভেঁপু নিয়েই সময় কাটে৷

৩০ থেকে ৩৫ এ ৬টি অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন – ‘অক্রুর সংবাদ’৷ অক্রু নামটি মহাভারত থেকে নেয়া৷ শ্রীকৃষ্ণের এক পিতৃব্যের নাম ‘অক্রু’৷ অক্রু রথ নিয়ে বৃন্দাবন যান এবং যুদ্ধ জয়ের সংকল্পে অক্রু শ্রীকৃষ্ণকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথুরা নিয়ে আসেন৷ এভাবে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনে বাল্যলীলার অবসান হয়৷ শ্রীকৃষ্ণের জীবনের অশ্রুসজল অতিকরুণ বিদায় উপখ্যানটিকে ‘অক্রুর সংবাদ’ নামে অভিহিত করা হয়৷ এউপন্যাসের শেষ ভাগে এসে অপুর নিশ্চিন্দিপুরে বাল্যলীলার অবসান হয় কাশীতে যাওয়া হয় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে৷ তাই শেষাংশটির নামকরণ করা হয় ‘অক্রুর সংবাদ’ নামে৷

উপন্যাসের নামকরণ:

পাঁচালী অর্থ প্যাচানো কথা বা দীর্ঘ বিরক্তিকর কাহিনী৷ এ উপন্যাসে গ্রামীন বাংলার জনপদ তথা পথ ঘাটের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে বলে এর নামকরণ হলো ‘পথের পাঁচালী’৷ তবে এ কাহিনী বিরক্তিকর নয় মোটেই৷ এটি বেশ সুখপাঠ্য বটে৷

আরও পড়ুনঃ পথের পাঁচালীর দিনগুলি

Download

চরিত্র :

এ উপন্যাসে সর্বমোট প্রায় আশিটির বেশি চরিত্র রয়েছে৷ এর মাঝে আমরা পাঁচটি চরিত্রকে মূখ্য চরিত্র বলতে পারি৷ অন্যগুলোকে বলতে পারি গৌণ চরিত্র৷ মূখ্য চরিত্রগুলো হচ্ছে,

১) অপু – দুরন্ত শিশু৷ কিছুটা লাজুক৷ কৌতুহলপ্রবণ ও প্রকৃতিপ্রেমী৷ সে পুরো উপন্যাস জুড়ে শিশু বয়সে থাকে৷ এবং এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এটিই৷
২) দূর্গা – চঞ্চল কিশোরী৷ অপুর বড় বোন৷ এ উপন্যাসের অন্যতম অলংকার চরিত্র৷
৩) হরিহর – অপু ও দুর্গার পিতা৷ সংসারের প্রতি কিছুটা উদাসীন কিছুটা অভাবগ্রস্থ অসহায়৷
৪) সর্বজয়া – অপু ও দুর্গার মাতা৷ দোষে গুণে চমৎকার এক নির্মাণ৷ আদর্শস্থানীয় মা৷
৫) ইন্দির ঠাকরুন – অপু ও দুর্গার দুরসম্পর্কের পিসি৷ সহায় সম্পত্তিহীন পর আশ্রিতা অসহায় বিধবা বৃদ্ধা৷

তিনি উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন ১৯২৫ সালে৷ এটি ১৯২৮ সালে পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়৷ ১৯২৯ সালে বই আকারে প্রথম সংস্করণ প্রকাশের সময় পর্যন্ত দুর্গা চরিত্রটি ছিলো না৷ পরবর্তীতে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার সময় দুর্গা চরিত্রটি যুক্ত করতে গিয়ে লেখক পুরো উপন্যাসটি আবার লিখেন৷ এ সংস্করণটি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে৷ প্রধান পাঁচটি চরিত্রের মধ্যে তিনটি চরিত্র উপন্যাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিয়োগ হয়৷ অপু আর তার মা সর্বজয়া উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে এবং তাদেরকে ঘিরেই কাহিনী এগিয়ে যায়৷

এটি কি শিশুতোষ উপন্যাস?

অনেকেই এ উপন্যাসকে শিশুতোষ উপন্যাস বলে মনে করেন৷ আসলে এটি শিশুতোষ নয়৷ শিশু চরিত্র আর শিশুতোষ এক কথা নয়৷ পুরো উপন্যাসটি অপু নামের একটি শিশুকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ায় এটিকে শিশুতোষ উপন্যাস মনে করা হয়৷ তদুপরি শিশুরাও এটি পড়ে বেশ আনন্দ পাবে এটা নিশ্চিত বলা যায়৷

Download

মূল কাহিনী:

নাহ্ উপন্যাসের মূল কাহিনী বলবো না৷ এ রিভিউ এর আলোচনা পর্যালোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে উপন্যাসের কাহিনী সম্পর্কে আপনারা একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাবেন৷ বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ সৃষ্টি এই উপন্যাসটি আপনার পড়া না থাকলে আপনি অনেক কিছু মিস করেছেন৷ আজই পড়া শুরু করুন৷ আর যদি পূর্বে একবার পড়ে থাকেন তবে পুনরায় পড়লে পুনরায় ভালো লাগবে৷

আরও পড়ুনঃ সত্যজিৎ রায় : বাংলা চলচ্চিত্রের এক মহারাজা

উপন্যাসটি কেন অনন্য?

আমি বলবো এটি আমার কাছে বেশ কিছু কারণে অনন্য মনে হয়েছে এবং বেশ ভালো লেগেছে৷ যেমন –

১) এক দুরন্ত শিশু আর চঞ্চলা চপলা কিশোরীকে নিয়ে এ উপন্যাস৷ শিশু আর কিশোরী কার ভালো লাগে না? শিশু যেমন আদরের স্নেহের কিশোরী তেমন ভালোলাগা ভালোবাসার৷
২) ভাই বোনের চিরন্তন বন্ধনের অনাবিল সৌন্দর্যের অসাধারণ ভাষাচিত্র এই উপন্যাসটি৷
৩) আবহমান বাংলার গ্রাম্য প্রকৃতির নৈসর্গিক চিত্র অসাধারণ ভাষাশৈলিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ লেখক যেন স্নিগ্ধ প্রকৃতির নিঃসঙ্গ উপাসক। গ্রাম বাংলার প্রকৃতি ও জীবন, তার আকাশ বাতাস, রৌদ্র বৃষ্টি, গাছপালা, নদী-মাঠ সবকিছুই তার সত্তার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এখানে যেন শব্দ আর ভাষা নিয়ে খেলা করেছেন লেখক৷
৪) লেখক পাঠকে একেকটা ঘটনার অতীব গভীরে নিয়ে যান কাহিনীর আবহে৷ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বর্ণনার মাধ্যমে প্রতিটি ঘটনার প্রবাহ বা অগ্রগামীতা পাঠকের সম্মুখে আয়নার মতো উপস্থাপন করেছেন৷ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে আমিই অপু, আমিই দুর্গা৷ আমি ভুলে যাই এটি কাল্পনিক৷ মনে হয় বাস্তবতা আমি স্বচক্ষে দেখছি৷
৫) উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে ধনী দরিদ্রের বৈষম্যের কুপ্রভাব৷ বর্ণপ্রথা ও কৌলিণ্যপ্রথার সর্বনাশা ফলাফল উঠে এসেছে এতে৷
৬) নিম্নবিত্তের প্রতি সমাজের, প্রতিবেশীদের, আত্মীয় স্বজনের আনুকূল্যের অভাব, সৌজন্য বঞ্চিত করার ফলাফল তুলে ধরেছেন লেখক৷
৭) উপন্যাসে ফুটে উঠেছে গ্রাম্য সহজ সরল মানুষের জীবনবোধ, যাপিত জীবনের লালিত অব্যক্ত ও অজানা দর্শন৷
৮) গল্পের পরতে পরতে উঠে এসেছে শিশু কিশোরের মনস্তত্ত্ব৷
৯) এ উপন্যাসে পেয়েছি ঠুনকো ও ভঙ্গুর পারিবারিক কলহের চিত্র৷ আবার পেয়েছি পারিবারিক মায়া মমতা ও বন্ধনের চিত্র৷
১০) কোন রসালো প্রেম কাহিনী নয়, কঠিন জীবন সংগ্রামের বাস্তব প্রতিচ্ছবি এ উপন্যাসটি৷

আরও পড়ুনঃ ফেলুদা সমগ্র ১ ২ ৩ PDF Download রিভিউ

লেখক সম্পর্কে:

এ উপন্যাসের লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখ পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলায়৷ জন্মস্থান মুরাতিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে৷ পৈত্রিক নিবাস ছিলো বরাকপুর গ্রামে, এটি তখন বাংলাদেশের যশোর জেলার অধীন ছিলো৷ পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় পেশায় ছিলেন যজমানি ও পুরোহিত৷ পিতামহ তরিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় পেশায় ছিলেন কবিরাজ৷ অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে ১৯১১ সালে লেখক পিতাকে হারান৷ কলেজে পড়ার সময় ১৯১৭ সালে বিয়ে করেন৷ কিন্তু এক বছরের মাথায় স্ত্রী গৌরীদেবীকে হারান৷ অনেক পরে ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিয়ে করেন রমা দেবীকে৷ বিয়ের সাত বৎসর পর একমাত্র পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়৷ লেখকের কর্ম জীবনের অধিকাংশ সময় কাটে স্কুল শিক্ষকতায়৷ তিনি ১ নভেম্বর ১৯৫০ সালে মৃত্যুবরণ করেন৷

Download

লেখকের অমর সৃষ্টি অনেক৷ ইছামতী উপন্যাস তার আরেক বিখ্যাত উপন্যাস৷ এটিও পুরস্কার প্রাপ্ত৷ ছোটদের জন্য যে কয়টা উপন্যাস লিখেছেন এর মধ্যে রহস্য উপন্যাস ‘চাঁদের পাহাড়‘ আজো তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে সমানভাবে৷ লেখক বিশটির মতো গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন৷ তার উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, ছোটদের উপন্যাসের সংখ্যাও কম নয়, ত্রিশের উপর হবে৷

পথের পাঁচালীর খ্যাতি:

১৯২৮ সালে এ উপন্যাসটি প্রথম পত্রিকায় প্রকাশের পরপরই লেখক বিভূতিভূষণ আলোচনায় আসেন৷ এরপর ১৯৩২ সালে এটির পরিমার্জিত আকারে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের পর এর সুনাম আরো বেশি ছড়িয়ে পড়ে৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এর ব্যাপক প্রশংসা করেন৷ লেখকের মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর পরই সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে উপন্যাসটির চিত্রনাট্য হয়৷ এ উপন্যাসের মাধ্যমেই সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র জগতে অভিষেক হয়৷ আর এর মধ্য দিয়ে সত্যজিৎ রায় এবং ‘পথের পাঁচালী’ উভয়ে পৌঁছে যায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে৷ বইটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হতে থাকে৷ লিখিত উপন্যাসটি এবং এর চলচ্চিত্র বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেতে থাকে৷ এতসব সাফল্য লেখক দেখে যেতে পারেননি৷

এর দুর্বল দিক:

১) উপন্যাসের শুরুটা আকর্ষণীয় মনে হয়নি আমার নিকট৷
২) বল্লালী বালাই এবং অক্রুর সংবাদ এ দুটি অংশ না হলেও উপন্যাসটি পরিপূর্ণ হতো৷ এ দুটি কিঞ্চিৎ বাহুল্য মনে হয়েছে৷
৩) কাহিনীর ধারাবাহিকতা নেই উপন্যাসে৷ পুরো উপন্যাসটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার সমষ্টি৷
৪) যে অপুকে নিয়ে মূল উপন্যাস সে অপুর অপরিণত বয়সেই উপন্যাসের সমাপ্তি পাঠক মনে অতৃপ্তি থেকে যায়৷ পূর্ণাঙ্গ ও পরিণত অপুকে আমরা দেখতে পাই না এ উপন্যাসে৷
৫) কাহিনীর শিথিলতায় মাঝে মাঝে পাঠককে গতিহীন করে দেয়৷

আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার

এ উপন্যাসের সিকুয়্যাল:

পুরো ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই এক শিশু অপুকে৷ এখানেই কি গল্পটির সমাপ্তি? নাহ্ মোটেই নয়৷ অপুর গল্পের ধারাবাহিকতা নিয়ে রচিত হয়েছে আরো তিনটি বই৷ যেমন –

১) পথের পাঁচালী – প্রকাশকাল ১৯২৯ সাল৷ এখানে অপুর পূর্ব পুরুষদের কাহিনী রয়েছে সংক্ষেপে৷ এরপর অপুর জন্ম ও শিশুকাল দেখতে পাই আমরা৷
২) অপরাজিত – এটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩২ সালে৷ এ উপন্যাসে অপু শৈশব, কৈশোরোত্তীর্ণ হয়ে যৌবনে পদার্পন করে৷ উপন্যাসের শেষে অপুর বয়স হয় ৩৪ বছর৷ সে বিয়ে করে৷ তার সন্তান হয়৷ সন্তানের নাম কাজল৷
৩) কাজল – এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে৷ কজল মূলত অপুর সন্তানের নাম৷ কাজলের জন্ম অপরাজিত উপন্যাসে৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে কাজল উপন্যাসটি লিখেছেন বিভূতিভূষণের সন্তান তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৪৭-২০১০)৷ পিতার ইচ্ছানুসারে পুত্র এ উপন্যাস লিখেন৷ যদিও পুত্রের তিন বছর বয়সে পিতা বিভূতিভূষণের মৃত্যু হয়৷ পিতা ‘ কাজল ‘ উপন্যাস লেখার প্রবল ইচ্ছার কথা এক সাক্ষাৎকারে বলেন এবং এ উপন্যাসের খুটিনাটি নোট করেন একটি খাতায়৷ সেই খাতা পড়েই পুত্র এ উপন্যাস লেখায় হাত দেন৷ গল্প কি এখানেই শেষ? নাহ্৷ কাজলের পরেও গল্প এগিয়ে যায়৷
৪) তৃতীয় পুরুষ – এটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে৷ এটিও লিখেন বিভূতিভূষণ এর সন্তান তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তৃতীয় পুরুষের ভূমিকায় লেখক তারাদাস বলেন, আমি আমার বয়স পর্যন্ত এনে কাজলের কাহিনীর সমাপ্তি টেনেছি৷ তখন লেখকের বয়স পঞ্চাশ৷ তার মানে উপন্যাসর শেষে কাজলের বয়সও পঞ্চাশ৷

Download

অপু ও বিভূতি, কাজল ও তারাদাস:

বিভূতিভূষণ তার দুটি উপন্যাসে অপুর যে চিত্র তুলে ধরেছেন তার সাথে লেখকের জীবনের অনেক মিল রয়েছে৷ লেখক ইঙ্গিতে স্বীকার করেছেন উপন্যাসগুলো তার জীবনের ছায়া অবলম্বনেই রচিত৷ আর লেখকের পুত্র তারাদাস তার দুটি উপন্যাসে নিজের ছায়া ফেলেছেল অপু পুত্র কাজলের উপর৷ কী এক অসাধারণ ব্যাপার৷ এ চারটি বইয়ে একটি সংকলন একযোগে ‘অপুর সংসার সমগ্র’ নামে প্রকাশিত হয়েছে৷ সেই সমগ্রের ভূমিকাটি লিখেজেন তারাদাস৷

যারা উপন্যাসটি পড়তে চান:

কারো কারো মুখে শুনেছি ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি শুরু করে বিরক্ত হয়ে রেখে দিয়েছেন৷ তাদের নাকি খুব একটা ভালো লাগেনি৷ সাধুভাষা, সনাতন শব্দাবলী, সনাতন লেখনীরীতি ইত্যাদির কারণে উপন্যাসটির শুরুর দিকে কিছুটা কঠিন মনে হতে পারে৷ তবে কেউ যদি উপন্যাসটির মূল কাহিনী সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন এবং এর চরিত্রগুলো সম্পর্কে জেনে নেন তবে এই দুর্বোধ্যতা আর থাকবে না৷ আমার সংগ্রহে যে বইটি আছে এটি ‘অবধূত বইঘর’ থেকে প্রকাশিত৷ এ বইয়ের শুরুতে বদিউর রহমান নামে একজন খুব সুন্দর করে উপন্যাসটির সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ সমালোচনা লিখেছেন৷ সেই সাথে ৭৯ টি চরিত্রের সংক্ষিপ্ত তালিকাও সংযোজন করেছেন শুরুতে৷ এটি পড়ার কারণে উপন্যাস পাঠ আমি বেশ উপভোগ করেছি৷ আপনারাও এ কৌশলটি নিতে পারেন৷ আপনাদের সংগ্রহে যে বইটি আছে বা পিডিএফ যদি ডাউনলোড করেন তবে তাতে এসব ভূমিকা, চরিত্র তালিকা নাও থাকতে পারে৷ তাহলে করনীয় কী? গুগল মামা থাকতে চিন্তা আছে??

অপুর ভূবনে আপনাকে স্বাগতম৷ পরের পর্বে তুলে ধরবো ‘পথের পাঁচালী’ ও এর সিকুয়্যাল নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র সম্পর্কে অসাধারণ কিছু তথ্য৷ সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন, নিরাপদ থাকুন৷

লিখেছেনঃ Mh Fazlul Hoque

ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যান্য রচনা সমূহ PDF + রিভিউ

Download
Facebook Comments

Similar Posts