সংলাপ :
১. বাল্যকালের ভালোবাসায় বুঝি কিছু অভিসম্পাত আছে।
২. স্ত্রীলোকের চিত্ত অতি অসার ; কত দিনে বশে থাকিবে জানিনা।
৩. যে অধম, সেই শত্রুর প্রতিহিংসা করে ; যে উত্তম সে শত্রুকে ক্ষমা করে।
যাহারা বাল্যকালে ভালোবাসিয়াছো, তাহাদের কয় জনের সঙ্গে যৌবনে দেখা সাক্ষাৎ হয়? কয় জন বাঁচিয়া থাকে? কয় জন ভালোবাসার যোগ্য থাকে? বার্ধক্যে বাল্যপ্রণয়ের স্মৃতিমাত্র থাকে, আর সকল বিলুপ্ত হয়। কিন্তু সেই স্মৃতি কত মধুর!
ভাগীরথী নদীর তীরের এরকম একটা মধুর বাল্য প্রণয় নিয়ে শুরু হয় উপন্যাসটি।
প্রতাপ ও শৈবলিনী একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসে। কিন্তু তাদের ভালোবাসা পরিপূর্ণ তা পাবেনা এই শঙ্কায় দুজন নদীতে ডুব দিয়ে আত্মহত্যা করতে যায়। শেষ মূহুর্তে শৈবলিনী চিন্তা করে কেনো আত্মহত্যা করবে?প্রতাপ কে? সে ফিরে আসে কিন্তু প্রতাপ আসেনা সে ঢুব দেয়। কিন্তু চন্দ্রশেখর নামের এক মহান নৌকাচারীর হস্তক্ষেপে তাকে(প্রতাপ) উদ্ধার করাহয়। চন্দ্রশেখরের সাথে শৈবলিনীর বিয়ে হয়।কিন্তু শৈবলিনী চন্দ্রশেখরকে ভালোবাসতে পারেনি। সে মনে মনে প্রতাপকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে এবং তার স্বপ্ন ব্যর্থ হবার জন্য চন্দ্রশেখরকে দায়ী করে। চন্দ্রশেখর সারাদিন তার বই পড়া ও পাণ্ডিত্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে এই সুযোগে সে তার প্রতি অনুরক্ত ইংরেজ লরেন্স ফক্টরের সহায়তা নিয়ে ঘর ত্যাগ করে।
তৎকালীন বাংলার মহান অধিপতি মির কাশেমের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ আসন্ন। কিন্তু বেগম দলনী রাজাকে যুদ্ধে জড়ানোর না জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করে কিন্তু রাজা বেগমের কথা শোনেনা সে অতিমাত্রায় সেনাপতি গুরগণ খাঁ সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে৷ গুরগণ খাঁ দলনী বেগমের ভাই হলেও রাজ্যের ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করে। তার ষড়যন্ত্রে বাধা হয়ে দাড়ানোয় দলনী বেগম ও দাসী কুলসুমকে দরবার থেকে বের করে দেয়।স্বামী রমানন্দের সহায়তায় প্রতাপের মুঙ্গেরের বাড়িতে তারা আশ্রয় পায়।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার
এদিকে শৈবলিনীকে খুঁজতে চন্দ্রশেখর দেশান্তরি হয়।
প্রতাপ তার স্ত্রী রূপসী এর বোন সুন্দরী-র থেকে সব ঘটনা শুনে শৈবলিনীকে খুজতে বেরিয়ে পরে। মুঙ্গেরে গিয়ে লরেন্স ফক্টরের নৌবহরে হামলা করে এবং শৈবলিনীকে উদ্ধার করে নিজ ঘরে নিয়ে যায়। ইংরেজদের বহরে হামলা করায় প্রতাপের বাড়িতে ইংরেজ বাহিনি আক্রমণ করে এবং শৈবলিনী ভেবে দলনী বেগম ও তার দাসী কুলসুমকে সহ প্রতাপ ও রামচন্দ্রকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
শৈবলিনী রাজার কাছে সব বিস্তারিত বলে। রাজা তৎক্ষণাৎ মুর্শিদাবাদ এর সেনাপতি মোহাম্মদ তকির কাছে খবর পাঠায় ইংরেজদের আটক করতে। এবং শৈবলিনী প্রতাপকে বাঁচাতে নিজে পাগল বেশে ইংরেজদের নৌকায় যায়। এবং নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে দুজনে অনেক দূরে চলে যায়।
মোহাম্মদ তকি ইংরেজদের পা চাটা নীতি অবলম্ভন করে এদিকে তারা বেগমের পরিচয় পায় এবং আসু আক্রমণ এর ভয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। কিন্তু কুলসুম বেগমের সাথে না গিয়ে ইংরেজদের সাথে কলিকাতা চলে যায়।
মোহাম্মদ তকি নবাবকে বেগমের নামে বেশ্যাবৃত্তি ও ইংরেজদের উপপত্নি বলে সংবাদ দেয়। নবাব কষ্ট পেয়ে তাকে হত্যার আদেশ দেয়।
প্রতাপ ও শৈবলিনী দুজনে অনেক বছর পর আবার একই সাথে সাতার কাটতে গিয়ে পুরনো কথা মনেপড়ে। কিন্তু শৈবলিনী যেনো তার স্বামীকে ভালোবাসতে পারে সেজন্য তাকে ভোলার জন্য অনুরোধ করে। এটা শোনার পর শৈবলিনী সন্যাসী রূপ ধারণ ও পাপ মুক্ত হবার জন্য জঙ্গল ও পাহাড়ে ঘুরেবেড়ায়। একজন অদৃশ্য সাধু পুরুষের দিকনির্দেশনায় শৈবলিনী সন্যাস ব্রত হন। এবং কিছুদিন এর মধ্যে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তখন দেখা যায় সেই অদৃশ্য সাধু পুরুষ চন্দ্রশেখর নিজে।
বঙ্কিম রচনাবলী প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড PDF Free Download করুন এখান থেকে
চন্দ্রশেখর শৈবলিনীকে নিয়ে নিজ৷ গৃহ বেদগ্রামে প্রত্যাবর্তন করে। কিছুদিন পরে শৈবলিনীর জ্ঞান ফিরে আসে এবং সব বিস্তারিত বলে চন্দ্রশেখর সব ভুলে গিয়ে তাকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখে। শৈবলিনী স্বামীর দাসী হিসেবে জীবন কাটিয়ে দেবার মহান ব্রত গ্রহণ করে।
এদিকে নবাবের হুকুমে মোহাম্মদ তকি তাকে বিষ পান করানোর জন্য আসলেও সে তাকে মুক্তি দিতে চায়।এবং নিজের ভুল স্বীকার করে বলে সে নিজে নবাবের কাছে বলবে যে বেগম ইংরেজদের উপপত্নি বা কুলটা নন। উপপত্নি!! শুনে বেগম ব্যথিত ও তীব্র ঘৃণা অনুভব করেন এবং একজন দাসীর সহায়তায় বিষ কিনিয়ে খেয়ে আত্মহত্যা করেন৷এবং তকিকে বলেন,’তোর মতো কুলাঙ্গারের উচিৎ আমার সাথে বিষপানে আত্মহত্যা করা ‘।
কুলসুম নবাবের কাছে গিয়ে বিস্তারিত বলেন নবাব তখন আফসোস করেন এবং ব্যথিত হন।
ইংরেজদের সাথে তখন যুদ্ধ চলছে যুদ্ধে গুরগণ খাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় তখন বাংলার নবাব প্রায় হারতে বসেছেন।
নবাব লরেন্স ফক্টরকে শাস্তি দিতে সাক্ষী হিসেবে শৈবলিনীকে দরবারে ডাকেন। শৈবলিনী, চন্দ্রশেখর রাজদরবারে যায় তখনি ইংরেজ বাহিনি মুঙ্গেরের দূর্গ আক্রমণ করে। মুহূর্মুহু আক্রমণে পর্যদুস্ত নবাবের সৈন্যরা। তখন প্রতাপের সহায়তায় শৈবলিনী, চন্দ্রশেখর, স্বামী রমানন্দ পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে।শৈবলিনী প্রতাপকে গোপনে বলে এ জীবনে সে যেনো আর কোনদিন তার সামনে না আসে। তার আসাটা হবে তার সুখ ভঙ্গের কারণ।
সবার নিষেধ অমান্য করে প্রতাপ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে একপ্রকারে আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর আগে স্বামী রমানন্দকে বলেন “শৈবলিনী সুখে থাকুক আমি বাঁচিয়া থাকিয়া তাহার সুখের কণ্টক হইবো কেনো? “
মন্তব্য : ব্রিটিশ আধিপত্য বা ইংরেজদের প্রত্যক্ষ শাসনের শুরুর দিকের ঘটনাকে আশ্রয় করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেভাবে রোমান্স ধর্মী উপন্যাস রচনা করেছেন তা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
উপন্যাসে একদিকে বাংলার ইতিহাস অন্যদিকে দারুণ সব রোমান্টিক মুহুর্ত ও ঘটনার সংমিশ্রন লেখকের এই বহুমূখী প্রতিভা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।
উপন্যাসে নারীর প্রেম ও স্বার্থপরতার দিকটি স্পষ্টভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।শৈবলিনী নদীতে ডুব না দেওয়ার মধ্যে যে স্বার্থপরতার দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন একইভাবে প্রেমের টানে সংসারের পিছু টান মায়া ফেলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা না ভেবে পালানোর মাধ্যমে তীব্র ভালোবাসার দিক স্পষ্ট করেছেন৷
১৭৬৫ সাল বা তৎ সমসাময়িক সময়ে একজন নারীর যে রূপটি লেখক দেখিয়েছেন তা হয়তো আজকের একবিংশ শতাব্দীতে একপ্রকার সামাজিক ব্যধি হিসেবে রূপ নিয়েছে।
বইঃ চন্দ্রশেখর [ Download PDF ]
লেখকঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস সমগ্র ডাউনলোড করুন