পাখিদের নিয়ে – আলী ইমাম PDF | বই রিভিউ
পাখিদের নিয়ে
আলী ইমাম
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। এ পাহাড় ও পাহাড় ছুঁয়ে সাপের মতো জড়িয়ে ঝনিয়ামুখী শহরের দিয়ে চলে গিয়েছে এই রাস্তা। আমাদের জীপটা শাঁ শাঁ করে চলছিলো। মেজদা চালাচ্ছেন। আমরা যাচ্ছি ঝনিয়ামুখীতে। ওখানে মেলা হচ্ছে। আজ সন্ধ্যাবেলায় আদিবাসীদের পাহাড়ি নাচ হবার কথা। দু পাশে ঘন জঙ্গল। হঠাৎ করে ছোটন, টুকু বললো। “দেখ ভাইয়া, একটা লোক কি যেন করছে”। ওর কথা শুনে সামনে তাকিয়ে দেখি একটা মাঝ বয়সী লোক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের গাড়িটা থামাবার জন্য হাত তুলে ইশারা করছে। মেঝদা বিরক্তমুখে বললেন। “ধুত্তরি, এ আবার কে?” গাড়িটা থামাতেই সেই লোকটা ছুটে এলো। তালিমারা ময়লা, লম্বা একটা কোট গায়ে। মাথায় পুরনো রংচটা একটা হ্যাট। মুখভরতি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। কিন্তু লোকটার দুচোখ ভীষণ মায়াবী, টলটলে। যেন এখুনি কেঁদে ফেলবে, এমন একটা ভাব।
ছুটে এসে কেমন করুন গলায় বললো, “আপনাদের কাছে স্যার রক্ত বন্ধ করার কোন ঔষধ আছে?” রীতিমত অবাক হবার পালা। মেজদা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন, কি দরকার?”
-স্যার, একটা খরগোশ, মানে একটা খরগোশ খুব আঘাত পেয়েছে। খুব রক্ত পড়ছে ওটার পা থেকে। আমি খরগোশটাকে ওখানে রেখে এসেছি স্যার। ওষুধ লাগাতে পারলে হয়তো বাঁচাতে পারতাম।
আমরা সবাই অবাক হয়ে লোকটার কথা শুনছিলাম। পাগল নয়তো আবার? মেজদা বললেন, “দেখুন, আমাদের কাছে তো ওধরণের কোন ওষুধ নেই।” লোকটা একটু মিইয়ে গিয়ে বললেন, “ও…, তা স্যার আপনাদের বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না। দেখি, কোন ঘাসের রস লাগিয়ে খরগোশটার রক্ত পড়া বন্ধ করতে পারি কি না।” বলে লোকটা ত্রস্তপদে জঙ্গলের ভিতর চলে গেল।
মেজদা আবার জীপ চালাতে লাগলেন। দূরে আবছা কুয়াশার মত চোখে পড়ছে ঝনিয়ামুখী শহর। রেস্ট হাউজে উঠলাম আমরা। দূরে দূরে সরল গাছে সারি। বাতাস এসে গাছে শুকনো পাতা ঝড়ে রেস্ট হাউজের সামনে লাল কাঁকর ছাওয়া এক চিলতে পথটাকে ভোরে রেখেছে।
সবাই মেলা দেখতে চলে গেল। আমি একলা ঝনিয়ামুখী শহর দেখার জন্য বের হলাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি সেই লোকটা বাস থেকে নামছে। হাতে দুটো বড় বড় খাঁচা। নানা রকমের পাখি ভর্তি তাতে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, কোন পাখির ডানা ভাঙ্গা, কোনটার পা দুম্রে গেছে। কালরাতে ভীষণ ঝড় হয়েছিলো। বুঝলাম পাখিগুলোর এমন দশা সেই ঝড়ের জন্যই হয়েছে। কিন্তু এই আজগুবি লোকটা এসব পাখি নিয়ে কি করছে? কৌতূহলী হয়ে তাঁর পিছনে চলা শুরু করলাম। একজন লোক তাকে দেখে চেঁচিয়ে বললো,
-এইযে ঝগড়ু… এসব মরা পাখিগুলো জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে এনেছ নাকি?
ঝগড়ু নামের সেই লোকটা মাথার রংচটা হ্যাটটাকে খুলে বললো,
-মরা পখি মানে? সবগুলো বেঁচে আছে। দেখেছো, ঝড়ের জন্য সারারাত কি কষ্টে ছিলো ওরা। আহা! এ হলুদ পাখিটার একটা ঠ্যাং বুঝি ভেঙ্গেই গেছে।
-তা যাচ্ছ কোথায় এসব নিয়ে?
-ঐযে মংলি বুড়ির কাছে যাচ্ছি। বুড়ি পাহাড়ি লতা ছেঁচে ভারি অদ্ভুত একটা ওষুধ বানাতে পারে। ঐ ওষুধ লাগালেই পাখিগুলো একদম সেরে যাবে। আবার এই পাখিগুলো আকাশে উড়বে।
বলতে বলতে লোকটির চোখদুটো চকচকিয়ে উঠলো। আমার মনে হলো লোকটা আকাশ দেখছ। অপরিচিতার মত নীল আকাশ। সে আকাশে অনেক পাখি ডানায় রোদ মেখে উড়ছে। পাখিদের বুঝি বড্ড ভালোবাসে লোকটা। আমি তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-এই যে ঝগড়ু মিয়া, আপনার খরগোশটার রক্তপড়া বন্ধ হয়েছে তো?
লোকটা অবাক হয়ে বললো,
-তা স্যার আপনি কি করে জানলেন? ও… আপনি বুঝি সেই জীপটায় ছিলেন? সেরেছে স্যার। বেচারার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। জানেন, পশুপাখিদের দুঃখ আমি আবার একেবারেই সহ্য করতে পারিনা। ওরা তো ওদের কোন কষ্টের কথা আমাদের মত বলতে পারেনা।
-আপনার মায়া লাগে?
-লাগবেনা মানে? হাজারবার লাগে স্যার। কিন্তু কি আর বলবো। মানুষের দিলও আজকাল ওদের জন্য গলে না।
আরও পড়ুনঃ হাট্টিমাটিম টিম ছড়াটির লেখক কে? সম্পূর্ণ কবিতার আসল রচয়িতা কে?
কাকের ডানার মত সন্ধ্যে নেমেছে তখন ঝনিয়ামুখীতে। সরল গাছের বুক ছুঁয়ে শ শ করে বাতাস বইছে। আমি ঝগড়ু নামের সেই লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছিলামনা অন্ধকারে। শুধু তাঁর বিষাদভরা কন্ঠ কানে আসছিলো।
-আমি স্যার ছোটবেলা থেকে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। জঙ্গল আমাকে পাগলের মত টানে। আমার কেউ নেই স্যার পৃথিবীতে। শুধু এই পশুপাখিরা রয়েছে। আমি দেখি কোন কোন পাখি কষ্ট পাচ্ছে। ওদের কষ্টে আমার খুব কষ্ট হয়। যখন পাখিরা আকাশে উড়ে বেড়ায় তখন ভারি আনন্দ হয় আমার। যাই স্যার, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
নিরিবিলি রাস্তাটা দিয়ে সামনের দিকে চলে গেল সে। হাতে খাঁচা ভর্তি আহত পাখিদের নিয়ে। সে অন্ধকার অরণ্যে পরে থাকা পাখি দেখতে চায় না। নীল আকাশে ঝকঝকে রোদে উজ্জ্বল আলোর বন্যায় হারিয়ে যাওয়া পাখিদের দেখতে ভালোবাসে।
দিনকয়েক পর খবরের কাগজে পড়লাম। পাহাড়ের ঢল নেমে আসাতে ঝনিয়ামুখী জঙ্গলে পানি জমেছে। অনেক গাছ তলিয়ে গেছে। আমি ঢাকায় বসে যেন দেখতে পেলাম। সেই একহাঁটু পানির ভেতরে ছপ ছপ শব্দতুলে মধ্যবয়সী একটি লোক টলটলে চোখমেলে শতচিহ্ন কোটটা তুলে পাখিদের কোন কষ্ট হচ্ছে কি না গিয়ে দেখছে। আমার মনে হলো লোকটা এখনো রোদের স্বপ্ন দেখে। রোদের মাঝে উড়ে যাওয়া পাখিদের স্বপ্ন দেখে।
বাংলাদেশ – ৭২ থেকে ৭৫ পত্রিকা সংকলন | বাংলাদেশের পুরাতন পত্রিকা সংগ্রহ