কবুতর

কবুতর কিভাবে পত্রবাহকের কাজ করে?

Redirect Ads

প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বে থেকেই যোগাযোগের মাধ্যম চিঠি আদান প্রদানে কবুতরকে বার্তা বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কবুতর কিভাবে বোঝে যে চিঠিটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছে দিতে হবে? চলুন জেনে নেয়া যাক তার উত্তর।

সে অনেককাল আগের কথা, যখন ছিল না কোন আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, ছিল না কোনো স্যাটেলাইট, ইমেইল, ফেইসবুক বা মেসেঞ্জার। সেসময়ই কবুতর বা পায়রার গতিবিধি মানুষের অনুসন্ধানী মনকে নাড়া দিলো। তারা খেয়াল করলো, কবুতর সকালবেলা যেকোনো স্থানে চলে যাক না কেন সারাদিন ঘুরেফিরে বিকালে বা সন্ধ্যায় ঠিকই আাবার নিজের বাসস্থানে ফিরে আসে। এই ব্যাপারটিই মানুষের মনে কৌতূহলের সৃষ্টি করে এবং কিভাবে দৈনন্দিন জীবনে তাকে কাজে লাগানো যায় সেই চিন্তাও মানুষের মাথায় চলে আসে। আর এভাবেই আমরা প্রবেশ করি “Pigeon post” এর যুগে।

Download

প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে পায়রা বা কবুতরের মাধ্যমে চিঠি পাঠানো মোটেই সাধারণ মেইল সার্ভিসের মত না যে একটা কবুতরের পায়ে চিঠি বেধে বলে দিলাম আর বললাম, “যা ব্যাটা, চিঠিটা ঐ ঠিকানায় পৌঁছে দে”। বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ন্যাচারাল। কবুতরের মাধ্যমে চিঠি আদান-প্রদানে কবুতরের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা বিশেষ গুণকে ব্যবহার করা হয়৷ কবুতরের সেই সাধারণ বৈশিষ্ট্যটা হলো তাকে যেখানেই ছেড়ে দেওয়া হোক না কেন সে ঠিক পথ চিনে নিজের বাসস্থানে চলে যেতে পারে। কবুতরের (বিশেষ করে রক প্রজাতির) নিজের বাসস্থানে ফেরার এই সক্ষমতার কারণ হল শক্তিশালী চৌম্বকীয় ধারণার দক্ষতা। তারা দিক নির্ণয়ের জন্য পৃথিবীর চৌম্বকীয়ক্ষেত্র ব্যবহার করে। সুর্যের অবস্থান, শব্দ এবং গন্ধও কবুতরকে দিক নির্ণয়ে সহায়তা করে। মজার বিষয় হল, চৌম্বকীয় ক্ষেত্রগুলির প্রাকৃতিক দিকের কারণে কবুতরেরা পূর্ব-পশ্চিম দিকের থেকে উত্তর-দক্ষিণ দিকে অনেক দূর পর্যন্ত সঠিকভাবে যাতায়াত করতে পারে। তবে আমরা শুধুমাত্র কবুতর বললে ভুল হবে কেননা সব কবুতরের মধ্যেই এই বিশেষ গুণটি ছিলো না। এই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কবুতরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো “রক পিজিওন” এখন পর্যন্ত যার সর্বোচ্ছ “Homing record” হলো ১৮০০ কি.মি.। অর্থাৎ, এই প্রজাতির একটি কবুতর তার বাসস্থান থেকে ১৮০০ কি.মি. দূরে গিয়েও আবার ফিরে এসেছে। তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম কবুতরের মাধ্যমে চিঠি পাঠাতে হলে যাকে চিঠি পাঠাবেন কবুতরটা তারই হতে হবে এবং সেটা আপনাকে সাথে করে নিয়ে যেতে হবে।

ধরুন আমি রাজশাহী গিয়ে সেই শহরের অবস্থা আমার ঢাকার বন্ধুকে জানাবো৷ তাহলে আমাকে ঢাকার সেই বন্ধুর কবুতরটা সাথে করে নিয়ে যেতে হবে৷ সেখানে গিয়ে রাজশাহী শহরের অবস্থা লিখে কবুতরের পায়ে থাকা হোল্ডারে চিঠিটি গুজে দিয়ে অথবা কবুতরের সাথে চিঠিটি বেঁধে কবুতরটিকে ছেড়ে দিবো। তাহলে কবুতরটা এমনিতেই তার বিশেষ গুণ চৌম্বকীয়ক্ষেত্র ব্যবহার করে আমার বন্ধুর কাছে (কবুতরের নিজের বাসায়) চলে যাবে৷ আর এ দিকে আমার বন্ধুটি অপেক্ষায় থাকবে ঐ কবুতরটি এসেছে কি না৷ যখন দেখবে ঐ কবুতরটি এসেছে তখন চিঠিটি বের করবে৷ এই হল কবুতরের মাধ্যমে বার্তা পাঠানোর প্রক্রিয়া৷

কবুতরের এই ঘরে ফেরার ব্যাপারটি নিয়ে অতীতে এবং বর্তমানে অনেক গবেষণা হয়েছে যেখানে দেখা গেছে জীববিজ্ঞানের সাথে সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্সেরও রয়েছে সমান অবদান। সাম্প্রতিক সময়ের কবুতরের এই বিশেষগুণটি নিয়ে একটি গবেষণা অনেক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। চলুন সেটি সম্পর্কেই আলোচনা করা যাক—

CYRPTOCHROMES
গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন পায়রার চোখের রেটিনাতে মানুষের চোখের মতোই দুই ধরনের কোষ থাকে। যথা-রডকোষ ও কোণকোষ। দন্ডাকার রডকোষগুলোর মধ্যে থাকে একপ্রকার বিশেষ প্রোটিন যাকে বলা হয় “Cryptochromes (ক্রিপ্টোক্রোম)”। এই প্রোটিনগুলো “Blue light বা নীল আলো” র উপস্থিতিতে উত্তেজিত হয়ে যেতে পারে। তাই, এদেরকে বলা হয় “Light Activated Switch”.

Download

এই প্রোটিন আবার তিন ধরনের হয়। যথা-
Cry1
Cry2
Cry4
তবে Cry1 এবং Cry2 এই ব্যাপারটিতে কোনো ভূমিকা রাখে না। কেবল Cry4 ই পথ চিনতে সহায়তা করে।
চলুন একটু কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকে ঘুরে আশা যাক। আমরা জানি, পরমানুতে প্রতিটি ইলেকট্রন নিজ অক্ষের চারপাশে ঘুরে যাকে আমরা “স্পিন (Spin)” বলি। এই ইলেকট্রনের স্পিন চৌম্বকক্ষেত্রের (Magnetic Field) উপর নির্ভর করে।

যদি চৌম্বকক্ষেত্রের দিক বদল করা হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে ইলেকট্রনের স্পিনও বদলে যাবে। তাহলে এবার, একবার পৃথিবীর কথা ভাবুন। পৃথিবী হলো একটা বিশাল চৌম্বকক্ষেত্র।

তবে, এই বিশাল চৌম্বকক্ষেত্রের সব জায়গায় চৌম্বকক্ষেত্রের মান সমান হয় না কিছুটা তারতম্য হয়। এই পার্থক্যের ব্যাপারটির মাধ্যমেই পায়রা তার গন্তব্যস্থল চিনে নিতে পারে।
কিভাবে?
সেই আগের বিশেষ প্রোটিন বা Cryptochrome (Cry4) এর গঠনে দেখা যায়, এতে দুটি ফ্রি-রেডিকেল থাকে যাতে অযুগ্ম ইলেকট্রন (Unpaired Electron) থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে চৌম্বকক্ষেত্রের মানের তারতম্যের কারণে ঐ ইলেকট্রনগুলোর স্পিনেও তারতম্য দেখা যায়। কবুতরেরা যখন তার গতিপথ পরিবর্তন করে তখন ঐ ইলেকট্রনগুলোর স্পিনের তারতম্যের কারনে মস্তিষ্কে বিভিন্ন রকমের রাসায়নিক সংকেত প্রেরণ করে (অপটিক স্নায়ুর মাধ্যমে)। এই রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমেই পায়রা তার গতিপথ সম্পর্কে পূর্ণধারণা নেয়। পায়রার চোখে চৌম্বকক্ষেত্র কিছুটা নিচের মতো দৃশ্যমান হয় –

এই চৌম্বকক্ষেত্র দেখার ব্যাপারটিকে বলা হয় “Magnetoreception”।
কবুতর তার নিজ বাসস্থান থেকে অন্য কোনো স্থানে গেলে যে পথে যায় সে পথে যাওয়ার সময় চৌম্বকক্ষেত্রের মানের তারতম্যের কারনে যে ধরনের রাসায়নিক সংকেত পায় তা মনে রাখে। আবার তার বাসস্থানে ফিরে আসার সময় ঐ একই ধরনের রাসায়নিক সংকেত প্রদানকারী পথে আসতে থাকে। আর তার সাথে নিয়ে আসে আমার আপনার গুরুত্বপূর্ণ সব চিঠিপত্র।

Download

বইয়ের ফেরিওয়ালা থেকে বই ধার করতে সদস্য হোন

Facebook Comments