বইঃ সেই সময়
লেখকঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
টাইম ট্রাভেল এর কাজটা বই সবচেয়ে ভালো করে, বইয়ের মাধ্যমে অনায়াসে হারিয়ে যাওয়া যায় অতীতে, যতবার ইচ্ছে ততবার, এই যেমন আমি সুনীলের লেখা সেই সময় বইয়ের মধ্য দিয়ে পৌছে গিয়েছিলাম সেই ১৮৪০ সালে। “সেই সময়” বই টি মূলত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টাইম ট্রিলজি সিরিজ এর প্রথম বই। তারপর প্রথম আলো, পূর্ব পশ্চিম।
“সেই সময়” বইটিতে লেখক নিদিষ্ট একটা সময় কে তুলে ধরেছে। আর সেই সময় টা হলো তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার ১৮৪০-১৮৭০ এর মধ্যবর্তী সময়টা দারুণ ভাবে তুলে ধরেছে। লেখক যে একজন দক্ষ এবং আটঘাট বেধে নেমেছিল লিখতে, তা তার প্রতি লাইনে লাইনে বুঝিয়ে দিয়েছে।
গল্পে যদিও নায়ক হিসাবে নবীনকুমার নামে এক পুরুষ কে পাবেন, কিন্তু লেখক তাকে নায়ক হিসাবে স্বীকার করে নি! কেননা এ গল্পের নায়ক হলো -‘সময়’ !!
‘সেই সময়’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা একটি উচ্চাকাঙ্খী উপন্যাস। একটি দুরন্ত সময়ের জীবন্ত চলচ্চিত্র ‘সেই সময়’। একদিকে অনাচার, ভণ্ডামি ও লম্পটে রবরবা অন্য দিকে দেশ ও সমাজ সম্পর্কে নবচেতনার উন্মেষ (মানে ভারতবর্ষে রেনেসাঁস এর শুরু)। একদিকে সাহেবিয়ান অন্ধ অনুকরণ অন্য দিকে প্রাচীন গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রয়াস। একদিকে বিধবা বিবাহ ও নারী শিক্ষার জন্য আন্দোলন অন্য দিকে পায়রা উড়ানো ও গনিকা মনোরঞ্জন এর জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার বিলাসিতা। এইসব নানা ঘটনার আর্বতে গ্রাম সমষ্টির মতো আস্তো আস্তো জেগে উঠা কলকাতা শহর।
লেখকের রচিত সময়কে রক্তে-মাংসে জীবিত করার নিমিত্তে একটি প্রতীক চরিত্র গ্রহণ করেছেন তিনি। যার নাম হচ্ছে নবীনকুমার তথা সেই সময়ের প্রতীক। নবীনকুমার রূপে (কালিপ্রসন্ন সিংহ) যিনি মহাভারতের মত বিখ্যাত এক গ্রন্থ প্রথম অনুবাদ করেছিলেন। সেই সাথে ‘হুতুম প্যাঁচার নক্সা’ এর লেখক। একদিকে তিনি ছিলেন মেধায়, বুদ্ধিতে, উদারতায় অনন্য। অন্যদিকে, তার চঞ্চল, ছেলেমানুষী মন, গোয়ার্তমির দোষ। এ যেন অন্যরকম এক মানুষ। যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত
নারী শিক্ষা, বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ, বিধবাবিবাহ এসব এর প্রত্যাবর্তন এর মূলে যিনি ছিলেন তিনি হচ্ছেন সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনাকালীন বিদ্যাসাগর উপাধি পাওয়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর মত একজন সিংহ পুরুষ। ইতিহাস বদলে ফেলার জন্য তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। আমি এর আগে বিদ্যাসাগরকে ভালোভাবে জানতামই না। কিন্তু এই বইটি পড়ার সুবাদে তাঁকে যেন আরো ভালোভাবে চিনেছি। সমাজকে বদলে দেওয়ার জন্য, অসহায় নারীদের জন্য তিনি কি’না করেছেন! কত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে তিনি এগিয়েছিলেন, সরকারের অনুমোদনের জন্য কত মানুষের দ্বারেদ্বারে ঘুরেছিলেন তিনি। কত মহান কত বিশাল মনের মানুষ ছিলেন তিনি! বইটা যতই পড়ছিলাম ততই তিনি যেন আমার মনের উচ্চ আসন গেড়ে বসেছেন। তাঁর প্রতি আমার আরো অনেক বেশি শ্রদ্ধা এবং সম্মান বেড়ে গিয়েছে।
একইসাথে দেখা মিলে ছিলো বাংলা সাহিত্যের আরেক মহান কবি বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মাইকেল এম এস ডাট(মাইকেল মধুসূদন দত্ত) এর সাথে। তাঁর হাত দিয়েই রচিত হইয়েছিলো মেঘনাদ বদ নামক মহাকাব্য।
যিনি বাংলাকে এক সময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন। বাংলা ভাষার প্রতি ছিলো তীব্র বিরাগ। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রচন্ড জেদি এবং ঔদ্ধত্তে বলিয়ান এক মহাপুরুষ। প্রচুর সুরাপান, আড্ডা, বেহিসেবী, উচ্চ বিলাসী মানুষ হয়েও তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র। মাত্র তিন বছরেই তিনি বাংলার প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদা পায়।
ডাক বিভাগের সামান্য একজন কর্মচারী দীনবন্ধু মিত্র মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাটকে মুগ্ধ হয়ে তার নাটক মুখস্থ করে ফেলেন খেয়াল বশেই। এবং মধুসূদন দত্তের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি নীল চাষিদের উপর নীলকরদের নানা অত্যাচার- অবিচার এর কাহিনীকে কেন্দ্র করে লিখে ফেলেন ‘ নীল দর্পণ ‘। দীনবন্ধুর শ্রেষ্ঠ নাটক নীলদর্পণ (১৮৬০)। ইংরেজ নীলকররা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কীভাবে বাংলার কৃষকদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল, তার মর্মন্তুদ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এই নাটকে। সেকালের সমাজজীবনে এই নাটকটি গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। নীলচাষ বন্ধে নীলদর্পণের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সমাজসচেতনতা দীনবন্ধু মিত্রের নাটকের বিশিষ্টতা।
আরো ছিলেন দেশপ্রেমিক হরিশ মুখুর্জ্যের মত এক সৃষ্টিশীল মানুষ, যিনি সবসময় সুরাপান, নারীর নেশায় মত্ত থাকলেও দেশের প্রতি ছিলো নিখাঁদ ভালোবাসা।
সেইসাথে দেখা মিলেছিলো রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধানাথ সিকদার (এভারেস্টের উচ্চতার আবিষ্কারক), ডেবিট হেয়ার (হেয়ার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, প্যাঁরিচাঁদ মিত্র (বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরে দুলাল’ এর রচয়িতা), রানী রাসমনি, মঙ্গল পান্ডে, অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ সহ আরো অনেকে।
আমাকে আরো মুগ্ধ করেছিলো গঙ্গানারায়ণ এর মত একজন শান্তশিষ্ট মাটির মানুষ। যিনি একসময় নীল চাষিদের হয়ে নীলকরদের সাথে লড়াই করে জেল পর্যন্ত খাটতে হয়েছিলো। একই সাথে আরো মুগ্ধ করেছিলো এবং দুঃখ দিয়েছিলো তার বাল্যকালের বন্ধু বিন্দুবাসিনীর প্রতি গভীর ভালোবাসার মর্মান্তিক বেদনার্ত কাহিনী।
শেষদিকে আরো সান্নিধ্য পেয়েছিলাম বঙ্কিমচন্দ্রের মত একজন বিখ্যাত মানুষের। যিনি এসেছিলেন তাঁর কপালকুণ্ডলা নিয়ে। সদ্যোজাত জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথের সাথেও কিছুটা দেখা মিললো নবীনকুমারের নেমতন্নের মধ্য দিয়ে।
শুধু কি বিখ্যাত মানুষের দেখাই কি পেয়েছিলাম? সুনীলের কলমের খোঁচায় উঠে এসেছিলো সমাজের ডানপিঠে থাকা মানুষদের কথাও। বাদ যায়নি বেশ্যালয়ের নটিদের জীবনের অমোঘ সত্য কাহিনী ও। কমলা, হীরে বুলবুল, সুবালা সহ আরো কত নটিদের কথা লেখক তুলে ধরেছিলেন খুব সুনিপুণ ভাবে। তুলে ধরেছেন কিভাবে ভদ্রপল্লী থেকে এসে এরা নটিদের খাতায় নাম লেখায়। কমলা ছিলো নাচে বিখ্যাত, আর হীরে বুলবুল গানে। নটিদের কখনো ঘর সংসার সন্তানাদি থাকতে নেই। অথচ হীরে বুলবুলের কোল জুড়ে এলো চন্দ্রনাথ! কিন্তু কে তার বাবা?
হীরে বুলবুলের বড় সাধ চন্দ্রনাথকে সে পড়াশোনা করাবে। কিন্তু পোড়া সমাজ কি মেনে নিবে এই চন্দ্রনাথকে?
কি ছিলোনা এই বইতে? একসাথে এতসব বিখ্যাত মানুষদের সাথে পরিচয় এবং নানারকম সব ঐতিহাসিক ঘটনা, সেইসময়কার মানুষের জীবনমান, সমাজের পরিবর্তন, পরিবর্ধন থেকে আলোর পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা সহ জেনেছি আরো অনেক অনেক কিছু। উঠে এসেছিলো সমাজের উঁচু-নিচু রাজা থেকে শুরু করে ভিক্ষুক পর্যন্ত সব স্তরের মানুষের জীবনমান কাহিনী।
বাংলা সাহিত্য নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেছিলেন, তাঁরা সমাজকে বদলে দেওয়ার নিমিত্তে যে যাই লিখেছেন তাই যেন সোনা ফলেছিলো। একেকজন যেন একেকটা রত্ন ছিলেন।
এটা নিঃসন্দেহে একটা মাস্টারপিস বই। এই বই যুগে যুগে একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে।
এই বই যারা পড়েনি আমি মনে করি তাদের অনেক কিছু জানা বাকি রয়ে গেছে। কেননা আমার নিজেরই মনে হচ্ছে এতদিন আমার অনেক কিছুই জানা ছিলোনা। একজন সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে এই বইটি সবার পড়া উচিত। এটা অবশ্যই পাঠ্য একটা বই।
(একটা ব্যাপারে অনেকের প্যাঁচ লাগে, সেটা পরিষ্কার করে দেই। ট্রিলোজিটা শুরু হয় সেই সময় দিয়ে, এরপর প্রথম আলো আর সবার শেষে পূর্ব-পশ্চিম। সিরিয়াল মেইনটেইন করে পড়াটা ভালো। তাহলে সময় অনুযায়ী ঘটনাগুলো বুঝতে খুব সুবিধা হয়। )
লিখেছেনঃ সন্ধ্যা কণিকা এবং অনিক দাস পার্থ
বইঃ সেই সময় [ Download PDF ]
লেখকঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর টাইম ট্রিলজি বা ত্রয়ী