বইঃ ছবির দেশে কবিতার দেশে
লেখকঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
হুমায়ূন আহমেদ America র নিশ্চিয়তা, নিশ্চিত জীবিকা, আরামের উপকরণ সব পেছনে ফেলে উল্টো স্রোতে সাঁতার কেটে দেশে ফিরে এসেছিলেন দেশের প্রতি তাীব্র ভালোবাসা নিয়ে, ব্যাঙের ডাক, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ, জ্যোৎস্না রাতের রহস্যময় খেলা দেখতে। সুনীলের উপলব্ধিও এক। তাই তো সুনীল নিজের কাছে নিজেই জিজ্ঞাসা করেছে-
“এ জগতের কাছে আমি কি চাই? নিশচয়ই বেঁচে থাকার আনন্দ। তা হলে কিসে আমার সর্বাধিক আনন্দ?”
বাংলায় লেখার জন্যে বাংলার ভাষভাষীদের মধ্যে ফিরে আসার তাড়নায় তিনিও সব প্রলোভন ছেড়ে ফিরে এসেছিলেন দেশে ।
এবার বইটির মূল কাহিনীবিন্দুতে যাই, বলতেই হবে এই বইয়ের প্রধান অংশ জুড়ে রয়েছে ফরাসি দেশে ভ্রমণ কাহিনী ও স্মৃতিচারণ ও মার্গারিট ম্যাথিউ। লেখক দেশের বাইরে প্রথম যে বিদেশের মাটিতে পা রাখেন সেটা ছিল ফরাসি দেশ। ভ্রমন কাহিনী পড়ে ও globe, map সামনে রেখে লেখকের ততোদিনে অনেক দেশই ঘোরা হয়ে গেছে অবশ্য ।
ফ্রান্সে যাওয়ার প্রথম সুযোগ লেখকের হল Iowa university র ইংরিজির সাহিত্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পল এঙ্গেল আমন্ত্রণে ইন্টারন্যাশনাল একটি রাইটিং প্রোগ্রাম থেকে।
অনেক অস্বাভাবিক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাবলীকে পেরিয়ে লেখক রওনা দিলো সূদুর আমেরিকার উদ্দেশ্যে। যাত্রা পথে উল্লেখ যোগ্য ঘটনা হলো করাচিতে বিমান থামলে বাংলা অক্ষরে নাম লেখা দেখে লেখকের শিহরন। যা পড়ে আমিও হয়েছি শিহরিত। যাত্রাবিরতিতে প্লেনটি থামে প্যারিসে, সেই প্রথম প্যারিস এ পা লেখকের এবং লেখকের ভাষায় ‘আমাদের চোখে তখন ফ্রান্স ছিলো স্বর্গের সমতুল্য’ কিন্তু মাত্র চার ঘন্টা ট্রানজিট লাউঞ্জে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। লেখকের প্রথম কিছু পরিচ্ছদ এর ঘটনা “অর্ধেক জীবন” বইতেও পাওয়া যায়।
এরপর university তে বিচিত্র এক যোগাযোগ র মাধ্যমে পরিচয় মার্গারিট ম্যাথিউ নামে এক শিল্প সাহিত্য পাগল ফরাসি যুবতীর সাথে ও পরে দুজনের মধ্যে জন্ম নেয় হৃদ্যতা। দুজনেই কবিতা ভালোবাসে। ‘যে কবিতাকে ভালোবাসে সে যেন অসাধারণ প্রকৃতির মানুষ হন।’ যেখানেই দুজন যেত মার্গারিট অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরতো সুনীলের সামনে। ফরাসি কবি ও শিল্পীদের সম্পর্কে এমনভাবে সব কথা বলতো, যা সুনীল কোথাও পড়েননি। আবৃতি করতো ফরাসি শব্দের ঝঙকার তুলে একেকটা কবিতা । দর্শন কাব্য সাহিত্য শিল্পকলা সব কিছু নিয়ে চলতো আলোচনা সমালোচনা।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত
আমেরিকাতে প্রায় বছর খানেক কাটিয়ে লেখক এলেন প্যারিসে, মার্গারিট তখন মার অসুস্হতার কারনে সেখানে। তারপর সুনীলকে নিয়ে মার্গারিট বের হয় পুরো ফ্রান্সের শহরকে আবিষ্কার করবার জন্য। আর্টের দর্শন ও ইতিহাস নিয়ে ব্যাখ্যা করে শোনায় সুনীলকে। বলে impressionist আর expressionist দের ছবির মধ্যে পার্থক্য ।
এরপর এলো বিদায়ের পালা। দুজন পৃথিবীর দুই প্রান্তে র উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়লো। বছর খানেক পর কানে এলো সেই গভীর মর্মবেদনামূলক ঘটনা মার্গারিটকে ঘিরে। যেই মার্গারিটকে লেখক একসময় কোনো কিছুর বিনিময়েই হারাতে রাজি ছিলেন না সেই হারিয়ে গেল কোন অজানায়। আসলে কি মার্গারিট হারিয়ে গেছে? কখনই না। বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মার্গারিট ছায়া হয়ে মিশে আছে, আছে লেখকের প্রতিবার ফ্রান্স ভ্রমনের সাথে আর আছে আমরা যারা লেখকের সাথে এই ভ্রমন কাহিনীর অংশ হয়ে ছিলাম তাদের সাথে। মার্গারিট কখনই হারাবে না।
তারপরও লেখক কয়েক বারই গেছেন ফ্রান্সে ।কখনো কাজের সুবাদে, বন্ধুদের সাথে কিংবা সস্ত্রীক, নিছক বেড়াতে-লোভ সামলাতে না পেরে ইউরোপের যে দেশেই যেতেন না কেন টপ করে একবার হলেও ফরাসি দেশকে ছুঁয়ে আসতেন।
বইটির প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদের শুরুতে ফ্রান্সের বিখ্যাত কয়েকজন লেখকের কবিতার অনুবাদ আছে যেগুলো খুবই সাবলীল, সতেজ ও সুপাঠ্য।
ভ্রমন কাহিনী তখনই সুপাঠ্য যখন দেখার দৃশ্যের পেছনের ছোট ছোট এক একটি ইতিহাস বর্ণনা থাকে। এই গল্পের মতো করে বলা বর্ননাই বইটিকে জীবন্ত করে তুলেছে। বইটিতে ফ্রান্সের শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের যেভাবে বর্ণনা করেছেন মনে হবে ফ্রান্স লেখকের দ্বিতীয় জন্মস্থান এবং ফ্রান্সের শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মধ্যে লেখকের অবাধ বিচরন ।
লেখক ফ্রান্সে এসে বারবার মার্গারিটকে ভুলে থাকার চেষ্টা করলেও বারবার মার্গারিটকে খুঁজে বেরিয়েছেন।
ফ্রান্স ভ্রমণ আমার হয়েছে তবে তা বুড়ি ছোয়ার মতই । যে মোনলিসার ছবি মার্গারিট সুনীলকে প্রথমে দেখতেই দেয় নি সেই ছবি দেখা দিয়েই শুরু হয়েছিলো আমার প্যারিস ভ্রমন এবং এরপর শুধু tourist spot. কিন্তু লেখক যে ভ্রমন এর সাথে সাথে হাজারো গল্প শোনালেন আমাদের, শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস এমনকি সেইসব শিল্পী-সাহিত্যিকদেরও জানা অজানা অনেক গল্প, বাকি রয়ে গেছে তার অধিকাংশই দেখা । তবে এরপর কখনো যদি সুযোগ হয় আবার যাবার তখন বইটি হাতে করে নিয়ে যাব আর লেখক এবং মার্গারেট এর সাথে সাথে ঘুরে বেড়াবো।
লিখেছেনঃ Shifat Mehreen Kabir
বইঃ ছবির দেশে কবিতার দেশে [ Download PDF ]
লেখকঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর অন্যান্য বইসমূহ