বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি উজ্জ্বল কিন্তু আলোচিত নন এমন লেখকদের নাম করতে গেলে সবার আগে নাম আসবে আহমদ ছফার। স্পষ্টবাদী কলমের সাথে তার বড় প্রতিভা ছিল দার্শনিকতার দিক থেকে। চট্টগ্রামের চন্দনাইশে জন্ম নেয়া এই গুণী লেখকের ‘গাভী বিত্তান্ত‘, ‘যদ্যপি আমার গুরু‘, ‘ওঙ্কার’ কিংবা ‘সূর্য তুমি সাথী’ বাংলা সাহিত্যের বড় একটি স্থান দখল করে থাকলেও আমার ব্যক্তিগত মতামত অনুযায়ী আহমদ ছফার লেখনীর প্রকৃত পরিচয় তার লেখা প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বইতে। পুরো বইতে অনেকগুলো প্রবন্ধ থাকলেও আমি কেবল প্রথমটি পড়েই থমকে যেতে বাধ্য হয়েছি।
এই প্রবন্ধ লেখার জন্য আহমদ ছফা কখনো আবুল ফজলকে (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে শিক্ষা উপদেষ্টা) ধন্যবাদ না দিলেও আপনি দিয়ে দিতে পারেন। তীব্র নাস্তিক এই শিক্ষাবিদের সাথে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা অবস্থায় আহমদ ছফার দেখা হয় কোন এক সকালে। আবুল ফজল সাহেবের মাথায় টুপি, গন্তব্য সীরাত মাহফিলে। যদিও লেখক বলেছিলেন আবুল ফজল কেবলই এই প্রবন্ধের উপলক্ষ্য, কিন্তু সেটি আসলেই কতটা উপলক্ষ এবং কতটা কারণ তা বইয়ের প্রথমে থাকা ‘উত্তর ভূমিকা’তে পরিষ্কার হয়ে যায়। আবুল ফজলের সাথে এমন দেখা হবার পর সেদিন রাতেই অস্থিরতার শেষ পর্যায়ে থেকে আহমদ ছফা লিখে ফেলেন দেশ কাঁপিয়ে ফেলা প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমান।’
আরও পড়ুনঃ অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী বই PDF আহমদ ছফা
পুরো প্রবন্ধকে যদি বিভক্ত করা যায়, প্রথমেই আসবে পুঁথি লিখন এবং বাঙালি মুসলমান। হ্যাঁ, একথা সত্য একসময়কার প্রচলিত পুঁথির সবটাই ছিল কাল্পনিক এবং অতিমাত্রায় নাটকীয়। সবচেয়ে বড় কথা, কাহিনীচিত্র ছিল একপেশে। আমীর হামযা, হযরত আলীর পুত্র মোহাম্মাদ হানীফাকে নিয়ে একের পর এক মনগড়া কাহিনী নিয়েই একেকটি পুঁথি শেষ করেছেন লেখকগণ। আর এক্ষেত্রে আহমদ ছফা রীতিমতো সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে বেশ বড় কিছু যুক্তি দিলেও হালকা দু চারটি কথা বলা চলে।
এদেশে ইসলামের আগমন ঘটার আগে বেশ দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব। মূলত পুঁথি লেখক সম্প্রদায় পুরোটাই এসেছে সেইদিক থেকেই। এদেশের স্থানীয় যেসব অধিবাসী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন তারাই পরবর্তীতে পুঁথি লিখে ইসলামের মাহাত্ম্য নতুনভাবে আরো কিছু মানুষের কাছে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তাদের কাছে পুঁথি লেখার পর্যাপ্ত রসদ কই? সেই প্রশ্নের উত্তরটা মহাভারত সহ প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ। ইসলামের বিভিন্ন সাহাবির বীরত্ব আর মহাভারতের বর্ণনা একাকার হয়ে কিভাবে বাংলা সাহিত্যে পুঁথি নতুন একটি দিক পেলো সেই প্রসঙ্গে আহমদ ছফার চেয়ে ভাল ব্যাখ্যা বোধকরি আজ পর্যন্ত কেউই দিতে পারেননি।
আরও পড়ুনঃ নিহত নক্ষত্র PDF আহমদ ছফা
পরের কিছু অংশে ভাষাগত সমস্যা উল্লেখ করলেও প্রবন্ধের ৩য় অংশটি আরো একবার আপনাকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করবে। সৈয়দ আমীর আলী এবং মুসলিম সমাজ। লর্ড ক্লাইভ তার লেখায় বর্ণনা করেছিলেন, পলাশীর প্রান্তরে সিরাজ-উদ-দৌলাকে বন্দী করে নিয়ে যাবার পথে যত উৎসুক স্থানীয় ছিলেন তারা ন্যূনতম প্রতিরোধ দেখালেও হয়ত ইংরেজরা পরাজয় বরণ করতেন। এই কথাটি আসলেও সত্য। খুব বেশি না, ইংরেজ শাসনামলেই ঢাকার নবাব পরিবারে কিংবা শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ব্যক্তিগত ভাবে উর্দু কিংবা ফার্সি ভাষাকে মুখের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে স্থানীয় জনগণের সাথে যেমন শিক্ষিত মুসলিম সমাজের একটা বাঁধা পড়ে যার, একই বাঁধা দেখা যায় নব্য প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ শাসকদের সাথেও। আহমদ ছফা তার লেখার এই অংশে একটি বহুল প্রচলিত বিতর্কের খুব সূক্ষ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ইংরেজ আমলে সত্যিই কি বাংলার মুসলমান সমাজ অধঃপতিত ছিল?’ উত্তরটা যদি আপনি ইতিহাসের মুখস্ত বিদ্যা থেকে হ্যাঁ বলে জেনে থাকেন, তবে হয়ত ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটি আপনার একবার পড়া দরকার।
আর সবশেষ দুটি অনুচ্ছেদে আপনার জন্য থাকছে বাংলাদেশে মুসলমান সমাজের আন্দোলন সংগ্রাম এবং সেই আন্দোলনে ক্রমশ সংখ্যালঘু হয়ে পড়া হিন্দুসমাজের প্রভাব। এই দুটি অনুচ্ছেদ পুরো প্রবন্ধের সবচেয়ে জটিল অংশ বলে আমার কাছে অন্তত মনে হয়েছে। পড়বার সময় তাই পাঠকের মানসিক স্থিরতা খুব বেশি প্রয়োজন।লেখা শেষ করব এই প্রবন্ধেরই একটি লাইন দিয়ে, ‘বাঙালি মুসলমানদের মন যে এখনো আদিম অবস্থায়, তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হবার জন্যও নয়।’তাহলে কেন? উত্তরটা পুরো প্রবন্ধে বারবার আপনি পাবেন।
লিখেছেনঃ জুবায়ের আহমেদ
বইঃ বাঙালি মুসলমানের মন [ Download PDF ]
লেখকঃ আহমদ ছফা
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
আহমদ ছফা রচনাসমগ্র PDF Download করুন