Skip to content
Home » জলপাইহাটি – জীবনানন্দ দাশ

জলপাইহাটি – জীবনানন্দ দাশ

    জলপাইহাটি-জীবনানন্দ দাশ
    Redirect Ads

    জলপাইহাটি” নামটা পড়ার সাথে সাথেই যেন মনের সাথে প্রকৃতির একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পৃক্ততা তৈরি হয়। দৃষ্টির সীমানায় ভেসে আসে শিলং, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, সিমলা এর মনভোলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। উপন্যাসের নামকরণ যদিও ঔপন্যাসিক নিজে স্থির করে দিতে পারেননি কারণ এগুলো সবই ছিল তার বাক্সবন্দী পাণ্ডুলিপি। উপন্যাস শুরুর সাথে সাথেই বর্ণিল কিছু চরিত্রের সাথে যেন নিজেও প্রবেশ করলাম শহুরে কোলকাতা এবং জলপাইহাটি গ্রামে।

    এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিশীথ সেন পরিবার-পরিজন নিয়ে জলপাইহাটি গ্রামে বাস করেন। পেশায় তিনি একটি বেসরকারি কলেজের স্বল্প বেতনের ইংরেজির অধ্যাপক। তার স্ত্রী সুমনা রোগাক্রান্ত। নিয়তির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নিশীথ অন্ধকার গ্রাম থেকে শহরে এসে ক্রমশ উপরে উঠতে থাকা ক্যাপিটালিস্ট বাল্যবন্ধু জিতেনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিনতু মফস্বলের গণ্ডির বাইরে এসে কোলকাতার শহুরে জীবনকে খোলা চোখে দেখে সমাজের তথা রাষ্ট্রের ফাঁকিগুলো তার বুকে শেলের মতো বিঁধে। পুরো উপন্যাস জুড়েই এই অসঙ্গতিগুলো দাঁড়িয়ে আছে অটল-অবিচল।

    Download

    বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের দুর্দশার চিত্রের দেখা মেলে উপন্যাসের ১৮ পৃষ্ঠায় — “কিনতু কী করবে নিশীথ?— দেশের ভিতর মাস্টারির চিতে জ্বলছে আজ দিকে দিকে. মাস্টারদের কোন বন্ধু নেই আজ আর. ছেলেরা গ্রাহ্য করেনা মাস্টারদের: খুব সম্ভব তারা কম মাইনে পায় বলে। —-একজন ওস্তাদ,বাবুর্চি বা মোটর ড্রাইভার যে টাকা পায়, ইউনিভারসিটির একজন লেকচারার যদি চেয়ে কম পায়, তাহলে সাধারণ স্কুল-কলেজের মাস্টাররা কী পায়, কী খায়, সেদিকে কি নজর পড়বে না মার্ক্সিস্ট বা কংগ্রেসি বিপ্লবীদের?”

    আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত

    ভাগ্যের বিড়ম্বনায় কোলকাতায় আসার পূর্বে কলেজে ছুটির দরখাস্ত পেশ করার সময় নিশীথ প্রিন্সিপালকে বলেছিলো: দেড়শ টাকা মাইনের এই চাকরিতে পোষাচ্ছে না তার, অন্তত দুশো পঁচিশ-আড়াইশো না করে দিলে কী করে চালাবে সে? শুনে উপর মহলের উত্তর ছিল-“আপনার যদি কাজ করার ইচ্ছে না থাকে করবেন না– কলেজের কাজ ফলারের হাঁড়ি নয়, এখানে টাকাকড়ির কথা নেই। নিশীথ বলেছিলো – “বাইশ বছর তো হলো সেসব; হয়রান হয়ে পড়েছি। এক মাসের ছুটি নিচ্ছি। দরখাস্ত লিখে দিলাম। কালই– যদি সম্ভব হয় আজ রাতের গাড়িতেই কোলকাতা যাব।”

    হরিলালবাবুরা বললে, ” চাইলেই কী ছুটি পাওয়া যায়? কী গ্রাউন্ডে ছুটি নিচ্ছেন আপনি? আপনার তো কোন অসুখ বিসুখ নেই , আপনার শরীর তো সুস্থ I”

    Download

    এমতবস্থায় এই সামান্য বেতনে দেশভাগের অস্থির মুহূর্তে সংসারের ঘানি টানতে টানতে হাঁপিয়ে উঠেছিল নিশীথ। অন্ধকারাচ্ছন্ন চলার পথে একটু আলোর দিশা পাবার লোভেই তার জিতেনের কাছে আসা। কিনতু বাস্তবতার চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। কোলকাতা নিজস্ব সমস্যায় জর্জরিত, সেই সাথে যুক্ত হয়েছে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা শরণার্থী সমস্যা। আবাসন সংকট এবং ভাড়া দুটোই বেড়ে যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মসংস্থানের সামঞ্জস্য ছিলনা। উপন্যাসের শুরুতেই একটি প্রতীকী লাইনে দৃষ্টি আটকে যায়- “যত মফস্বলের মানুষ কোলকাতায় এসে আজকাল নিরিবিলি খোঁজে — ”

    আরও পড়ুনঃ রূপসী বাংলা জীবনানন্দ দাশ PDF রিভিউ

    অভাবের তাড়নায় নিশীথ জিতেনের বাড়িতে চৌর্য-বৃত্তির পথে ধাবিত হয়েও যুক্তিবাদী মন ও বিবেকের বশে নিজের লোভকে সংবরন করে। এ প্রসঙ্গে তার ভাবনা ছিল এমন – “কী হবে এসব টাকা নিয়ে? এসব টাকা দিয়ে কী করবে সে? কোলকাতার বাংলাদেশের বেকার মাস্টার গরীব মাস্টার অধ্যাপকদের জন্য দানছত্র খুলবে? কিনতু এ তো শিশির বিন্দু,সমুদ্রের প্রয়োজন! কোটি কোটি টাকার দরকার এদেশের শিক্ষাকে সম্মান ও শক্তি দিতে হলে, যারা শিক্ষা দেবে প্রাণশক্তি ও মর্যাদায় তাদের স্বাধীন ও সরস সফল করে তুলতে হলে” পৃষ্ঠা -১৯ “জলপাইহাটি” উপন্যাসের যত গভীরে প্রবেশ করছি ততই যেন দেশভাগ নিয়ে লেখা একটি মহা-কাব্যিক উপন্যাসের স্বাদ পাচ্ছি। কখনো ব্যাপকভাবে, কখনো স্বল্প পরিসরে আবার কখনো অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ঔপন্যাসিক ৪৭ – এর দাঙ্গাকে তুলে ধরেছেন। কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি —

    জিতেন তার শাশুড়ির চরিত্রের মহৎ দিক নিশীথের কাছে তুলে ধরে এভাবে- “ওরা আজকাল কোলকাতায় আছে, পার্ক সার্কাসে থাকে। বড় দাঙ্গাটার সময়েও এখানেই ছিল। হেঁটে বেরিয়েছে , হামলা দেখেছে; পুলিশের ট্রাকে ছুটে, রেডক্রসের গাড়িতে চড়ে দিনরাত একঠাঁই করে দিয়েছে। ঐ ওদের রকম। মানুষকে মানুষ খুন করেছে, ম্যানহোল থেকে আধকাটা মানুষ টেনে বের করে হাসপাতালে দৌড়ানো তাকে বাঁচিয়ে তুলবার জন্য, মার্টিন মুখুজ্জে এই তো করেছে দাঙ্গার সময়।”

    Download

    আরও পড়ুনঃ জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী লাবণ্য দাশ এর লেখা বই “মানুষ জীবনানন্দ”

    আবার বন্ধুপত্নী নমিতা এবং নিশীথ এর কথোপকথন ছিল এমন —

    — লেকপাড়ায় দুজন মুসলমান আর্দালি রেখেছে দেখছি জিতেন। কোথাকার মুসলমান!

    — পাঞ্জাবের।

    Download

    — বিপদে পড়বে না তো?

    — না, এখন আর কিচ্ছু হবে না।

    — ওদের নিজেদের মনে কোন ভয় ডর নেই ?

    — কিচ্ছু না।

    নিশীথের যক্ষারোগে আক্রান্ত কন্যা ভানুকে বাঁচাতে আগ্রহী ডাক্তার সুবল। কথা প্রসঙ্গে তিনি নিশীথকে জানান দাঙ্গার সময় সে একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলো। একটি মুসলিম পরিবারের মেয়েদের হিম্মতে তিনি রক্ষা পেয়েছেন। এভাবেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাঝে অনেক অসাম্প্রদায়িক চিত্রও আমরা খুঁজে পাই।

    আরও পড়ুনঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনচরিত

    Download

    পরিশেষে বলতে চাই “জলপাইহাটি”উপন্যাসটি প্রৌঢ় নিশীথের জাগতিক ও সাংসারিক বেদনার্ত উপাখ্যান। মূলত সমগ্র উপন্যাস জুড়ে আত্মমগ্ন এই মানুষটি ছুটে বেড়িয়েছেন অনিশ্চয়তার পথে। কিনতু কিভাবে সেটা জানতে হলে পাঠককে হাতে নিতে হবে “জলপাইহাটি”। মধ্যবিত্ত জীবনের সংকট – টানাপড়েন যেখানে জমাট বাঁধা মেঘের মতো স্থির হয়ে আছে।

    ৪৭ এর প্রেক্ষাপটে জীবনের সংকটময় যে চিত্র জীবনানন্দ দাশ তাঁর কলমের শক্তিতে রূপায়িত করেছেন তা পাঠক চিত্তকে প্রবলভাবে কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম। উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর চিন্তা এবং মননশীলতার বিবর্তন দেখিয়েছেন। আমার দৃষ্টিতে মহা-কাব্যিক ব্যঞ্জনায় রচিত এই কালোত্তীর্ণ উপন্যাসটি সবাইকে পড়ে দেখার আমন্ত্রণ রইলো।

    বুক রিভিউ- জলপাইহাটি  
    ঔপন্যাসিক- জীবনানন্দ দাশ  
    প্রকাশনীর নাম- ঐতিহ্য  
    মুদ্রিত মূল্য- ৩৬০ টাকা 
    রিভিউ করেছেন: প্রিয়াংকা বিশ্বাস
    বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  

    জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস জলপাইহাটি বইটির pdf download করতে এখানে ক্লিক করুন

    Facebook Comments
    x
    error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করুন