বইঃ কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী
লেখকঃ হুমায়ুন আজাদ
প্রকাশনীঃ আগামী প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৪০ টাকা
শতবর্ষ পুরনো রবীন্দ্রনাথের ‘ইচ্ছাপূরণ‘ নামক ছোটগল্পে আমরা দেখি পিতা সুবল যখন পুত্র সুশীলকে ব্যাকরণ পড়ার ব্যাপারে তাগাদা দিচ্ছেন, সুশীল তখন মিথ্যে করে বলছে যে তার বই হারিয়ে গেছে। হ্যা, বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে এমন ভীতিই কাজ করে থাকে সেই শতাব্দীপ্রাচীন সুশীল থেকে শুরু করে আজকের কিশোর-তরুণদের মধ্যেও। সেই কিশোর-তরুণদের, “জ্ঞান যাদের কাছে এক রকম আবেগ ও সৌন্দর্য”, তাদেরকেই টার্গেট অডিয়েন্স হিসেবে বিবেচনা করে প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী প্রয়াত ডঃ হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন চমৎকার একটি বই, যার নাম “কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী”। বাংলা ভাষার মতো আপাতদৃষ্টিতে গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে এমন প্রাঞ্জল ভাষায় যে বই লেখা যায় তা সম্ভবত এই বই প্রকাশের আগে কেউ ভাবতেও পারেনি।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার
বইটিতে সর্বমোট ২৩টি প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে যেখানে বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বিকাশ ও ইতিহাস নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করা হয়েছে। সেই সাথে আলোচনা করা হয়েছে বাংলা ব্যাকরণের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন ধ্বনি, শব্দের প্রকারভেদ, বচন, পুরুষ, ক্রিয়া প্রভৃতি নিয়ে যা স্বতন্ত্র অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এই বিষয়গুলো ব্যাকরণের পাঠ্যপুস্তকেও অন্তর্ভূক্ত থাকে কিন্তু তবু এই বইটি অন্য বইগুলো থেকে ব্যতিক্রম। এমনকি বিভিন্ন ভর্তি ও চাকরির পরীক্ষার রেফারেন্স বই হওয়ার পরও বইটির আবেদন অনন্য কারণ ভাষা ও ব্যাকরণের এইসব খটোমটো বিষয়গুলোকে ডঃ আজাদ লিখেছেন গল্পোচ্ছলে।
পরিবারের নানী-দাদীরা বাচ্চাদের যে আবেগ নিয়ে গল্প শোনায়, ডঃ আজাদ আমাদের বাংলা ভাষার গল্প শুনিয়েছেন সেই একই আবেগ বুকে নিয়ে। কী চমৎকার তাঁর গদ্য লেখার ভঙ্গি! ‘কালিন্দীর কূলে বাঁশি বাজে’ প্রবন্ধে রাধার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি যখন লেখেন –
“সে তীনভুবনজনমোহিনী। শিরীষকুসুমককোঁআলী। অদ্ভুত কনকপুতলী। রাধা এক অদ্ভুত-আগে কখনো দেখা যায় নি এমন-সোনার প্রতিমা। সে-রাধার কান্নার সুরে বাঁধা প’ড়ে আছে মধ্যযুগের প্রথম দিকের বাঙলা ভাষা।”
তখন এই বর্ণনা পড়তে পড়তে আমরা মধ্যযুগের বাংলা সম্পর্কে ধারণা তো পাই-ই, আবার একই সাথে রাধার চোখের জলের কথা স্মরণ করে বুকে মোচর দিয়ে ওঠে আমাদের।
আরও পড়ুনঃ লাল নীল দীপাবলি PDF রিভিউ | হুমায়ুন আজাদ
শুধু দুর্দান্ত গদ্যশৈলীই নয়; লেখক বইয়ে পর্যাপ্ত টীকা, উদাহরণ ও একাডেমিক গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্তের সমাবেশ ঘটাতেও কার্পণ্য করেননি যার প্রত্যেকটি তথ্যই বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যাকরণের আলোচনায় মনি-মাণিক্য। গল্প করতে করতে লেখক কোনোভাবেই “ফ্যাক্ট” থেকে বিচ্যুত হননি যে কারণে বইটি একাডেমিশিয়ানদের মধ্যেও সমাদৃত। যেমন ‘ভিন্ন ভাষার শব্দ’ প্রবন্ধে ডঃ আজাদ আরবি, ফারসি, পর্তুগিজ ভাষা থেকে আগত শব্দের গুরুত্বপূর্ণ তালিকা সংযোজন করেছেন।
কিংবা ‘আমি তুমি সে’ প্রবন্ধে বাংলা সর্বনামের স্বরূপ বিশ্লেষন করতে গিয়ে সর্বনামের বর্তমান রূপ তো বটেই, এদের রূপ বদলের যাত্রাকে পাঠকের সামনে স্পষ্ট করে তুলতে উদাহরণ টেনেছেন চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকেও। “কতো নদী সরোবর” এর প্রত্যেকটি প্রবন্ধকে সমৃদ্ধ করেছে ঋদ্ধ ভাষাবিজ্ঞানীর ক্ষুরধার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, আর এদের সুখপাঠ্য করে তুলেছে কালির আঁচড়ে এক সাধারণ বাঙালির বাংলার প্রতি প্রবল মমত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ।
অধ্যাপক আজাদ তাঁর বইয়ে সর্বনাম, পুরুষের মতো তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর সাথে আবার যোগ করেছেন কিছু ‘সিলেবাসবহির্ভূত’ কিন্তু মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও। যেমন – বাংলা ভাষার পদ্যের রাজত্বে গদ্যের আবির্ভাব, কতিপয় বাঙালির বাংলাবিদ্বেষ, কিংবা বাংলার প্রতি লেখকের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কিন্তু একান্ত আকুলতা। ‘বাঙলা ভাষার ভূগোল’ প্রবন্ধটি এই বইয়ে এক অনন্য সংযোজন যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা সম্বন্ধে উদাহরণসমেত আলোচনা করা হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি পিডিএফ রিভিউ গোলাম মুরশিদ
বইটির দুর্বল দিক বলতে তেমন কিছু চোখে পড়েনি। যে উদ্দেশ্যে বইটি লেখা হয়েছে অর্থ্যাৎ কিশোর-তরুণদের কাছে বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যাকরণপাঠ আনন্দদায়ক করে তোলা সেটা সফল হয়েছে বলেই ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
হুমায়ূন আজাদকে নিয়ে বিভিন্ন সংবেদনশীল কারণে পাঠকমহলে নানাবিধ বিতর্ক আছে। কিন্তু “কতো নদী সরোবর” পাঠের প্রয়োজনীয়তা কোনো পাঠক অস্বীকার করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
লিখেছেনঃ Sadia Humaira
বইঃ কতো নদী সরোবর [ Download PDF ]
লেখকঃ হুমায়ুন আজাদ
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
হুমায়ুন আজাদের লেখা অন্যান্য বই সমূহ পিডিএফ ডাউনলোড করুন