গল্পঃ ফটিকচাঁদ
লেখকঃ সত্যজিৎ রায়
‘ছু উ উ উ উ উ!
ছু মন্তর যন্তর ফন্তর
হর বিমারি দূর করন্তর
ছু উ উ উ উ উ!’
এভাবেই প্রতি রোববারে, শহিদ মিনারের ধারে এক ফালি ঘাসের উপর, চকরা বকরা আসনে বসে সাতবার বাঁশি বাজায় আর হাঁক দেয় হারুনদা। হারুনদা মানে হারুন অর রশিদ, ‘বাগদাদের খলিফা – জাগলিং এর বাদশা!’ পিতলের বল, লাট্টু-লেত্তি, রঙ্গিন পালক লাগানো বাঁশের কঞ্চি দিয়ে চোখ ধাঁধানো ভোজবাজির খেলা দেখায়।
হারুনদার সাথে তার চেনা ট্রেনে। যখন চোখ খুলেছিল, জানতো না সে কে? শুধু মাথার নিচে ছিল ঘাস, ঠান্ডা পাথর, উপরে কালো আকাশে জ্বলজ্বলে তারা আর মাথায় অনেক ব্যাথা। বনের ধারে জোনাকি আর তোবড়ানো একটা গাড়িতে দুটো মানুষ মরে পড়ে আছে।
এক বাঙালি ভদ্রলোক তাকে খুঁজে পেলেন। নাম ঠিকানা বলতে পারে না দেখে, তাকে নিতে চেয়েছিলেন পুলিশের কাছে। তাই সে পালালো। ভোঁ বাজিয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছাড়ছিলো যে গাড়িটা, দৌড়ে উঠে পড়লো তাতে। পা ফসকায়নি, দুটো হাত টেনে তুললো তাকে কামরায়। হারুনদার হাত। বারবার সবাইকে ‘নাম জানি না’ বলতে ভালো লাগছিলো না, তাই এবার দোকানের বোর্ডে দেখা নামটা বলে দিল নিজের করে ‘ ফটিকচাঁদ ‘।
আরও পড়ুনঃ একেই বলে শুটিং PDF সত্যজিৎ রায়
হারুনদা তাকে কিছু মনে করার জন্য চাপ দেয়নি। বলেছে এমনিতেই মনে পড়বে। উপেনবাবুর চায়ের দোকানে কাজ জুটিয়ে দিয়েছে, যদিও পোশাক আর চুলের ছাঁট পরীক্ষা করে বলেছে ‘তুমি সাহেববাড়ির ছেলে!’ দুটো কাঠের বলও দিয়েছে, রাতে খেল প্র্যাকটিস করে ফটিক।
কিন্তু চায়ের দোকানে মামলেট আর চা খেতে আসা ষন্ডা লোকটা ফটিককে এতো প্রশ্ন করলো কেন? বে-পাড়ার পা বাঁকানো শ্যামলাল ফটিকের পিছু নিয়েছে কেন? হারুনদা কি পারবে ফটিককে শ্যামলালের হাত থেকে বাঁচাতে? ফটিকের আসল পরিচয় কি?
আরও পড়ুনঃ পথের পাঁচালী উপন্যাস PDF রিভিউ – বিভূতিভূষণ
মন্তব্যঃ
ছোটবেলায় কতরকম অলীক ইচ্ছে থাকে আমাদের, বাড়ি থেকে পালাবো, বাস ড্রাইভার হবো! জঙ্গলে যদি ডাকাত দলের সাথে ভীড়ে যাই? বা চায়ের দোকানের বয় হয়ে কাটিয়ে দিলে কেমন লাগবে?
এক বালক তেমনি ঘটনাচক্রে হারিয়ে গিয়েছে বাড়ি থেকে। মাথায় আঘাত পেয়ে নিজের অতীত ভুলে গেছে সে, জানে না কি তার পরিচয়। শুধু বলের খেলা দেখানো প্রিয় হারুনদা, উনুনের ধোঁয়ায় মোড়ানো বস্তিতে হারুনদার আজব ঘরটা, উপেনদার চায়ের দোকানের হরেকরকম খদ্দের আর শহিদ মিনারে বাঁশি বাজিয়ে খেলা দেখানোই তার কাছে বর্তমান। সেই জীবনে বাড়তি উত্তেজনা নিয়ে আসে ধাওয়া করা গুন্ডার দল। যে উত্তেজনার স্বাদ আমরা পাওয়ার আশা করেছি শিশুবয়সে – তাকেই ফটিকের জীবনের পাতায় নিয়ে এসেছেন সত্যজিৎ রায়।
আরও পড়ুনঃ শরৎচন্দ্র রচনা সমগ্র PDF Download
লেখক পরিচিতিঃ
সত্যজিং রায় বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে যতটা পরিচিত, সমান পরিচিতি তাঁর চিত্রনাট্যকার ও লেখক হিসেবে। বর্তমান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটে ছিল, পরবর্তীতে এই বিখ্যাত রায় পরিবার চলে আসেন কলকাতায়, সেখানেই সত্যজিতের জন্ম ১৯২১ সালে।
‘সন্দেশ’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। প্রাথমিকভাবে তার লেখার পাঠক হিসেবে শিশু-কিশোরদের বিবেচনা করা হলেও, বড়দের কাছেও তার লেখা সমাদৃত। তাঁর সৃষ্ট জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র গোয়েন্দা ফেলুদা, তাড়িনীখুড়ো এবং প্রোফেসর শঙ্কু। পাশাপাশি লিখেছেন ছোটগল্প, কবিতা, লিমেরিকস, মোল্লা নাসিরউদ্দিনের গল্প। তাঁর অনেক গল্পই ইংরেজিতে অনুদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। নিজের গল্পের বইয়ে অলংকরণ নিজেই করতেন।
আরও পড়ুনঃ বিদেশী অনুবাদ বই রিভিউ পিডিএফ
সাহিত্যকর্মঃ
ফেলুদা, শঙ্কু ও তাড়িনীখুড়ো সিরিজের পাশাপাশি লেখক ছেলেবেলার কাহিনি নিয়ে লেখেন যখন ছোট ছিলাম (১৯৮২)। চলচ্চিত্রের ওপর লেখা তাঁর প্রবন্ধের সংলনগুলো হল: আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস (১৯৭৬), বিষয় চলচ্চিত্র (১৯৮২) এবং একেই বলে শুটিং (১৯৭৯-৯০)। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সত্যজিতের চলচ্চিত্র বিষয়ক নিবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়, নাম ‘আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস’। এছাড়াও সত্যজিৎ ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ নামে ননসেন্স ছড়ার বই লেখেন, যেখানে লুইস ক্যারলের ‘জ্যাবারওয়কি’-র একটি অনুবাদ রয়েছে। তিনি “রে রোমান” ও “রে বিজার” নামের দুইটি টাইপফেস নকশা করেন।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত
লেখক প্রচুর ছোটগল্প লিখেছেন যেগুলো বারোটির সংকলন হিসাবে প্রকাশ পেত এবং সংকলনগুলোর শিরোনামে ‘বারো’ শব্দটি বিভিন্ন ভাবে ব্যবহৃত হত। যেমন, ‘একের পিঠে দুই’, ‘এক ডজন গপ্পো’ ইত্যাদি। কৌতুক-ধাঁধা ও শব্দের খেলার প্রতি তাঁর আগ্রহ এ গল্পগুলোতে প্রকাশ পায়। লেখকের বিখ্যাত গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, অনুকুল, ক্লাসফ্রেন্ড, প্রোফেসর হিজিবিজবিজ, দুই বন্ধু, পিকুর ডায়রি ও অন্যান্য ইত্যাদি।
প্রিয় লেখকের এই ফটিকচাঁদ গল্পটি সম্পর্কে আপনার মতামত আলোচনা করার আমন্ত্রণ রইলো।
পড়তে থাকুন, নিরাপদে থাকুন।
ধন্যবাদ।
লিখেছেনঃ সৈয়দা ফাতিমা বানু
বইঃ ফটিকচাঁদ [ Download PDF ]
লেখকঃ সত্যজিৎ রায়।
ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
সত্যজিৎ রায় এর অন্যান্য রচনা সমগ্র