জহির রায়হান মৃত্যু রহস্য

নিখোঁজ নন, গুলিতে নিহত হয়েছিলেন জহির রায়হান | ভোরের কাগজ

Redirect Ads

১৯৭১ সাল, মুক্তিযুদ্ধের সেই ৯ মাস হাতে প্রাণ নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন রক্তাক্ত বাঙলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। আদিকালের এক ক্যামেরা আর সামান্য কিছু যন্ত্রপাতি দিয়েই জহির রায়হান তৈরি করেছেন অবিসংবাদী এক ডকুমেন্টরি “স্টপ জেনোসাইড”। তুলে ধরেছিলেন পাকিস্তানিদের বর্বরতা আর নৃশংসতার ইতিবৃত্ত। বিজয়ের পর ১৮ ডিসেম্বর দেশে ফিরে অনেকগুলো নতুন সিনেমা নিয়ে কাজ করার কথা ছিল তার। এরই আগে তার সবচেয়ে প্রিয়জনদের একজন আপন বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে তুলে নিয়ে গেছে জামাতের জল্লাদবাহিনী আলবদরেরা। শুধু তার ভাই নন, বিজয়ের প্রাক্কালে নিখোঁজ হয়েছেন আরও অসংখ্য বুদ্ধিজীবী।

পরাজয় যখন নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে তখনই বাঙালি জাতির মস্তিষ্ককে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে পাকিস্তানি সেনারা। সেই নীলনকশায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে ১০০ বছরের পিছনে ফেলে দেয় এদেশীয় কিছু বেইমানেরা। প্রিয় বড়ভাইকে হারানোর শোকে পাগলপ্রায় জহির রায়হান বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার তথ্য অনুসন্ধান ও ঘাতকদের ধরার জন্যে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি’ নামে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। এই কমিটির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছিল গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী গণহত্যার নির্দেশদাতা, বাস্তবায়নকারী ও এর সঙ্গে জড়িত এদেশীয় আলবদর ও রাজাকারদের পরিচয়, অসংখ্য গোপন তথ্য ও ডকুমেন্টস। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে কারা জড়িত ছিলেন এবং হত্যাকারীদের অনেকেরই গোপন আড্ডাখানা সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট তথ্য হাতে পেয়েছিলেন জহির রায়হান, যা দিয়ে এদের প্রত্যেককে যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের দায়ে বিচারের মুখোমুখি করা যায়। ৩০ জানুয়ারি বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর জন্য সংবাদ সম্মেলনেরও আহ্বান করেন তিনি।

Download

আরও পড়ুনঃ জহির রায়হান রচনাবলী pdf download রিভিউ

পাকিস্তান-ফিল্ম-ফেস্টিভ্যাল-জহির-রায়হান-ঢাকা-১৯৬৫
পাকিস্তান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে জহির রায়হান, ঢাকা-১৯৬৫

সেই ৩০ জানুয়ারি সকালেই একটা ফোন পেলেন জহির রায়হান। এর কয়েকদিন আগ থেকেই রফিক উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি জহিরকে আশ্বাস দিয়ে আসছিল যে, শহিদুল্লাহ কায়সার বেঁচে আছেন। তাকে জীবিত পাওয়া যাবে। জহিরের চাচাতো ভাই শাহরিয়ার কবির বহু বার এই রফিককে ফ্রড এবং ধাপ্পাবাজ বলে জহিরকে বোঝাতে চাইলেও ভাইয়ের শোকে পাগল প্রায় জহির তাতে কর্ণপাত করেননি। এটাই তার কাল হয়েছিল। ভাইকে শুধু একটিবারের জন্য ফিরে পেতে পৃথিবীর সবকিছু দিতে রাজি ছিলেন জহির রায়হান। সেই সুযোগটাই নিয়েছিল ঘাতকেরা! রফিককে ৩০ জানুয়ারির পর আর খুঁজেও পাওয়া যায়নি।

বেশ কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, সেদিন সকালে ‘মাস্তানা’ নামে এক বিহারী নৃত্যপরিচালক জহিরকে ফোন দিয়েছিল। জানিয়েছিল তার বড় ভাই শহিদুল্লাহ কায়সারসহ আরও কিছু বুদ্ধিজীবীকে মিরপুরে বিহারীরা আটকে রেখেছে। যদি সেই দিনের মধ্যে তিনি নিজে উপস্থিত না হন, তবে তার ভাইকে আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু মিরপুর তো বিহারীদের দখলে। কাকতালীয়ভাবে ঠিক সেইদিনই বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব মইনুল হোসেন চৌধুরী সশরীরে এসে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন—মিরপুরের বিহারীদের কাছে থাকা অস্ত্র উদ্ধার করে মিরপুর স্বাধীন করতে। সে উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগ পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী পুরো মিরপুর ঘিরে রেখেছিল। বেরিয়ে যান জহির, পরনে ছিল ছাই রঙয়ের প্যান্ট আর গাঢ় ঘিয়ে রঙের কার্ডিগান। সাদা রঙের শার্টের সঙ্গে পায়ে ছিল স্যান্ডেল…

আরও পড়ুনঃ কি হয়েছিলো শহিদুল্লাহ কায়সারের সাথে?

Download

১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে মিরপুর ১২ নম্বরের নুরী মসজিদের সম্প্রসারণ কাজের সময় একটি স্ল্যাব দিয়ে ঢাকা কুপের সন্ধান পায় নির্মাণকর্মীরা। স্ল্যাব ভেঙে তারা আবিষ্কার করে তিনটি মাথার খুলি ও কিছু হাড়গোড়। প্রথম আলো নিউজটি ব্রেক করার পর বুদ্ধিজীবিদের স্বজনরা ছুটে আসেন। এভাবে আবিষ্কার হয় মুসলিম বাজার বধ্যভূমি। ভোরের কাগজের অনুসন্ধানী রিপোর্টার জুলফিকার আলি মানিক সেটা কাভার করছিলেন। একই সময় জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হানও তার বাবার অন্তর্ধান রহস্য ভেদে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন। সূত্র খুজে খুজে মানিক পেয়ে গেলেন ৩০ জানুয়ারি যুদ্ধের একজন সৈনিক আমির হোসেনকে। তার কাছেই জানলেন নিজের চোখে জহির রায়হানকে বিহারী ও রাজাকারদের হাতে গুলিতে শহীদ হতে দেখেছেন তিনি। ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জুলফিকার আলি মানিকের প্রতিবেদনটির পিডিএফ নিচে দেয়া আছে।

Facebook Comments

Similar Posts