আশির দশকে ঢাকা শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ-দু:খ, হাসি- কান্নার গল্প নিয়ে সাজানো হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিনরাত্রি’। শফিক-নীলু, রফিক-শারমিন, আনিস-শাহানা, বাবা-মা, টুনি, বাবলু, মামা, সোবহান সাহেব সব দারুণ চরিত্রের মিশেল এই গল্পে। সবার এত মায়াময় অভিনয় আর হুমায়ূন আহমেদের সংলাপ দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করে। দিনদিন যত পর্ব বেড়েছে এই নাটকের প্রতি মায়া আরো বেড়েছে। সবাই এই নাটকে দারুণ অভিনয় করেছে। সত্যি এখন মনে হচ্ছে নাটকের চরিত্রগুলোর সঙ্গে যেন মিশে গিয়েছিলাম। করোনাকালীন বিটিভি যেন ফিরে গেছে সেই ৮০/৯০এর দশকে। প্রতিদিন ৮টার পর পরিবারের সবাই অপেক্ষা করছে এরকম জনপ্রিয় সব নাটকগুলোর জন্য।
“এইসব দিনরাত্রি” নাটকে নীলু চরিত্রে ডলি জহুর পরিবারের বড় ভাবী। সব দায়িত্ব, অভিযোগ, নিজের অভিমান তুলে রাখা, কষ্ট, স্বাধীনচেতা সব মিলিয়ে নীলু চরিত্রের যেন বিকল্প হয় না। অভিনেত্রী হিসেবে ডলি জহুরের পরিচিতি এই নাটক দিয়ে, সত্যি একজন অভিনেত্রী এমন চরিত্র পেলে তাকে সারাজীবন দর্শকেরা এমনিই মনে রাখবে। শফিক চরিত্রটি প্রথমদিকে আমার অত পছন্দের ছিল না কিন্তু আজ শেষ পর্বের পর এটি আমার অন্যতম পছন্দের চরিত্র হয়ে উঠল। বুলবুল আহমেদ সিনেমায় যেমন আভিজাত্য দেখিয়েছেন তেমনি নাটকেও, উনার অভিনয়ের তুলনা হয় না। টিভি নাটকে বুলবুল আহমেদ- ডলি জহুর জুটি আমার দেখা অন্যতম সেরা জুটি।
আরও পড়ুনঃ বাদশাহ নামদার রিভিউ PDF হুমায়ূন আহমেদ
রফিক চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েছেন। বেকার, উড়নচন্ডী হয়েও বড় ভাইয়ের আয়ে চলা সংসারে বড়লোকের মেয়ে প্রেমিকাকে স্ত্রী হিসেবে নিয়ে এসেছেন। তবে রফিক অসাধারণ হয়ে থাকবেন তার স্পষ্টবাদিতার জন্য এবং পরিবারের দু:সময়ে সবচেয়ে কঠিন ভাবে সামলানোর জন্য। শারমিন চরিত্রে লুৎফরন্নাহার লতা হয়তো কম সুযোগ পেয়েছে তবে সেও খুব ভালো করেছে।
শাহানা চরিত্রে শিল্পী সরকার অপু এত্ত দারুণ করেছেন। অবুঝ মনে অভিমান, চঞ্চলতা আবার বিষাদে ভরা চরিত্রটি আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল, আর আনিস চরিত্রে খালেদ খান। যাদুকর তবে এখনো প্রতিষ্টিত হতে পারেন নি। তাই শাহানাকে বিয়ে করার সাহস পান নি। আনিসের শাহানার বিয়ের গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দৃশ্যটি আমি জীবনে ভুলতে পারবো না।
মায়ের চরিত্রে কখনো কঠোর, কখনো মায়াময় দিলারা জামানের সম্ভবত সেরা অভিনয় অয়োময়তে, এরপর ই নিশ্চিত ভাবে থাকবে এই ধারাবাহিকে। বাবা চরিত্রে কাজী মেহফুজুল হক ছিলেন সিনেমার ভিলেন অথচ এই ধারাবাহিক দেখলে সেটা পুরো অবাস্তব মনে হবে। এত নির্মল অভিনয়, বাবার শান্তশিষ্ট, পুরো একটি অন্যরকম চরিত্র। মামার চরিত্রে আবুল খায়ের বোধহয় অভিনয়ের আরেক জীবন পেয়েছিলেন, সুখী নীলগঞ্জ প্রজেক্ট এইদেশে এখনো প্রয়োজন। ছন্নছাড়া আবুল হায়াতের অভিনয় ও মনে রাখার মত। রাইসুল ইসলাম আসাদের নির্ভার অভিনয়, সুজা খন্দকারের কৌতুকাবহ অভিনয়, জামাল উদ্দিন আহমেদের অভিনয় সবার অভিনয়, চরিত্র গেঁথে থাকবে।
আরও পড়ুনঃ কালজয়ী নাটক “কোথাও কেউ নেই” এর সেরা কিছু কথোপকথন
নাটকে বড় ধাক্কা আসে টুনির মৃত্যু, সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র। যার মৃত্যু দর্শকেরা মেনে নিতে পারেনি। সত্যিই আমি আজ এত বছর পর দেখেও তার মৃত্যুটা মেনে নিতে পারিনি। টুনিও অসাধারণ অভিনয় করেছিল, বাস্তবে যার নাম ছিল লোপা। পুরো ধারাবাহিকে তিনজনের মৃত্যুই কষ্ট দিয়েছে। প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমান সবাইকে এত ভালোভাবে সামলিয়েছেন, নাটকের সূচনা সংগীত থেকে আবহ সংগীত কিংবা রবীন্দ্র সংগীত সব ই ছিল মুগ্ধ করার মত। কৃতজ্ঞতা হুমায়ূন আহমেদের প্রতি, এমন মায়াময় করে গল্প ও চরিত্রের সৃষ্টির জন্য।
টানা দুই মাস ধরে বিটিভিতে চলতে থাকা বিখ্যাত ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’র শেষ পর্ব হল আজ ১০ জুলাই, ২০২০। ৫৯ পর্বের এই ধারাবাহিক দেখার জন্য রাত ৯ টায় বিটিভির সামনে বসেছি, অসুস্থ ছিলাম তবুও দেখার চেষ্টা করেছি। রাতে না দেখতে পারলে পরেরদিন সকালে পুন:প্রচার দেখেছি। আমার সেই নিয়মিত রুটিনে আগামীকাল থেকে ছেদ পড়বে, তবে ঘরবন্দীর এই সময়ে আমার এইসব দিনরাত্রি দেখার সুখস্মৃতি আমার সারাজীবন মনে থাকবে।
লিখেছেনঃ হৃদয় সাহা
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার