আলেকজান্ডার পুশকিন অনুবাদ বই

বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : আলেকজান্ডার পুশকিন | প্রথম পর্ব | Alexander Pushkin

Redirect Ads

পুরো নাম আলেকজান্দর সের্গেইভিচ পুশকিন। অনেকের মতে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় কবি। তবে আমি ওভাবে বলবো না, আমি বলবো রাশিয়ার প্রথম বড় লেখক। তাঁর আগে রুশ কবিতায় এমন কেউ ছিলো না, যাকে তাঁর সমান বা তাঁর চেয়ে বড় বলা যেতে পারে। তিনি রোম্যান্টিক যুগের লেখক, কিন্তু ভিত গড়ে দিয়েছিলেন রুশ সাহিত্যের আধুনিক ধারাটির। এর কারণ হলো— পুশকিন শুধু কবিই ছিলেন না। কবিতা তিনি অল্পকালই লিখেছিলেন, এবং ৩৫-৩৬ বছর বয়সেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন কবিতা লেখা। তাঁর অনেক নাটক, উপন্যাস, ছোট গল্প, ও রূপকথা পড়লে আমরা যে-চিত্রটি পাবো, সেটি তাঁর কবি পরিচয়ের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক রুশ ভাষা বলতে আমরা যা বুঝি, তার শুরুও পুশকিনের হাত ধরেই।

পুশকিন দ্বারা প্রভাবিত হননি, এমন লেখক রুশ সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পুশকিন তাঁর গদ্যে যে-ভাষাভঙ্গী সৃষ্টি করেছিলেন, সেটিই আধুনিক রুশ সাহিত্যের প্রাণ। এ ভাষাকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারেন নি। সে-হিশেবে তুর্গেনেভ, লারমান্তোভ, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, চেখভ, গোর্কি, গোগল, তাঁদের সবাইকেই আমি পুশকিনের ভাষার কলসি বলবো। প্রশ্ন উঠতে পারে, পুশকিন কার ভাষার কলসি ছিলেন? পুশকিনের একটি স্বীকারোক্তি আমলে নিলে, উত্তরটি হবে কারামজিন। তবে গদ্যে কারামজিনের ভাষাভঙ্গী ব্যবহার করলেও, কবিতায় তাঁর ছিলো নিজস্ব ভাষাভঙ্গী। আবার কারামজিনের স্টাইলকে তিনি শুধু অনুকরণই করেন নি, একে সমৃদ্ধও করেছেন বিপুলভাবে, যদিও মাত্র ৩৭ বছর বাঁচার কারণে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ তিনি পান নি।

Download

রোম্যান্টিসিজম থেকে রিয়ালিজম, রুশ সাহিত্যের এই ট্রানজিশনটি, পুশকিনই প্রথম শুরু করেছিলেন। তাঁর শৈশব কেটেছিলো ফরাসি গৃহশিক্ষকদের সান্নিধ্যে। ফলে ফরাসি ও রুশ, এ দুটিই ছিলো তাঁর মাতৃভাষা। ফরাসি ভাষা জানা না থাকলে, লেখক পুশকিনকে আমরা পেতাম কি না সন্দেহ। ইউরোপীয় এনলাইটনমেন্টের ধাক্কা তিনি ফরাসি ভাষার মাধ্যমেই পান। ভলতেয়ার এবং দিদারো, এ দুজনকেই পুশকিন বেশি অনুসরণ করতেন। তাঁদের প্রতি এ ঋণ, পুশকিন বহুবার স্বীকারও করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন, কারামজিন-স্টাইলের গদ্যের সাথে ভলতেয়ার স্টাইলের গদ্যের একটি সংমিশ্রণ ঘটাতে। তবে ভলতেয়ারের ‘জাদিগ’ বা ‘কন্ডিড’, আর পুশকিনের ‘দি শট’ বা ‘দুব্রোভস্কি’, এগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি দুই তোলা কারামজিনের সাথে ১৪ তোলা ভলতেয়ার মিশিয়েছেন। ফলে, পুশকিন যে- গদ্যরীতিটি তৈরি করেছিলেন, তা স্বভাবতই আর রুশ গদ্যরীতি থাকে নি। এটি হয়ে উঠেছিলো অনেকটা ফরাসি গদ্যরীতি। এ রীতি তখন রুশদের কাছে অভিনব ছিলো, এবং সম্ভবত এ কারণেই, অনেক রুশ লেখক আকৃষ্ট হয়েছিলেন পুশকিন স্টাইলের এ নতুন গদ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গোগল। গোগলের ‘ডেড সোওল’ উপন্যাসটি পুশকিনের মৃত্যু নিয়ে লেখা।

পুশকিন যখন ছাত্র ছিলেন, তখন কান্টের লিবারেল ইন্ডিভিজুয়ালিজমও তাঁকে আলোড়িত করেছিলো। কান্টিয়ান লিবারেল ইন্ডিভিজুয়ালিজম কী, তা আমি এখানে আলোচনা করবো না, কিন্তু পুশকিনের রাজনীতিক চেতনা, এবং জার সরকারের সাথে তাঁর দ্বন্দ্বের রূপটি বুঝতে হলে, কান্টের রাজনীতিক দর্শনের দিকে একটু ইঙ্গিত করা জরুরি।

কান্টের ‘Rechtsstaat’ সম্বন্ধে যাদের ধারণা আছে, তারা জানেন যে কান্ট রাষ্ট্রের অসীম ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন না। রাষ্ট্রের ক্ষমতা থাকবে সীমিত, যেন সে মানুষের উপর স্বেচ্ছাচারীভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না পারে। মানুষের কিছু মৌলিক স্বাধীনতা আছে, যেগুলোর উপর রাষ্ট্রের কোনো কর্তৃত্ব থাকা উচিত নয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার এ চিত্রটিকেই সংক্ষেপে কান্টিয়ান লিবারালিজম বলা যেতে পারে। পুশকিন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, তখন পেত্রোভিচ কুনিতসিন তাঁকে কান্টের এ দর্শনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ‘১৯ অক্টোবর’ নামে পুশকিনের যে-কবিতাটি আছে, তা পেত্রোভিচকে স্মরণ করেই লেখা।

আরও পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : মাক্সিম গোর্কি | প্রথম পর্ব | Maxim Gorky

Download

পুশকিন যে-সময়ের কবি, সে-সময়ে রুশদের ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে তেমন কিছু ছিলো না। জার সম্রাটদের ইচ্ছাই ছিলো সব। পুশকিন এ বিষয়টি লক্ষ করেছিলেন, এবং এ কারণে কান্টের দর্শন দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফলে শুরু করেছিলেন সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে লেখালেখি, যা জার সরকারকে ক্ষুব্ধ করেছিলো। পরিণতি— মস্কো থেকে বিতাড়িত হওয়া। এ শাস্তি অনেক কমই ছিলো, কারণ সম্রাট নিকোলাস কমবেশি শিল্প-সংস্কৃতির কদর করতেন। তিনি পুশকিনের প্রতিভা টের পেয়েছিলেন, এজন্য মেরে না ফেলে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। আশা করেছিলেন, কবি হয়তো ভুল বুঝতে পারবেন, এবং প্রজার স্বাধীনতার চেয়ে রাজার সন্তুষ্টির উপরেই বেশি জোর দেবেন। কিন্তু মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে একবার যে দাঁড়িয়ে যায়, তাঁর পক্ষে রাজার গোলামি করাটা আর সম্ভব হয়ে উঠে না।

লেখকদের জন্য একটি বড় সংকট হলো— সরকার মনে করে লেখকেরা সরকারের সম্পত্তি। তারা কথা বলবেন সরকারের পক্ষে, রাষ্ট্রের পক্ষে। আবার জনগণ মনে করে, লেখকেরা গণমানুষের সম্পত্তি। তারা কথা বলবেন গণমানুষের পক্ষে। অনেক লেখক এ দুই দলের যেকোনো একটিকে বেছে নিতে পারলেও, কেউ কেউ তা পারেন না। পুশকিন এই কেউ কেউদের একজন। তাঁর কবিতা না ছিলো সরকারের, না ছিলো জনগণের। ফলে উভয় পক্ষই তাঁর উপর বিরক্ত হতো। কারণ বিশুদ্ধ শিল্পকলা, মাঝেমধ্যে সরকারের পক্ষে যায়, মাঝেমধ্যে জনগণের পক্ষে যায়, এবং কখনো সখনো— কারও পক্ষেই যায় না, শুধু সবার জন্য উপভোগের বিষয় হিশেবেই থেকে যায়।

পুশকিন বিয়ে করেছিলেন শহরের এক বিখ্যাত সুন্দরীকে। নাম— নাতালিয়া গঞ্চারোভা। সম্রাট নিকোলাস থেকে শুরু করে, শহরের এমন কোনো পুরুষ ছিলো না, যে ওই সুন্দরীর রূপের ভক্ত ছিলো না। নাতালিয়ার ঘরে পুশকিনের চার সন্তান ছিলো, কিন্তু এক ফরাসি রয়ালিস্টের সাথে নাতালিয়ার পরকিয়ার গুজবে পুশকিন খুব অশান্তিতে পড়েছিলেন। এসময় তাঁর আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল না। অনেকের মতে, নাতালিয়া দামি পোশাক ও দামি জুয়েলারি পরতে পছন্দ করতেন, কারণ রাজপ্রাসাদে নাতালিয়ার অহরহ যাতায়াত ছিলো। এ পোশাক-আশাকের খরচ যোগাতে পুশকিন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, এবং শুরু করেছিলেন বাণিজ্যিক লেখালেখি। যাইহোক তাঁর পারিবারিক বিষয়গুলো নিয়ে আমি মন্তব্য করবো না, শুধু তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারটিতে একটু আলোকপাত করবো।

নাতালিয়ার ওই প্রেমিকের নাম ছিলো দান্তেস গেক্কার্ন, যিনি এই হাঙ্গামা সমাপ্ত করতে নাতালিয়ার বোনকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পরও দান্তেস, নাতালিয়ার পিছু ছাড়েন নি। ফলে ব্যাপারটি একসময় খুনখারাবিতে গড়ায়। পুশকিন এবং দান্তেসের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ অনুষ্ঠিত হয়। ওই যুগে প্রায়ই দুজন মানুষের মধ্যে ‘ডিউয়েল’ বা মারামারি অনুষ্ঠিত হতো, এবং এক শত্রু প্রাণ দিতো আরেক শত্রুর হাতে। পুশকিন-দান্তেস মারামারিতে, পুশকিন নিহত হয়েছিলেন দান্তেসের গুলিতে। পুশকিনের মতো একজন লেখক, কী জন্য এই আহাম্মকিতে জড়িয়েছিলেন তা আজও আমার বুঝে আসে না। নাতালিয়া পরে একজন মেজর জেনারেলকে বিয়ে করেছিলেন। কিছুদিনের জন্য সম্রাট নিকোলাসের গোপন বেগমও হয়েছিলেন। যাইহোক, এগুলো সামান্য বলার কারণ হলো, তাঁর এ পারিবারিক টানাপোড়ন তাঁর কবিতাকেও প্রভাবিত করেছিলো। অনেকে বলতে পারেন, কীভাবে? তাঁর ‘শি’ কবিতাটির কথাই ধরা যাক। কবিতাটি এরকম—
“Confess to me, what’s wrong. You’re in dejection.”

Download

I love, my friend! – “Which lady holds you captive?”

She does. – “Glisera? Chloe? Lila’s so attractive!”

O, no! – “To whom do you submit your soul’s affection?”

To her! – “You’re humble! Why all this remorse?
Why do you seem so sorrowful and grim?
And who’s to blame? Her fiancé, her dad, of course…”

Download

It isn’t that! – “Then what?” – For her, I can’t be him.

এরকম আরও অনেক কবিতা তাঁর আছে, যেগুলোতে তাঁর ব্যক্তিগত টানাপোড়ন উপজিব্য হয়েছে।
আবার তাঁর কবিতায়, রোম্যান্টিসিজম থেকে রিয়ালিজমের যে-ট্রানজিশনটি আমার নজরে পড়েছে, তা ঘটেছে মূলত পুলিশের কারণে। ‘বরিস গুদোনভ’ নামে তাঁর যে-বিখ্যাত নাটকটি রয়েছে, সেটিও পুলিশের নজরদারির ফসল। এজন্য আমি সবসময় বলি, শিল্প-সাহিত্যে পুলিশি নজরদারি অত্যন্ত খারাপ ফল বয়ে আনে। রাজা এটি তাঁর ভালোর জন্যই করেন, কিন্তু এটি কখনো তাঁর জন্য ভালো হয় না। কারণ এটি লেখকদেরকে সরাসরি রাজার প্রতিপক্ষ করে তোলে, এবং লেখকেরা তখন কোনো না কোনোভাবে, তাঁদের লেখায় রাজার খবরদারির বিষয়টি টেনে আনেন। পুশকিনের একটি কবিতার কথাই ধরি—

Why feed the early signs of boredom
With sinister and dismal thought,
And wait for separation, burdened
With sorrow, lonesome and distraught?
The day of grief is close at hand!
You’ll stand, alone, out in the sun,
And try to bring back once again
These days, but they will long be gone.
Misfortune! then, you’ll be ready
To die in exile, on the street,
If you could only see your lady,
Or hear the shuffle of her feet.

কবিতাটি প্রথম প্রথম পড়লে, একেবারেই নির্বিষ রোম্যান্টিক ধাঁচের কবিতা মনে হবে। কিন্তু একটু খেয়াল করে পড়লে বুঝা যাবে, এখানে রোম্যান্টিসিজমের সাথে খুব হালকা রিয়ালিজমের মিশ্রণ ঘটেছে। এ মিশ্রণে কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কাজ করেছে। অন্যথায়, কবিতাটি হয়তো তিনি পুরোপুরি রোম্যান্টিক ধাঁচেই লিখতেন। এজন্য মনে করি, লেখকদের স্বাধীনভাবে লিখতে দেয়াটাই রাজার জন্য মঙ্গলজনক।

আরও পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : লিও টলস্টয় | শেষ পর্ব | Leo Tolstoy in Bengali

‘বরিস গুদোনভ’ নাটকটি পুশকিন লিখেছিলেন ১৮২৫ সালে, প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮৮৩১ সালে। কিন্তু সরকারি বাধার কারণে, এটিকে দীর্ঘদিন থিয়েটারে পরিবেশন করা যায় নি। নাটকটির বিষয়বস্তু ছিলো বরিস গুদোনভ নামের একজন জার-বংশীয় শাসক, যিনি ১৫৯৮ থেকে ১৬০৫ সাল পর্যন্ত রাশিয়া শাসন করেন। নাটকটিতে, একজন অযোগ্য রাজাকে হটিয়ে কীভাবে একজন যোগ্য রাজা সিংহাসন দখল করতে পারেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত ইঙ্গিত ছিলো। এজন্য নিকোলাসের পুলিশ, এটির প্রকাশ ও পরিবেশন, দুটিই রুদ্ধ করতে চেয়েছিলো।

Download

একটি ব্যাপার আমি এখানে বলতে চাই। কোনো দেশের সাহিত্য ততক্ষণ পর্যন্ত দরিদ্র থাকে, যতোক্ষণ না এর সাথে বিশ্বসাহিত্যের সংযোগ স্থাপিত হয়। আমি লক্ষ করেছি, এ সংযোগটি যারা স্থাপন করেন, তাঁদের অনেককেই বাংলাদেশে ‘চোর’ ডাকা হয়। খুব তুচ্ছ মানুষেরা, নিতান্তই গরিব আনন্দ লাভের আশায় এ ‘চোর’ ডাকটি ডেকে থাকেন। তারা ভাবেন, অমুককে, যেমন রবীন্দ্রনাথকে, ‘চোর’ ডেকে তারা সাহিত্যের প্রভূত উপকার করে ফেলেছেন। যারা রবীন্দ্রনাথকে চোর ডাকেন, তারা মূলত ‘চুরি’ ব্যাপারটিই ঠিকমতো বুঝেন না। কারও লেখা চুরি করা, আর কোনো লেখা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া, এ দুটি এক জিনিস নয়। বাঙালি স্টাইলে ‘চোর’ শব্দটি ব্যবহার করতে গেলে, আমাকে পৃথিবীর সব বড় লেখককেই চোর বলতে হবে। পুশকিন তাঁর ‘বরিস গুদোনভ’ নাটকটি সম্পর্কে এক চিঠিতে লিখেছিলেন:

“…….I imitated Shakespeare in his broad and free depictions of characters, in the simple and careless combination of plots; I followed Karamzin in the clear development of events……”

পুশকিন এখানে সরাসরি স্বীকার করেছেন, নাটকটি রচনায় তিনি শেক্সপিয়ারকে অনুকরণ করেছেন। আবার ঘটনার বর্ণনায়, কারামজিনকে অনুকরণ করেছেন। এ অনুকরণের জন্য কি পুশকিনকে আমি চোর বলবো? রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনেক গল্পে এলান পো-কে অনুকরণ করেছেন, এখন এজন্য কি আমি তাঁকে চোর বলবো? পুশকিন যখন ছোট ছিলেন, তখন বাড়ির বড়দের কাছে নানা রূপকথার গল্প শুনতেন। এ রূপকথাগুলো ছিলো মানুষের মুখে মুখে টিকে থাকা কল্পকথা। এগুলো কে বা কারা রচনা করেছিলেন, তা কেউ জানে না। এগুলো একেক প্রজন্মে একেকভাবে টিকে থেকেছে। একই রূপকথার গল্প, সতেরো সতকে ছিলো একরকম, আবার আঠারো শতকে এসে হয়ে গেছে আরেক রকম। আবার গল্পটি যিনি বলেন, তিনি অনেকসময় পছন্দমতো কিছু শব্দ ও বাক্য জুড়ে দেন, এমন কি মূল কাহিনীতেও পরিবর্তন আনেন। পুশকিন তাঁর কিছু কবিতায়, এরকম লৌকিক রূপকথাকে সরাসরি ব্যবহার করেছেন। তাঁর বিখ্যাত ‘রুসলান এবং রুদমিলা’ কাব্যটি এরকম একটি রূপকথার ফসল। এখন আমি কি বলবো, পুশকিন লোককথা চুরি করেছেন? বরং ওই লোককথাটি, যখন মুখে মুখে ছিলো, তখন ছিলো বাজে বিনোদনমূলক কাহিনী, কিন্তু পুশকিন এটিকে ধার করার পরই এটি সাহিত্য হয়ে উঠেছে। একই কথা খাটে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও। ভারতবর্ষের নানা লৌকিক ও ধর্মীয় গানকে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কিছু গান ও কবিতায় উপজিব্য করেছেন, এবং সৃষ্টি করেছেন উৎকৃষ্ট সাহিত্য, এজন্য কি তাঁকে আমি চোর বলবো? হ্যাঁ, তাঁর লেখার সমালোচনা আমি করবো, কিন্তু তাঁকে সাধারণ অর্থে চোর ডাকার অর্থ হলো আমি যে সাহিত্য-সমালোচনা জানি না তা স্বীকার করে নেয়া।

আরও পড়ুনঃ দার্শনিক ভাষণ | বিষয়: শিক্ষা | প্রথম পর্ব | মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

আমি তো চাইলে পুশকিনের ‘দি ক্যাপেটেইনস ডটার’ উপন্যাসটিকে ওয়াল্টার স্কটের ‘দি হার্ট অব মিডলোথিয়ান’ উপন্যাসের নকল বলতে পারতাম, এবং তাঁকে চোর ডাকতে পারতাম, কিন্তু ডাকি নি কেন? এখানে উল্লেখ্য যে, ‘দি হার্ট অব মিডলোথিয়ান’-এর ‘কুইন ক্যারোলিন’ চরিত্রটিকে পুশকিন, তাঁর ‘দি ক্যাপেটেইনস ডটার’-এ ‘ক্যাথারিন দ্য গ্রেট’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছেন। উপন্যাস দুটির মধ্যে খুবই চোখে পড়ার মতো মিল রয়েছে। কিন্তু পুশকিন তো ইংরেজি ভাষা তেমন জানতেন না। তাহলে স্কট থেকে ধার করলেন কীভাবে? এর কারণ সম্ভবত বেস্তোজেভ, এবং পুশকিনের ফরাসি ভাষা। বেস্তোজেভ ছিলেন পুশকিনের সমসাময়িক লেখক, এবং ওয়াল্টার স্কটের লেখাকে বেস্তোজেভই বেশি অনুকরণ করতেন। আর পুশকিন ইংরেজি সাহিত্যের ফরাসি অনুবাদই বেশি পড়তেন। কিন্তু কথা হলো, পুশকিন স্কট থেকে ধার করে স্কটের মতোই উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন কি না? না কি বৃক্ষ আঁকতে গিয়ে গুল্ম এঁকেছেন? আমার ধারণা এ ব্যাপারে সবাই একমত হবেন যে, পুশকিনের ‘দি ক্যাপেটেইনস ডটার’ কোনো ছোট লতাপাতার ঝোপ নয়। তিনি বৃক্ষই সৃষ্টি করেছেন।

বৃক্ষটি কতো বড়, উঁচু না খাটো, মৃত না জীবিত, এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু বাঙালির মতো তাঁকে কেউ চোর নামে ডাকে নি। পুশকিন উপন্যাসটিতে, স্কটের ভাষাভঙ্গী ব্যবহার না করে করেছেন নিজের ভাষাভঙ্গী। ঘটনার বর্ণনাও করেছেন নিজস্ব স্টাইলে। ফলে দুটি উপন্যাসের ঘটনা-মিল নজরে পড়লেও, শিল্প-মিল নজরে পড়ে না। সেদিক থেকে দুটিই আলাদা সৃষ্টি। একই কথা রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আপনার হাতে কোনো অজন-ভজন বা লোকসঙ্গীত তুলে, আপনি তাকে রবীন্দ্রনাথ বা পুশকিনের মতো শিল্পরূপ দিতে পারবেন না। পারলে, রবীন্দ্রনাথকে আপনি চোর ডাকতেন না। এখন যদি আমি গ্রামের কোনো বিলুপ্তপ্রায় লোককথাকে, রাতদিন খেটে উৎকৃষ্ট সাহিত্যে রূপদান করি, তাহলে আমার ধারণা, আমাকেও আপনারা চোরই ডাকবেন। এতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু ক্ষতি হবে আপনাদের। কারণ এ চোর চোর ধ্বনি শুনে, ভবিষ্যতের কোনো সক্ষম লেখক বাংলা সাহিত্যের দারিদ্র্য ঘুচাতে এগিয়ে আসবেন না।

তারপর পড়ুনঃ বিশ্বসাহিত্য ভাষণ : আলেকজান্ডার পুশকিন | দ্বিতীয় পর্ব

Download

লিখেছেনঃ মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে ৫০০ বই পড়া উচিত | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার

Facebook Comments

Similar Posts