অন্দরমহল – সাদাত হোসাইন
“অন্দরমহল” কোন এক ধীমান পণ্ডিত বলেছিলেন-
“একটি বই প্রকাশিত হওয়ামাত্র পৃথিবীটা একটুখানি হলেও বদলে যায়, সেই বই নতুন আলো দেয় সভ্যতাকে…”
উক্তিটি “অন্দরমহল” এর ক্ষেত্রে পুরোপুরি সত্য. আমাদের ফেসবুককেন্দ্রীক কোনো ডিজিটাল শৈশব ছিলনা। আমাদের শৈশব ছিল রূপকথা, তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, ফেলুদা, অনুবাদ সাহিত্য এবং শার্লক হোমসের রহস্যে ঘেরা।
এরপর হাতে এলো সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু-আশুতোষ-সুচিত্রা-বুদ্ধদেব-হুমায়ুন আহমেদ সমৃদ্ধ শিল্পভাণ্ডার। চৌদ্দ বছর ধরে যে জগতে বুঁদ হয়ে আছি, কখনো মনে হয়নি ভেতরকার পাঠক সত্তার মৃত্যু হতে পারে। “অন্দরমহল” এর সার্থকতা এখানেই যে সে পাঠককে আজও এই অস্থির ডিজিটাল সময়েও বইমুখী করেছে! এটাই “অন্দরমহল” এর প্রদেয় আলো সভ্যতাকে।
“আরণ্যক” এবং “সোনার হরিণ নেই” যখন পড়েছিলাম তখন মনের অজান্তেই লোকালয় ছেড়ে সেই বনাঞ্চল এবং তার সাথে মিশে থাকা অরণ্যচারী চরিত্রগুলোর মাঝে নিজের সত্তাকে গুলিয়ে ফেলতাম। কোনভাবেই সেই জগত থেকে লোকালয়ে ফেরা সম্ভব হচ্ছিল না! লেখক সত্তা তখনই সার্থক হয়ে ওঠে যখন সে তার সৃষ্ট রাজ্যে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে।
“অন্দরমহল” শেষ করেছি অনেকদিন হলো, কিনতু অন্দরমহলের ভেতরকার মায়া থেকে বের হতে পারছিনা কোনভাবেই। শত শত বইয়ের পাঠক হওয়া সত্ত্বেও কখনো রিভিউ লেখার দুঃসাহস হয়নি এবং এখনো মনে করিনা সে যোগ্যতা অর্জন করেছি! সহজ সাবলীল ভাষারীতির অন্তরালে আখ্যানভাগের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে অগণিত চমক। মেজর-মাইনর প্রতিটা চরিত্রই স্বমহিমায় উজ্বল। প্রতিটা চরিত্রের আবর্তনে জীবনকে তার আপন মহিমায় ফুটিয়ে তুলতে পারতেও লেখকের ক্ষমতার পরিচয় মেলে।
আখ্যানভাগ সরলরৈখিক, গভীরতা অত। ঔপন্যাসিকের শিল্পরীতি তাঁর ব্যক্তিত্বেরই প্রতীক। এই উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে গঙ্গাবতী নদীর পাড়ে অবস্থিত বিষ্ণুপুরের জমিদারবাড়ি “গঙ্গামহল” এর ক্ষমতা দখলের অধিকার ও প্রতিপত্তিকে কেন্দ্র করে। জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ তাঁর তিনপুত্র এবং তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে গঙ্গামহলে বাস করেন। বড় পুত্র অবনীন্দ্রনারায়ণ একজন সঙ্গীত-অনুরাগী ব্যক্তিত্ব।
সঙ্গীত সাধনার গন্ডির বাইরের বৈষয়িক জীবন, জমিদারি-প্রথা, ক্ষমতার প্রতিপত্তি মোটকথা তাবৎ দুনিয়ার কোন ব্যাপারেই তার কোন আগ্রহ নেই। ছোট পুত্র দীপেন্দ্রনারায়ণ একদমই নির্ভেজাল চরিত্রের অধিকারী। আপাত দৃষ্টিতে জমিদারীর প্রতি তার কোন লোভ-লালসার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখি না। তাই সরল মনের এই মানুষটির শত্রুও ছিল না, তবে কান-ভারী করার মানুষের তো আবার দুনিয়াতে অভাব নেই!
যাইহোক, বড় দুই ভাইকে টপকে ভবিষৎ জমিদারীত্ব ভোগ-দখল করার কথা সে কল্পনাতেও আনতো না। বাকি রইলো মেজো ছেলে দেবেন্দ্রনারায়ণ। বিষ্ণুপুরের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকাররূপে তাকেই প্রবলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। স্বভাবে সে ছিল বেপরোয়া, বেহিসেবী এবং দোর্দণ্ড প্রতাপের অধিকারী। কিনতু একচেটিয়াভাবে তাকে ভবিষৎ জমিদার হিসেবে মেনে নিতে কারো আপত্তি আছে কী?
অবনীন্দ্রনারায়ণ না হয় জমিদারিত্ব বুঝে নিতে উদাসীন কিনতু তার পত্নী বীণাবালা? তিনি নিশ্চই চাইবেন তার স্বামী-পুত্র নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী জমিদার হিসেবে ক্ষমতা বুঝে নিক! আবার সময়ের কালচক্রে দীপেন্দ্রনারায়ণেরও কী সাধ হয়না সিংহাসন দখল করার? জানতে হলে “অন্দরমহল” হাতে তুলে নিতে হবে।
পাঠক অন্দরমহলের দ্বার ঠেলে ভেতরে পা দেয়া মাত্র জড়িয়ে পড়বে একের পর এক বিচিত্র ঘটনায় Iকখনো মুগ্ধ হবে চরিত্রের বিচিত্র জীবনবোধে,আবার কখনো হিংসা-বিদ্বেষের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাবে ক্ষণে ক্ষণে। গভীর ষড়যন্ত্র এবং কূটকৌশলের জাল বিছানো রয়েছে সমস্ত অন্দরমহল জুড়ে। সেই জাল থেকে হুট করে নিজেকে মুক্ত করে বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই। উপন্যাসটি শেষ হওয়ার পরেও জীবনের সাঁঝবাতিটির দ্যুতি ছড়িয়ে আছে পূর্ণ স্বস্তিতে। প্রিয় লেখক হিসেবে মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা ঔপন্যাসিকের ছিল, আছে এবং থাকবে। তবে আর দেরী কেন, প্রবেশ করুন ঊনিশ শতকের রহস্যময় অন্দরমহলে।
উপন্যাস: অন্দর মহল ঔপন্যাসিক: সাদাত হোসাইন প্রকাশনী: ভাষাচিত্র মুদ্রিত মূল্য: ৬৫০ টাকা রিভিউ করেছেন: প্রিয়াংকা বিশ্বাস বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বইয়ের ফেরিওয়ালা থেকে বই ধার করতে সদস্য হোন
বইয়ের ফেরিওয়ালায় লিখতে চাইলে এইখানে লেখা জমা দিন