রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর তমসাচ্ছন্ন সময় তখন। মিখাইল ভ্লাসভ নামে এক লোক কারখানায় কাজ করতো। প্রচন্ড হিংস্র। তার স্ত্রী নিলভনা। তাঁদের সংসারে এক পুত্র পাভেল ভ্লাসভ। ছোট বেলা থেকে পাভেলের মধ্যে এক প্রকার প্রতিবাদী চেতনা দেখা যায়। বাবা মিখাইল ভ্লাসভ মারা যায় বছর কয়েকের মধ্যে। বাবার মৃত্যুর পর ছেলের গতিবিধি হঠাৎ পাল্টাতে থাকে। কিন্তু মা নিলভনা বুঝতে পারেন না তার ছেলে কোথায় যায়, কাদের সাথে মিশছে।
এদিকে ছেলের চরিত্রে অন্য দশটা ছেলের চেয়ে অনেক সহনশীলতা ও কোমলতা নেমে এসেছে। মাকে ডাকে “মা-মণি”। এসব মায়ের প্রচন্ড ভালো লাগে। ছেলে মায়ের কাজেও সাহায্য করছে। কিন্তু মায়ের হঠাৎ মনে হতে থাকে- ছেলে ভয়ংকর কোনো কাজের সাথে যুক্ত হয়েছে।
অবশেষে মা জানতে পেরে অস্থির হয়ে পড়ে। ছেলেকে নিষেধও করতে পারেনা। মাঝে মাঝে নিজের ভয়ের কথা ছেলেকে ব্যক্ত করে কিন্তু ছেলে দৃঢ় কিন্তু কোমল কন্ঠে মাকে বুঝায়- তারা ন্যায়ের পথে লড়ছে। এ সংগ্রাম তাদের হাত ধরেই এগুবে। শোষকশ্রেণীর হাত থেকে দুনিয়াকে নামাতে হবে শ্রমিকদের হাতে। দুনিয়াটা হবে মানবতার, ন্যায়ের।
ছেলের এসব কথার মাঝে মা এক প্রকার শান্তি খুঁজে পান। কিন্তু সে শান্তি কোমল নয় মোটেও। শীতের ঝড়-হাওয়ায় ছটফট করতে থাকা তুষারের মতো সে শান্তি। সে শান্তির আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে থাকে অস্থিরতা, ভয় ও শঙ্কা।
ছেলে সমাজতন্ত্রীদের দলে যোগ দিয়ে নাস্তিক হয়েছে- ব্যাপারটা মাকে প্রচন্ড পীড়া দেয়। কিন্তু মা নিজের বিশ্বাসে অটুট ছিলেন। মাঝে মাঝে সমাজের পুঁজিবাদী শোষক, প্রতিনিয়ত পুকুর চুরি করা প্রশাসনের বিরুদ্ধে মা পাভেল এর মুখে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর শুনে কখনো পুলকিত হোন, কখনো তটস্থ হয়ে যান। এ ধরনের কথা আগে মা শোনে নি, তাই এই ভয়। কিন্তু সব কথায় সত্য। পাভেলের সেসব প্রতিবাদী কন্ঠে কোনো মিথ্যা খুঁজে পান না। বরং খুঁজে পান তার দেখা অবহেলিত সমাজটার এক ঝকঝকে ও দ্যুতিময় আয়না।
মা একসময় পাভেলের কথায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রথম প্রথম মা ভয়ে ছেলেকে ইশারা-ইঙ্গিতে নিষেধ করলেও এখন করেন না। কারণ তিনি ছেলের মাধ্যমে সত্যকে এখন উপলব্ধি করতে পারছেন।
দেখতে দেখতে পাভেলদের দলকে আরো বড় হতে দেখে মা। তাঁর ঘরে তারা আলোচনায় বসে। মা শুনে সেসব। কারো কারো কথা বা কাউকে খুব ভালো লাগে, আবার কারো কারো উগ্র কথায় মায়ের খারাপ লাগে। কিন্তু দিনশেষে মা দেখেন, এদের মাঝে শুধু একটাই চাওয়া। সেটা হলো শ্রমিকদের চোখ খুলে দেওয়া, শোষকদের অপশক্তি বুমেরাং করে দেওয়া।
সাশা নামে একটি দরদী ও মায়াময় চরিত্রও এই উপন্যাসে ধরা দেবে। সাশাও পাভেল ভ্লাসভদের দলের। কিন্তু সাশা পাভেলকে ভালোবেসেছে খুব কিন্তু কেন যেন পাভেল নির্বিকার থাকতো। কারণ তার স্বপ্ন অন্যদিকে। সেও যে সাশাকে ভালোবাসতো না তা কিন্তু নয়। কিন্তু সে সম্মুখে পড়ে থাকা বিশাল আন্দোলনের জন্য মুক্ত থাকতে চায়, সংসারের চিন্তা, কোনো রূপ পিছু টানে আটকে যেতে চায়নি। তাদের দুজনের ভিতরের বিশেষত সাশার আকুলতা পাঠক হৃদয়ে কিছুটা মলিন আভা ফেলবে।
মাও দেখতে দেখতে জোয়ান ছেলেগুলোর আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে তাদের দলে মিশে একাকার হয়ে যান।জনগণের মধ্যে বই,পত্রিকা বিতরণ করার জন্য তারা গোপনে তৎপরতা চালায়। এক্ষেত্রে মায়ের অবদান অগ্রগণ্য বলে দেখা যায় উপন্যাসে। এক সময় তারা আন্দোলনে নেমে পড়ে। সেই আন্দোলনের শুরুতে যেমন উত্তেজনা ছিল শেষে ছিল তেমনই কষ্ট। শ্রমিক বিপ্লবীদের পতাকা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষতে থাকে পুলিশ। পুলিশ সরে পড়তেই মা গিয়ে পতাকা তুলে নেন। এরপর মায়ের উপর অনেক হেস্তনেস্ত হলেও তিনি পতাকা আগলে রাখেন।
পাভেল, খ্খল, ফিওদর মাজিন, গুসেভরা, সাময়লাভ, বুকিন, সমভ ও আরো অনেককে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু আন্দোলন চলতে থাকে শহরের মানুষের শিরা-উপশিরায়। কিন্তু শেষ পরিণতি কি হয়েছিল সেটা জানার জন্যই আগ্রহী পাঠককে পড়তে হবে বইটি। শেষে হয়তো মায়ের জন্য পাঠকের মন থমকে যাবে দুয়েক মিনিটের জন্য, আহা মা !!!
উপন্যাসের শেষ পরিণতি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই বিখ্যাত উক্তি-
“Man is not made for defeat. A man can be destroyed but not defeated.”
পাভেলদের জন্ম পরাজয়ের জন্য নয়, বড়জোর এরা ধ্বংস হবে। কিন্তু সত্যের যে সংক্রমণ শেষ পর্যন্ত তা ছড়াবেই।
ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া:-
এক কথায় অসাধারণ। আর লেখক উপন্যাস লিখেন ঠিকই কিন্তু তার শব্দশৈলীর ক্ষমতা, উপমা-অলঙ্কারের ব্যবহারের যে ক্ষমতা তা আমার পড়া খুব কম লেখকের মধ্যেই পেয়েছি। অনেকে তার লেখাকে এজন্য ভালোবাসবেন বলে আমার মনে হয়। শব্দের যে গাঁথুনি তা আসলেই অসাধারণ। যদিও সেটা অনুবাদ কিন্তু লেখকের উপমা অলঙ্কার সুন্দর না হলে অনুবাদে তা হবে বলে মনে হয়না। তবে হ্যাঁ, অনুবাদটাও অসাধারণ হয়েছে। যাদের ইতিহাস আশ্রিত বই ভালো লাগে তারা চোখ বন্ধ করে পড়তে পারেন বইটি। বইটিই গোর্কিকে এনে দিয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতির আসন।
বই সম্পর্কে কিছু তথ্য:-
◆বইটি লেখক যে বাস্তব দুটি চরিত্রের অবলম্বনে লিখেছেন সে চরিত্র দুটি হলো “পিওতর জালমোভ” এবং তাঁর মা “আন্না কিরিলোভনা” । আর উপন্যাসে এ চরিত্র দুটি হলো পাভেল ও তার মা।
◆মহামতি লেনিন এই বই সম্পর্কে বলেছিলেন – সব মজুর এতদিন আন্দোলনে যোগ দিত আবেগতাড়িত হয়ে, কিন্তু ওরা এই বই পড়ে একাত্ববোধ হয়ে আন্দোলন করবে।
লিখেছেনঃ মেহেদি মানিক
মা ম্যাক্সিম গোর্কি pdf free download করুন
বইয়ের ফেরিওয়ালা থেকে যে কেউ যেকোনো সময় বিনামূল্যে যেকোনো বই ধার করে পড়তে পারে।
বইয়ের ফেরিওয়ালা থেকে বই ধার করতে এখানে ক্লিক করুন
বইয়ের ফেরিওয়ালায় আপনার লেখা প্রকাশ করতে চাইলে অথবা কোন বই রিভিউ করতে চাইলে লেখা পাঠান