এক সাক্ষাৎকারে আলী যাকের বলেছিলেন- “অভিনয়টাকে আমি উপাসনার মতো নিই!”
.
আমাদের বাংলাদেশে অভিনয়জগত ও মঞ্চকে যদি একসাথে ধরি আলী যাকেরের মতো খুব কম শিল্পীই এতোখানি দিয়েছেন এই দেশকে।
.
তিনি ছিলেন অনেকটা বাতিঘরের মতো। টেলিভিশন আর চলচ্চিত্রের থেকে মঞ্চই ছিলো তাঁর প্রাণ। আমরা যারা মঞ্চে অভিনয় করি, বা মঞ্চে অভিনয় যারা দেখি তাঁরাই সবচেয়ে বেশী বুঝতে পারছি আজ আমাদের অভিনয়ের আর মঞ্চের কতোবড় একজন দিকপাল চলে গেছেন!! খবরটা শোনার পর ঝরঝর করে কেঁদেছি! হাহাকার করে উঠলো বুকটা! কি গভীর শূণ্যতা! কাকে হারালাম আমরা, ও দেওয়ান গাজী আপনি বুঝি আর ফিরবেন না? ও দেওয়ান গাজী?
ক্যান্সারে আক্রান্ত তিনি অথচ মঞ্চে এসে কেঁদে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন “মঞ্চই একমাত্র আমার ভালোবাসা।”
.
অভিনয়কে তিনি নিয়ে গেছেন শিল্পের কাতারে। স্বাধীনতাত্তোর ও স্বাধীন বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক ও অভিনয়ে তাঁর যে অবদান তা অবর্ণনীয়।
বাকি ইতিহাস, সৎ মানুষের খোঁজে, দেওয়ান গাজীর কিসসা, কোপেনিকের ক্যাপটেন, গ্যালিলিও ম্যাকবেথ..! কটা নাটকের কথা বলা যায়। প্রতিটা নাটকে চরিত্রের প্রয়োজনে তিনি ভেঙেছেন আবার গড়েছেন। আর নাটকের নির্দেশনা তো আছেই।
.
বাংলা চলচ্চিত্রেও তিনি অসম্ভব শক্তিমান অভিনেতা। বলতেন একজন অভিনেতার তো কোন জাত ভেদাভেদ নেই।
চলচ্চিত্রের কথাই ধরি। মোরশেদুল ইসলামের বিখ্যাত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র “আগামী” দিয়ে চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় শুরু। তানভীর মোকাম্মেলের নদীর নাম মধুমতি চলচ্চিত্রে মোতালেব মোল্লা চরিত্রে তাঁর দোর্দন্ড অভিনয়। দুই বিখ্যাত চলচ্চিত্র লালসালু ও রাবেয়াতেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। তাঁর চরিত্রের ব্যাপ্তি হয়তো খুব একটা নয় কিন্তু নিখুঁত অভিনয়!
.
হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত নাটক বহুব্রীহিতে অপ্রকৃতস্থ মামা চরিত্রে তাঁর অভিনয় তো চিরভাস্বর!! এই চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখে বিনোদিত হননি এমন কেউ নেই! হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। কিংবা আজ রবিবার নাটকে আজগর চরিত্রে তাঁর অভিনয়। অভিনয় যে কতোটা প্রাণ থাকতে পারে। কতোটা নিখুঁত আর হাস্য রসাত্মক করে তোলা যায় তা তাঁর অভিনয়তেই বোঝা যায়!
আপনি যদি কেবল টিভি নাটক আর চলচ্চিত্র দিয়ে আলী যাকেরকে মাপতে যান তবে ভীষণ ভুল হবে। কারন হয়তো তাঁর অভিনয় জীবনের ৫ শতাংশও তিনি ওখানে দেননি। তাঁর পুরো ত্যাগটাই মঞ্চে!! যিনি ৭৩ বছর বয়সে ভঙ্গুর শরীরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে একটানা নিখুঁত অভিনয় করে যান গ্যালিলিও নাটকে। অথচ ক্যান্সার সেরে উঠেছেন কেবল তিনি! তখনো অভিনয় তাঁকে বেঁধে রেখেছে! কি বলা যায় বলুন?
.
তাঁর যাত্রাই শুরু হয়েছিলো বিখ্যাত কবর নাটক দিয়ে।
কতো বিখ্যাত নাটকের কথা বলা যায় আর। মাইকেলের বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, বাকী ইতিহাস, বিদগ্ধ রমণী কুল, তৈল সংকট, এই নিষিদ্ধ পল্লীতে, অচলায়তন, কোপেনিকের ক্যাপ্টেন ,টেমপেস্ট, কবর দিয়ে দাও কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত নাটক নূরলদীনের সারাজীবনে তাঁর অভিনয়!! একেকটি নাটক যেন একেকটি মহাযুদ্ধে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার নাম! তিনিই ক্যাপ্টেন, সম্মুখসমরে তিনি এক মহাপ্রাণ!
এর বাইরে মঞ্চকে সংগঠিত করা, নির্দেশনা, নাটক নিয়ে স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি। তাঁর শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকায় ছিলো মঞ্চের প্রতি ভালোবাসা। এরচেয়ে বড় ত্যাগ একজন অভিনয়শিল্পী আর কতোটা করতে পারেন?
তিনি কতোটা নিখুঁত তা একটা সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন-
“আমি যখন ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ করেছি, চেষ্টা করেছি রংপুরের ভাষাটা সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করতে। যখন ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ করি, তখন পুরোপুরি যশোরের ভাষায় কথা বলি, যখন ‘কাঁঠালবাগান’ করি, তখন আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষা বলি। কিন্তু যখন ‘গ্যালিলিও’ করি, তখন একদম প্রমিত বাংলায় সংলাপ বলি। এই জিনিসটা আমাদের (নাগরিকের) প্রত্যেক শিল্পীকেই শেখানো হয়েছে। আমাদের এখানে যারা আসে, তাদের ছয় মাসের মধ্যে ভাষাটা শিখতে হয়।”
বাংলার মঞ্চ, বাংলার অভিনয়, বাংলার মাটি বাংলার জলে আপনি হাজার বছর বেঁচে থাকবেন হে কিংবদন্তি। আপনার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।
লিখেছেনঃ Ahmad Istiak
বইয়ের ফেরিওয়ালায় আপনার লেখা প্রকাশ করতে চাইলে অথবা কোন বই রিভিউ করতে চাইলে লেখা পাঠান