Skip to content
Home » কিংবদন্তি নাট্যকার নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন‌

কিংবদন্তি নাট্যকার নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন‌

    সেলিম আল দীনের নাটক pdf
    Redirect Ads

    সেলিম আল দীন, তিনি ছিলেন আবহমান বাংলা ভাষার নাটকের মুকুটহীন সম্রাট। একজন স্বপ্নদ্রষ্টা একজন বাংলার নাট্যজগতের পুরোধা।

    সেলিম আল দীন যখন থেকে পড়তে শুরু করলাম তখন থেকেই ডুবে গেলাম গ্রামের নিতান্তই সাধারনের মাঝে। কখনো বা একটি অঞ্চলে, কখনোবা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, কখনোবা চিরায়িত লোকধারায়। হাত হদাই নাটকের সেই মোক্কা, হাইসসা নাড়ু সোলতানের জীবনের সঙ্গে। হাত হদাই দিয়ে শুরু, স্বর্ণবোয়াল দিয়ে পাঠের শেষ। হাত হদাই অনেকের কাছে দুর্বোধ্য লেগেছে কারন নোয়াখালীর আঞ্চলিকতার কারনে। তেমনটি কেরামত মঙ্গল কিংবা কীর্তনখোলার মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমাদের ফেনীর প্রত্যন্ত চর, জনপদকে যে করে সেলিম আল দীন নাটকে তুলে এনেছেন তা অবর্ণনীয়।

    Download

    তিনি তো শুধু নাট্যকার নন। আবহমান বাংলা ভাষার ঐতিহ্য সঞ্চারী নাট্যগগনের রাজা। তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দূরযানী এই অনিশ্চিত, রহস্যময় অন্ধকার সড়কে তিনি মগ্ন ছিলেন সারাটি জীবন। মরাপাতার মতো প্রচলিত মরা ভাবনা গুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রক্তিম বেদনার মতো ফল বানিয়েছেন। সমস্ত বিপর্যস্ত আর অনিশ্চয়তাকে আস্তিনে গুটিয়ে রেখে অজানার উদ্দেশ্যে শিখরে পৌঁছানোর প্রেরণায় অভিযাত্রী হয়ে কাটিয়েছেন আমৃত্যু। বাংলার নাট্যজগতে তিনি নিঃসঙ্গ শেরপা। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ এভাবে ভাবতে পারেন নি। সেলিম স্যার শুধু তো নাট্যকার নন। তিনি তো নাট্য রীতির নির্মাতা। হাজার বছরের সংস্কৃতির মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা নাট্য রীতির আবিস্কারক।

    অয়ন গঙ্গপাধ্যায়ের একটি মন্তব্যের কথা মনে পড়ে,

    “বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও বিবর্তনে সেলিম আল দীন ব্যবহার করেছেন ভারত বর্ষ এবং ইংরেজ শাসনামল। লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো এই দুই শব্দ বন্ধ এক বিশেষ ঐতিহাসিক সত্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে চাইছে। অন্য একটি পৃথক জাতি রাষ্ট্রের ইতিহাসের কথাই যেনো বলতে চাইছে। বলতে চাইছে ৪৭ নয় স্বাধীনতা, দেশ বিভাগও, সংস্কৃতি কি দেশ বিভাগে বিভক্ত!”

    সেলিম আল দীনের নাটক গুলোতে তাই পরিলক্ষিত হয়। একদিকে থাকছে বিভক্ত দুটি আলাদা জাতি রাষ্ট্রের তথাকথিত উত্তর ঔপনেবেশিক ইতিহাস অন্যদিকে থাকছে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রশ্ন, স্মৃতির প্রশ্ন, স্মৃতির ক্ষেত্রকে জাগিয়ে তোলার প্রশ্ন। তা ই আজীবন ফিরিয়ে এনেছেন সেলিম আল দীন। শকুন্তলায় সেলিম আল দীন যেমন মিথকে ভেঙ্গে নেরেটিভ গঠনে সঞ্চারিত করেছেন।

    উইলিয়াম জোন্সের অনূদিত কালিদাসের “শকুন্তলা” বাংলায় রুপান্তরিত হলো। শকুন্তলার মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করলেন বিনোদিনী দাসী। বাংলা মঞ্চ নাটকের সেই কিংবদন্তীতুল্য নারী অভিনেত্রী “নটি বিনোদিনী”। সেই বিনোদিনী দাসীকেই সেলিম স্যার উৎসর্গ করলেন তাঁর সৃষ্টি শকুন্তলাকে। শকুন্তলাই মূলত মোড় ঘুরিয়ে দেয়া। এই নাটক আমাদের কখনোই কালিদাসের প্রাচীনতম অমরাবতী নাটককে মনে করায় না। সেলিম আল দীন সৃষ্টি করলেন বঞ্চনার গল্পে। স্বর্গীয় এক চক্রান্তের শিকার শকুন্তলা যখন বুঝতে পারে তার জন্মের বৃত্তান্ত তখনই সে কুপিত হয় নিজের দেহের উপর। ষড়যন্ত্র এবং শকুন্তলা এই দুই খণ্ডে নাটক কে ভাগ করলেন সেলিম আল দীন।

    Download

    কীর্তনখোলায় আমরা দেখি তিনি বলেছিলেন,

    “এতদিন আমি ভয়ে ভয়ে লিখতাম-মঞ্চের আয়তন, লজিস্টিক সাপোর্টের কথা ভেবে লিখতাম। কীত্তনখোলায় এসে আমি এটা একেবারে বাদ দিলাম। … কীত্তনখোলা আমাদের অভাবিত একটা দুয়ার খুলে দিয়েছিল। … কীত্তনখোলা কাব্যধর্মী এবং এটা কবিতার সমান পর্যায়ে এসেছে।”

    এ নাটকে চিরায়ত বাঙালী নারীর আর্কেটাইপিক্যাল বৈশিষ্ট্য তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। ডালিমন ও বনশ্রীবালা যেন চিরকালের বাঙালী নারীর শাশ্বত রূপ। সৎ, সামাজিক ও শৈল্পিক। একজন হিংস্র ও বৈরী। অন্যজন আত্মসমর্পিতা।

    একজন সম্প্রদায়ককে ভালবেসে নিজেকে আত্মহত্যার মাধ্যমে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না। অপরজন সম্প্রদায়কে ভালবেসে তাদের সুরক্ষার জন্য আপোস করে। নিজের নারীসত্তাকে বিসর্জন দেয়। এ নাটকে চরিত্র আগণন। যেন শত শত মানুষ এক মহাকাব্যের পাদপীঠে এসে মিলিত হয়েছে। নাটকের পটভূমি এক মেলাকে কেন্দ্র করে। এই মেলা যেন গোটা বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে। এবং মানুষের এই মিলিত সমাবেশ উন্মোচিত করে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ মানুষের মধ্যকার নর ও নারীরসহ অবস্থানের ভেদজ্ঞান।

    কেরামতমঙ্গলও’ এক বিশাল ক্যানভাসে মঞ্চস্থ হওয়ার জন্য নির্মিত হয়। বহুরৈখিক ও বড় পরিসরের নাটক। আবহমান বাংলাদেশের ক্রমবিবর্তিত রাজনৈতিক ইতিহাস এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এর সামাজিক বন্ধন, দ্বন্দ¡, অচলায়তন, সুখ, দুঃখ, নারীবিদ্বেষ সবকিছু এই নাটকের দ্বৈরথে এসে ভিড় করল। এখানেও অসংখ্য চরিত্র। নাট্যকার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কোন সরলরেখায় নাটকটি এগোয়নি। সামনে যখন এগিয়েছে তখন এটা পাশেও কিন্তু স্ফীত হয়েছে।

    Download

    কীত্তনখোলা এবং কেরামতমঙ্গল প্রযোজনার মধ্য দিয়ে বিশাল এক ভূমি তৈরি হলো। এর আগে মঞ্চে থিয়েটার হতো প্রসেনিয়ামের মধ্যে। কিন্তু এই দুই নাটকে প্রসেনিয়াম ভেঙে মিলনায়তনের মধ্যে অভিনয় হলো। প্রসেনিয়ামও কিছু কিছু ব্যবহার করলাম। কিন্তু মূল অভিনয়টা মিলনায়তনের মধ্যে দর্শকের সামনে করা হলো- এটা কোন ফ্রেমের মধ্যে, চলচ্চিত্রের মতো একটা কোন ম্যাচবক্সের মধ্যে কিছু লোক হাঁটাচলা করছে এটা কিন্তু তা না।

    একটা পরিষ্কার ঝকঝকে জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছু মানুষ কথা বলছে, দর্শক সেটা দেখছে।’ ন্যারেটিভ ড্রামার এই রীতিতেই সেলিম আল দীন এবার মেলালেন বাঙালীর লোকায়ত যাপিত জীবনকে। সাপের কামড়ে সদ্যবিবাহিত এক বধূর করুণ মৃত্যুবিষয়ক সত্য কাহিনী অবলম্বনে বিনির্মাণ করলেন ‘প্রাচ্য’ নামক নাট্য।

    এক ভাগ্যাহত চাষীর স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের গল্প বিধৃত হলো এ নাটকে। এই চাষী হাজার হাজার বছর আগেকার এক জীবনচরিত্র হতে পারে এ লোকবিশ্বাস যাদের আমরা প্রাচীন উপাখ্যান, মিথ বা পুরাণের সঙ্গে মিলও খুঁজে পাই। এই মিথোজীবিতা আমাদের স্মরণ করায় হাজার বছরের প্রাচীন লোককথা লালকমল-নীলকমল, কালকেতু-ফুল্লরা, নূহের প্লাবন, কারবালা, কঙ্কাবতী, চাঁদসদাগর ও মনসামঙ্গলের কথা। পুরাণকথার মধ্যে বিদ্যমান থাকে অপরিসীম সৃজনী সম্ভাবনা।

    অশ্রুকুমার সিকদারের যেমন লিখেছিলেন,

    Download

    “এসব কাহিনীর অন্তর্গত অলৌকিক উপাদানগুলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের পরবর্তী প্রসারে বাতিল হয়ে যায় বটে। কিন্তু তার গূঢ় সাংকেতিক দ্যোতনা হারায় না। ফলে এইসব পুরাণের লোককথা শাশ্বতভাবে আধুনিক।”

    সেলিম আল দীন কেন নাট্যপ্রেমী ও বটেই বাংলা সাহিত্যের জন্য অবশ্য পাঠ্য তা তাঁর সৃষ্টিতে আবহমান বাংলার প্রেক্ষাপট ও বাংলার মানুষের দৈনন্দিন যাত্রার দৃশ্যায়নই প্রমাণ করে।

    কেবল নাট্যকারই ছিলেন না সেলিম আল দীন। ছিলেন একাধারে গীতিকার, কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক।

    আজ ১৪ জানুয়ারি বাংলা নাটকের মুকুটহীন সম্রাট নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের প্রয়াণ দিবস। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই নাট্যাচার্যের প্রতি।

    লিখেছেনঃ Ahmad Istiak

    বইয়ের ফেরিওয়ালায় আপনার লেখা প্রকাশ করতে চাইলে এইখানে লেখা জমা দিন।

    ইউটিউবে বইয়ের ফেরিওয়ালার বুক রিভিউ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

    Download
    Facebook Comments
    x
    error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করুন