আজ ২৫ মে ২০২০, পবিত্র ঈদুল ফিতর একই সাথে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ১২১তম জন্মদিন। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদের এই দিনে সকলের মুখে মুখে যে গানটি বাজে সেটি হল “রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির দিন…”। আজ আমরা আলোচনা করবো এই গানের সৃষ্টির পেছনের কাহিনী।
আরও পড়ুনঃ সৌদি আরব ও বাংলাদেশের চাঁদ বিষয়ক সমস্যা
সময়টা তখন শ্যামা সঙ্গীতের। শ্যামা সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা তখন এতোটা বেশি যে মুসলিম শিল্পীরা শ্যামা সঙ্গীত গাইবার জন্য নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম রাখতেন। এমনই এক সময়ে সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীন প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে একটি আবদার নিয়ে যান। বললেন-
“কাজীদা, একটা কথা আপনাকে বলবো বলবো ভাবছি। দেখুন না, পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা কী সুন্দর উর্দু কাওয়ালী গায়। শুনেছি এদের গান অসম্ভব রকমের বিক্রি হয়। বাংলায় ইসলামী গান তো তেমন নেই। বাংলায় ইসলামী গান গাইলে হয় না? আপনি যদি ইসলামী গান লেখেন, তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আপনার জয়গান হবে।”
কবি আব্বাস উদ্দীনকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন শ্যামা সঙ্গীতের এই টেন্ডে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কাজ করাটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। তারপর গ্রামোফোন রেকর্ডার ভগবতী বাবু ইসলামি সঙ্গীত রেকর্ড করতে রাজি না হলে তো কোনভাবেই সম্ভব না। নজরুল বললেন, “আগে দেখো ভগবতী বাবুকে রাজী করাতে পারো কিনা।” আব্বাস উদ্দীন গ্রামোফোনের রিহার্সেল-ইন-চার্জ ভগবতী বাবুর কাছে গিয়ে অনুরোধ করলেন তার ইসলামি সঙ্গীতের ব্যাপারে।
কিন্তু ভগবতী বাবু কোনভাবেই রাজি হতে চাননা কেননা বর্তমান ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে বিনিয়গ করলে লসের সম্ভাবনাই বেশি এবং অবশেষে ব্যাবসায়ে লাল বাতি জ্বলতে পারে। কিন্তু সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীনও একেবারে নাছোড়বান্দা। একবার চেষ্টা করে না হয় দেখাই যাক, ব্যাবসা না হলে পরে আর করবেন না। দীর্ঘ ছয়মাস পিছনে লেগে থাকার পর ভগবতী বাবু রাজি হলেন, বললেন গান নিয়ে আসুন। আব্বাস উদ্দিন তো বেজায় খুশি, সবাই রাজি এবার গান হলেই হবে।
আরও পড়ুনঃ বাংলা প্রবন্ধ সমগ্র PDF রিভিউ | বঙ্কিমচন্দ্র, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ
কাজিদার কাছে গেলেন সুর সম্রাট, একটা গান লিখে দিতে হবে এখন, ভগবতী বাবু রাজি। আব্বাস উদ্দিনকে বাহিরে অপেক্ষা করিয়ে নজরুল রুমে ঢুকলেন খাতা কলম নিয়ে। আব্বাস উদ্দিন বাইরে পায়চারি করতে লাগলেন, অপেক্ষা শুধু কাজিদার গানের। প্রায় আধঘন্টা পর নজরুল দরজা খুলে বের হলেন, তার হাতে একটি কাগজ যা এই আধ ঘন্টার সাধনার ফল আর আব্বাস উদ্দিন ছয় মাসের চেষ্টা। সুর সম্রাট কাগজটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন…
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তোরে মারল’ ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।”
এই সেই গান যা আজ ঈদের চাঁদ উঠার সাথে সাথে বেজে উঠে প্রতিটি টিভি চ্যানেলে, ছেলে বুড়ো সকলেই গুণগুণ করে। আব্বাস উদ্দিন কি তখন কল্পনা করেছিলেন এই গান একদিন এতোটা জনপ্রিয় হবে? তিনি তখন এটাই ভাবছিলেন এই গানটার জন্য তাকে কতই না কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে।
গান লেখার কয়েকদিনের মধ্যেই রেকর্ডিং শুরু হয়ে গিয়েছে। লেখক খুব এক্সাইটেড, আব্বাস উদ্দিনের সামনে কাগজটি ধরে রেখে কিভাবে সুর দিতে হরে দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু কোম্পানি বিরাট শঙ্কায় আছে, প্রথম এরকম গান, না চললে পুরোটাই ক্ষতি। এরই মধ্যে রমজানের ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গেলো। আব্বাস উদ্দিন বাড়িতে চলে আসলেন। গানের কি খবর জানেন না। বাড়িতে তার মন বসছে না। গানের কি খবর সেটা জানার জন্য তারাতারি ছুটি কাটিয়ে কলকাতা ফিরলেন।
আরও পড়ুনঃ সাম্যবাদী কবিতার মূল ভাব PDF কাজী নজরুল ইসলাম
ছুটির পর প্রথমবারের মত অফিসে যাচ্ছেন, বুক ধকধক করছে। গানটা কি ফ্লপই করলো? যদি ফ্লপ হয় তাহলে তো আর কোনদিন কোন ইসলামি গান নিয়ে কারো কাছে কোনোকিছু আবদার করতে পারবেন না। কতকিছু মাথায় ঘুরপাক করতেছে। এমন সময় পাশে বসা এক যুবক গেয়ে উঠলেন “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ…”। আব্বাস উদ্দিন ভুল শুনেছেন না তো? ট্রাম থেকে নেমে সুর সম্রাট দ্রুত ছুটলেন নজরুলের কাছে। আব্বাস উদ্দিনকে দেখেই নজরুল লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, “আব্বাস, তোমার গান কী যে হিট হয়েছে!” অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই গানটির হাজারখানেক কপি বিক্রি হয়, ভগবতী বাবুও দারুন খুশি। তারপর থেকে গানের বাজার শুরু হল নতুন ট্রেন্ড।
ফাইভ পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছিলো জুতোর ফ্যাক্টোরিতে